World Humanitarian Day বিশ্ব মানবতা দিবস।
খুব ছোটবেলার কথা। একটি শিশু পুকুরের পানিতে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে। পুকুর পাড়ের অন্য বাচ্চাদের চিৎকারে পাড়া প্রতিবেশী জমায়েত হয়েছে। সবাই কেবল চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নামছে না। ও শিশুটিকে উদ্ধার করছে না। এক সেকেন্ড দুই সেকেন্ড করে সময় যাচ্ছে। বাচ্চাটি ডুবছে আর ভাসছে। আর পানি গিলছে। ত্রিশ সেকেন্ড চল্লিশ সেকেন্ড যাচ্ছে। যাচ্ছে ১ মিনিট ২ মিনিট। পুকুর পাড়ে দশ বিশ ত্রিশ চল্লিশ করে মুহুর্তে লোক জড়ো হচ্ছে। শিশুটির মায়ের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করছে। শিশুটির মা না হয় ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে কীংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছে। কিন্তু অন্যরা পুকুরে ঝাঁপ দিচ্ছে না কেন? পুকুর পাড়ের শত লোক ঝাঁপ না দিয়ে হাউকাউ করছে কেন? আহাউহু করছে কেন? ……..
যাই হোক, শত শত লোক থেকে এক দুই জন লোক পুকুরে নামে, ঝাঁপ দেয়, শিশুটিকে উদ্ধার করে। এরাই মানবিক। এরাই অন্যের জন্য নিজের স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যেগ করে, ঝুঁকি নেয়। এদের জন্যই বিশ্ব মানবতা দিবস।
মানুষ যখন বিপদে পড়ে বা সমস্যায় পড়ে, তখন খুব আশা করে কেউ না কেউ এগিয়ে আসুক। তার হাত ধরুক, বিপদ ধরুক, পিঠে চাপড়ে সাহস দিক, সমস্যা দূর করুক। যারা বিপদের সময় সাহায্য করার মানুষ পান, তারা ভাগ্যবান। আর যারা মানুষের বিপদে এগিয়ে যায় তারা উত্তম মানুষ। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বলে মানুষই দাবি করে। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। সঙ্গতকারণেই মানুষকে মানুষের বিপদে আপদে এগিয়ে আসতে হয়। যারা মানুষ তারা মানুষের বিপদে এগিয়ে আসেও। এটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই বিশ্ব মানবতা দিবস উদযাপিত হয়। তাদের স্মরণে যারা মানুষের বিপদে বা প্রয়োজনে এগিয়ে যায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সময়, শ্রম, অর্থ দিয়ে যারা বিশ্বের বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায় তাঁদেরকে উতসাহিত করতেই এ দিবসটি পালন করা হয়।
যুদ্ধ বিধবস্ত ইরাকে সেরগিও ভিয়েরা দ মেলো ও তার সহকর্মীদের প্রয়াণ দিবসটিকে জাতিসংঘ ২০০৮ সালে ‘‘বিশ্ব মানবতা দিবস‘‘ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০০৯ সালের ১৯ শে আগস্ট প্রথম বিশ্ব মানবতা দিবস পালিত হয়।
বিশ্বের অনেক মানুষ না খেয়ে বা অর্ধাহাড়ে থাকে। অনেক মানুষ অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে বা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, অনেক মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা নানান সমস্যায় বিপদাপন্ন থাকে, অনেক মানুষ যুদ্ধ, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দাঙ্গায় মরণাপন্ন হয়, ঝুঁকিতে থাকে। তখন কিছু লোক তাদের জন্য কাজ করে। সেই স্বেচ্ছাসেবক সংখ্যা পৃথিবীতে কম হলেও আছে। আছে বলেই পৃথিবী এখনো টিকে আছে। ধর্মীয় বিধান আছে যে, ‘‘সে মুমিন নয় যে নিজে খায় অথচ তার প্রতিবেশী অভূক্ত থাকে‘‘। ক্ষুধার্তকে অন্ন দেওয়া, পিপাসার্তকে পানি দেওয়া, বিপদগ্রস্তের পাশে দাড়ানো এগুলো মানুষেরই কাজ। প্রসঙ্গত বাঙালি কবি কামিনী রায়ের কথায় আসে সে শাশ্বত অনুভূতি –
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”।
১৯৯৪ সালে রেড ক্রস, অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবিক সহায়তা বিতরণের সময় ১০টি আচরণবিধি বা কোড অব কন্ডাক্ট নির্ধারণ করে। এই সিওসি’তে অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযোগ্য বিধির মধ্যে রয়েছে-
দয়া নয়, সাহায্য পাওয়া মানুষের অধিকার;
সাহায্য গ্রহণকারীকে দয়ার পাত্র হিসাবে গণ্য না করে সম্মানীয় গণ্য করা;
পরিচয় নয়, বরং ক্ষতি বা দুর্ভোগের ব্যাপকতার ভিত্তিতে সাহায্য বিবেচনা করা;
সাহায্য বিতরণের সময় স্থানীয় কৃষ্টি-প্রথাকে সম্মান প্রদর্শন;
কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সাহায্য প্রদান করা যাবে না এবং
সর্বোপরি স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ বিপদাপন্নতা লাঘবের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা।
প্রায় সাড়ে তিনশতাধিক সংস্থা এই কোড অব কন্ডাক্টে স্বাক্ষর করেছে।
এটি দুর্যোগকবলিত জনগোষ্ঠী ও জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক, যা ৪টি নীতি অনুসরণ করে-
দুর্যোগে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবসহ তাদের জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষা এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা (মানবতা);
বৈষম্য ব্যতিরেকে সর্বাধিক দুর্দশাগ্রস্তদের অগ্রাধিকার দিতে হবে (নিরপেক্ষতা);
মানবিক কর্মকাণ্ড কোনো সংস্থার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ব্যবহৃত হবে না (স্বাতন্ত্র্য); এবং
মানবিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা সংস্থা সংঘাতে কোনো পক্ষ নেবে না বা রাজনৈতিক, বর্ণবাদী, ধর্মীয় ও আদর্শের দ্বন্দ্বে জড়াবে না (পক্ষপাতহীনতা)
যাই হোক, তবু কিছু লোক মানবতা নামের কাজ করতে গিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসে। স্থানীয় এনজিও, বা আন্তর্জাতিক এনজিও, কর্পোরেট বা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান নানাভাবে এসব ফাঁদ তৈরি করে। ব্যবসা করে। এরা আজকের মানবতা দিবসের আলোচনায় আসবে না। কারণ এরা মূলত ব্যবসা করে। মানব সেবা ওদের আসল ধর্ম নয়। এরা নিপাত যাক।
প্রকৃত অর্থেই মানুষের জন্য বা সৃষ্টির জন্য কাজ করাই মানবজীবনের পরম ধর্ম হওয়া উচিত। জগতের সকল মনীষীরা অনুরূপ করে গেছেন। মহানবী (স:) বলেছেন ‘‘যে লোক কোনো দুঃস্থ (অসহায়) লোকের অভাব দূর করে দেবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দুরবস্থা দূর করে দেবেন।‘‘ তিনি অন্যত্র বলেছেন ‘‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে আল্লাহ ততক্ষণ তার সহযোগিতা করতে থাকেন।‘‘
বাস্তবে অন্যের বিপদে বা সমস্যায় আপনি যদি অগ্রসর হন। আপনার বিপদে হয়তো সে আসবে না। কিন্তু কেউ না কেউ অবশ্যই আপনার বিপদে বা সমস্যায় হাজির হবেই। প্রকৃতি বা সৃষ্টিজগত সেভাবেই কাজ করে। কেউ আসুক বা না আসুক, আপনি যখন অন্যের কষ্ট, দু:খ দূর করবেন, বা সমস্যায় দূরীকরণে পাশে থাকবেন, তখন আপনার মনের যে প্রশান্তি তা অপার্থিব। সেরকম প্রশান্তি ও আরাম সাধারণ ভোগবিলাস করে পাওয়া যায় না।
মানুষের সমস্যা দূর করুন, অদৃশ্য আলোয় ভালো থাকুন।
১৬ আগস্ট ২০২২
hello