Detail

Home - উন্নয়ন - ‘গ্রাম হবে শহর‘ বিষয়ে গ্রামের ছেলের ভাবনা

‘গ্রাম হবে শহর‘ বিষয়ে গ্রামের ছেলের ভাবনা

‘গ্রাম হবে শহর‘ বিষয়ে গ্রামের ছেলের ভাবনা:

গ্রামকে শহর বানানোর যে স্লোগান বা ভিশন তা নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নও জরুরি। এ ভিশন যাদের ভাবনায় এসেছে তাঁদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। একটি সময়োচিত ভিশনারি ভাবনা। অনেকে এটির বিরোধীতা করে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, সেগুলো মূলত: রাজনৈতিক বিরোধিতা থেকে। বিরোধিতার জন্য যারা বিরোধতা করেন এদের কথা থাক। বরং এ সুন্দর স্বপ্নটিকে কীভাবে টেকসই ও ফলপ্রসূ করা যাবে সেদিকে আলোকপাত করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

‘গ্রাম হবে শহর‘ এর বাস্তবায়ন যেন লিটারেলি না করা হয়; ইটপাথর, টাইলস আর বহুতল ভবন মানে শহর এ ধারণায় যেন না হয়; সেটা খেয়াল রাখতে হবে সকলের। সকল জমিতে টাইলস লাগালে, সকল বাড়ি বহুতল হলে, সকল খাল ভরাট হলে, সকল নদীর স্রোত বন্ধ করে ব্রিজ করলে ও হাওর বিলের পানিপ্রবাহ বন্ধ করে রাস্তা করলে সমস্যা বাড়বে। প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ, রাজনীতিবিদ, অভিজ্ঞ আমলা, গবেষক, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, কমিউনিট সকলকে খুব খেয়াল করতে হবে। হুট করে যেন কোন মেগা প্রকল্প নেয়া না হয়। টাকার শ্রাদ্ধ হবে, কাজের কাজ কিছু হবেনা।পরে ‘দাওহে গ্রাম লও এ শহর‘ বলে বলে কাঁদতে হবে।

সহজ কথায় গ্রামকে শহর করবো এ স্লোগান ঠিক হলেও, এর মানে তত সহজ নয়। প্রকৃত মানে একটু গভীর। গ্রামের যা যা আছে তার সব বজায় রেখে তথা গ্রামীন আবহ, কৃষ্টি, কালচার, জীবনযাত্রা, পেশা, চাষাবাদ, সম্পদ, পরিবেশ, প্রতিবেশ ইত্যাদি বজায় রেখে গ্রামের উন্নয়ন করতে হবে। গ্রামে শুধু দিয়ে দিলেই হবেনা, যা দেওয়া হবে তার কার্যকরিতা কী হবে তা ভাবতে হবে। যেমন বিদ্যুত এর অনেক কাজ আছে। কিন্তু বেশিরভাগ গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুতের কাজ হলো ‘ডিপজলের সিনেমা দেখা‘! অথচ জীবনযাত্রার পাশাপাশি উৎপাদনখাতে বিদ্যুতের ব্যবহার হওয়া জরুরি ছিল।

যাক প্রসঙ্গে আসি। গ্রামকে শহর করার উদ্দেশ্য মোটা দাগে তিনটি হতে পারে:

এক. শহরে যেসব বেসিক নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা গ্রামেও থাকা;

দুই. শহরে যেরকম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে, সেরকম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রামেও থাকা।

তিন. গ্রামের নাগরিকদের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা প্রশিক্ষণ, ও সেবাসহ বিশ্বমানের নাগরিক হবার পথগুলো হাতের নাগালে থাকা।

এখানে চাপিয়ে দেওয়া প্রকল্প দিলে টেকসই হবেনা। এনজিওর মতো শুরু হবে, প্রকল্প বা এনজিও চলে গেলে সব শেষ। তাই একটি গ্রামে যারা বাস করে তারা কীভাবে চলে, কী চায়, কী দরকার, কী দিলে তাদের বর্তমান সকল উপকরণ বজায় থেকে ভবিষ্যত উন্নত হবে, এসব ভাবনাসহ তাদেরকে অর্ন্তভূক্ত করতে হবে।

কী কী দরকার?

১. খাদ্য উৎপাদনে গ্রামের মানুষের যে বর্তমান কর্মপ্রচেষ্টা সেটাকে আরো সহজীকরণ করে সুলভে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে অধিক খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা। কৃষকদেরকে উন্নত প্রশিক্ষণ ও উন্নত যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। দেশব্যাপী ভেজাল, মানহীন কীটনাশক সার উৎপাদন ও বিতরণ বন্ধ করা।

২. শহরের মতো উন্নত শিক্ষা গ্রামে বাস্তবায়ন করা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান দেশব্যাপী একরকম করা। তদবির ব্যাতীত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রতি বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান/ক্রীড়া/সংগীত ইত্যাদির জন্য পর্যা্প্ত ব্যবস্থা থাকা।

৩. শহরের মতো গ্রামে হাতের নাগালে কমপক্ষে প্রতি ইউনিয়নে উন্নত হাসপাতাল থাকা। সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও উন্নত ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ।

৪. সরকারি সেবা হাতের কাছে নিয়ে আসা। পারলে প্রতি ওয়ার্ডে না পারলে প্রতি ইউনিয়ন থেকে বেশিরভাগ জরুরি সরকারি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা। যাতে মানুষকে খুব কম কাজে শহরে যাওয়া লাগে।

৫. গ্রামের প্রতিটি এলাকার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিয়ে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাতে স্থানীয় কাঁচামালের ব্যবহার হয় আবার কর্মসংস্থানও হয়।

৬. ‘একটি বাড়ি একটি খামার‘ মতো ‘একটি গ্রাম একটি কারখানা‘ বাস্তবায়ন হতে পারে। যেখানে মাছ বেশি মাছ ভিত্তিক, যেখানে ধান বেশি সেখানে ধানভিত্তিক, যেখানে আলু বেশি আলু ভিত্তিক, যেখানে পেয়ারা বেশি পেয়ারা ভিত্তিক কারখানা গড়ে তুলতে হবে। তা দেশে বিদেশে বিক্রয়ের চেইন তৈরি করা।

৮. প্রতি গ্রামে উন্নত লাইব্রেরি, উন্নত পোস্ট অফিস (ব্যাংকিংসহ), শিশু পার্ক, শিল্পকলা ভবন, কালচারাল অডিটরিয়াম, বয়স্ককেন্দ্র, সোশ্যাল ক্লাব ইত্যাদি স্থাপন করা।

৯. ইউনিয়ন পরিষদকে পূর্ণ ক্ষমতায়ন করা। যাতে ইউনিয়নের বরাদ্দ ইউনিয়ন পরিষদ আইন মেনে নিজেরা স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করবে। তাঁদেরকে এমপি বা উপজেলার পরিষদ বা আমলারা বা স্থানীয় নেতারা হস্তক্ষেপ করবেনা। শুধু কোন অনিয়ম হলে সেটা ব্যবস্থা নেবে। জাপানে বা ভারতের কেরালায় যেরকম হয়।

১০. হাউজিং আইন করে তা বাস্তবায়নের জন্য ইউনিয়ন পরিষদকে ক্ষমতায়ন করা। প্রতি বাড়ির মালিক যেন সে আইন মেনে পরিকল্পিত বাড়ি করেন। না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশি সহায়তা ইউনিয়ন পরিষদকে প্রদান করার নিশ্চায়তা বিধান করা।

১১. শিক্ষক, ডাক্তার ও সরকারি অফিসার যারা ইউনিয়নের মধ্যে থাকা জরুরি তাঁদের জন্য স্কুলের পাশে , অফিসের পাশে, হাসপাতালের পাশে আবাসন দরকার। এবং এসব অফিসারেরা তখন গ্রামে থাকবেন যখন গ্রামে বা ইউনিয়নে সকল নাগরিক সুবিধা পর্যাপ্ত বা মিনিমাম হলেও থাকবে। উন্নয়নের বিষয়গুলো একটির সাথে আরেকটি কানেকটেড।

১০ প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বড় উন্নত সুবিধাসহ শপিংমল বা বাজার দরকার যাতে করে ওই শপিংমলে বা বাজারে সবকিছু ন্যায্য দামে পাওয়া যায়। ব্রান্ড বা ননব্রান্ড সব। যেমন উন্নত দেশের যেকোন জায়গায় দুধ বা চাল বা সব্জি বা কাপড়চোপড় প্রায় একই দাম। ব্রান্ড ও ননব্রান্ড সব উপশহরে পাওয়া যায়। অন্তত: উপজেলা পর্যায়েও সব ব্রান্ডের/ননব্রান্ডের দোকান বা পন্য পর্যাপ্ত থাকলে মানুষ নগরে আসতে চাইবেনা।

করণীয়:

১.সকল মন্ত্রণালয় থেকে কারিগরি মতামত নেওয়া;

২. গ্রাম, সমাজ, স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করেন এমন আমলা, গবেষক, সাংবাদিক, নেতা, একাডেমিকদের মতামত গ্রহণ করা। হুট করে কেউ ওহী নিয়ে হাজির হলো আর সাথে সাথে বাস্তবায়ন শুরু করে দিলে কাজের কাজ কিছু হবেনা। ফলপ্রসূ হবেনা।ইফিসিয়েনসি হতে পারে কিন্তু ইফেকটিভনেস বা আউটকাম ভালো হবেনা।

৩. উন্নত বিশ্বের কোন মডেল সরাসরি এখানে বাস্তবায়ন করা যাবেনা। কেরালা বা এরকম উন্নয়নশীল জায়গার কিছু এলাকার উন্নত গ্রামের চিত্র দেখতে হবে। প্রতি গ্রাম এলাকার নিজস্বতা বিবেচনায় নিয়েই আগাতে হবে।

৪. শুধু সরকারি বরাদ্দ দিয়ে বা উন্নয়ন তহবিল দিয়ে করা ঠিক হবেনা। গ্রামের মানুষদের সংশ্লেষ, সম্পৃক্তকরণ, অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম ও মূলধন দিয়ে গ্রামের মানুষ জড়িত হলে তা টেকসই হবে। অন্যথায় ‘সরকারি মাল, দরিয়ামে ঢাল‘ হবে কিংবা  বাস্তবায়নকালে তহবিল তসরুপ হবে, কিংবা পরবর্তীতে এসব পরিচালনা নিয়ে রেষারেষি করে সমস্ত সুবিধা অসুবিধায় রূপান্তর হবে;

৫. প্রতিটি গ্রাম এলাকার স্থানীয় মানুষের মতামত গ্রহণ করা। (দুচারজন ডেকে বক্তৃতা শোনা নয়, সত্যিকার অর্থে কোশ্চানেয়ার দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিলে সকল স্টেকহোল্ডার যেমন কৃষক, মাস্টার, গৃহিনী, ব্যবসায়ীর মতামত নেওয়া)। তারপর সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা;

৬. প্রতি ইউনিয়নের জন্য ভিন্ন পরিকল্পনা লাগবে। থাওহা কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাবেনা। প্রতিটি ইউনিয়নের মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা ভিন্ন। পরিবেশ প্রতিবেশও ভিন্ন। সম্পদও ভিন্ন। শাল্লা আর বিলাইছড়ির হিসেব ভিন্ন হবে।  আবার কসবা উপজেলায় পাহাড়ী সীমান্ত ইউনিয়ন গোপীনাথপুর আর ভাটি অঞ্চল মেহারি বা মূলগ্রাম ইউনিয়নের ভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা লাগবে;

এগুলো এক মাথার চিন্তা মাত্র। সম্পৃক্তদের মাথায় নিশ্চয়ই এরকম আরও ধারণা আছে। যারা বুদ্ধিজীবী ও পলিসি মেকিং এ আছেন তারা আরো বেশি জানবেন। সকলের মতামত নিয়ে ধীরে সুস্থে সুন্দর পরিকল্পনা হবে সে আশাবাদ রইলো।

সকল গ্রামে টেকসই উন্নয়ন হোক, গ্রাম গ্রামের মতো থেকেই শহর হোক, শহরের সকল প্রয়োজনীয় সুবিধা গ্রামেও বিরাজ করুক। এ শুভকামনায়।

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart