গ্রাম্য মোড়লের সালিশ
তিনতিনটা সভা শেষ করে বেলা দুটো নাগাদ মধ্যাহ্নভোজনের পর অফিসে ফিরে ঘুমাক্রান্ত ঝিমুনিভাবের মধ্যেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে খবরের আপডেট দেখছিলাম আর বিকাল তিনটায় আরেকটি সভা শুরু করার অপেক্ষা করছিলাম। তখন দুজন বয়স্ক শ্মশ্রুমন্ডিত লোক আমার কক্ষে সালাম দিয়ে ঢুকলো। সালামের জবাবের তোয়াক্কা না করে, বসার অনুমতির অপেক্ষা না করে নিজেরাই চেয়ার টেনে বসে পড়লো। একজনের বয়স সত্তোরোর্দ্ধ অন্যজন ষাটোর্দ্ধ। পাঞ্জাবী পরা রোদে পোড়া চেহারার লোক দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলাম। সত্তোরোর্দ্ধ লোকটি পাঞ্জাবীর পকেট থেকে হাতড়ে একটা হাতে লেখা অভিযোগপত্রের ফটোকপি বের করলো। আমার হাতে দিল। আমি চোখ বুলালাম।
”জনৈক গ্রাম পুলিশ আনিস তার গ্রামের মহসীনকে জমি বিক্রী করতে উদ্ধুদ্ধ করে। উক্ত জমি আবুর নিকট বিক্রি করে ১২০,০০০ টাকা গ্রাম পুলিশ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করে ফেলে। জমির মালিক মহসীন বোকাসোকা। কিছু বুঝতে পারেনি। এ নিয়ে গ্রামে সালিশ হয়। সালিশে আনিসকে ১২০,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু আনিস উক্ত জরিমানা পরিশোধ করছেনা”
অভিযোগটি পড়ে লোক দুজনের চোখের দিকে তাকালাম। চোখের ভাষায় অভিজ্ঞতার ছাপ পেলাম। কোন মিথ্যার আভাস পেলামনা। দুএকটি প্রশ্ন করে অভিযোগটির বিষয়ে আরো পরিস্কার হলাম। গ্রামপুলিশ গ্রামে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত। গ্রামের সকল অপকর্ম-অনিয়মের খবর দেয়া তার কাজ। সে নিজেই যদি অপরাধে জড়িয়ে যায় তাহলে বিষয়টি গুরুতর। লোক দুজন উপজেলা চেয়ারম্যানের বরাত দিলো, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, ও সচিবের বরাত দিয়ে গ্রাম পুলিশ আনিসকে প্রতারক হিসেব চিহ্নিত করে বিচার চাইলেন। বিশ মিনিট সময় দিলাম। দু মুরব্বীকে মন দিয়ে শুনলাম। এবং উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও মেম্বারের সাথে ফোনে কথা বলে অভিযোগটি প্রায় সত্য বলে অনুমিত হলো। আমি গ্রাম পুলিশকে যথাযথ বিচারের আওতায় আনা হবে মর্মে আশ্বাস দিয়ে তাঁদের বিদায় করলাম।
পরে ইউনিয়ন ওয়েবসাইট থেকে গ্রাম পুলিশের মোবাইল নম্বর সংগ্রহকরতঃ ফোন করলাম। তাকে পরদিন দুপুর বারটায় অফিসে আসতে বললাম। পরদিন গ্রাম পুলিশ আনিস হাজির হলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। জেরার মুখে সে কাঁদতে লাগলো এবং বললো এ অভিযোগ সত্য নয়। ”জমি বেচাকেনায় আমি সাক্ষী ছিলাম তবে টাকা আমি গ্রহণ করিনি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সালিশ হয়েছে। জোরপূর্বক জরিমানা আরোপ করা হয়েছে” সে জানালো। আমি বললাম যে আপনার কথা সত্য মনে হচ্ছেনা। কারণ যদি আপনার নামে মিথ্যা প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়ে থাকে এবং মিথ্যা সালিশ ও জরিমানা হয়ে থাকে তবে আপনি আমাদের জানালেননা কেন? থানায় জানালেননা কেন? চেয়ারম্যানকে জানালেননা কেন? আপনার সাথে তো প্রতি মাসে আমার দেখা হয়! আপনি অভিযোগ করলেননা আর তাঁরা অভিযোগ করার পর অস্বাীকার করছেন! দাড়ান আপনাকে এক্ষুণি থানায় দিচ্ছি! (মোবাইলে ওসীকে ফোন করার অভিনয় করলাম)
বিষয়টার কূল কিনারা পাচ্ছিলামনা। একদিকে চার জন জনপ্রতিনিধি। জনপ্রতিনিধিরা কোন রাজনীতি করছেননাতো!? অন্যদিকে গ্রামপুলিশ আনিস বেচারা হাউমাউ করে কাঁদছেন। বেচারা আনিস কান্নার ভান করছেনাতো?! এসময় জমির ক্রেতা আবুকে ফোন করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে জমি কিনেছে কিনা, টাকা পরিশোধ করেছে কিনা, টাকা কার হাতে দিয়েছে ইত্যাদি। আবু জানালো সে ৮০,০০০ টাকায় জমি কিনেছে এবং সে সরাসরি জমির মালিক মহসীনকে টাকা দিয়েছে। গ্রামপুলিশ আনিস জমি কেনাবেচায় সাক্ষী হয়েছে মাত্র।
বিভিন্ন কর্ণারে ফোন করে তদন্তে দেখা গেল অভিযোগকারী বাশার হচ্ছেন ক্রেতার চাচা আর বিক্রেতার বোনজামাই। উক্ত বাশার গ্রাম্য মোড়ল যিনি ঐ জমিটা কিনতে চেয়েছিলেন। কিনতে পারেনি কারণ তার শালা মহসীন বেশি মূল্যের আশায় জমিটি আবুর নিকট গোপনে বিক্রি করে যেখানে সাক্ষী হয়েছে গ্রামপুলিশ আনিস। এজন্য ক্ষেপে গিয়ে উক্ত মোড়ল গ্রাম্য সালিশ ডেকে আনিসকে ১২০,০০০ টাকা জরিমানা করে । উক্ত সালিশে জমি ক্রেতা আবুর বক্তব্য নেয়া হয়নি। মেম্বার-চেয়ারম্যানগণ মোড়লের পক্ষে রয়েছে সঙ্গতকারণেই! ভোটের রাজনীতি! বাশারের শালা মহসীন এ সালিশের প্রতিবাদ করতে পারেনি কারণ সে কোন কথা বললেই তার বোনের উপর খড়গ নেমে আসবে। পারিবারিক নির্যাতনও জড়িত!
ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে আমি অভিযোগকারীকে ফোন দেই। তাকে তার ভাতিজা জমি ক্রেতা আবুকে নিয়ে হাজীর হতে বলি। আজ নয় কাল বলে কয়েকদিন তারিখ পরিবর্তন করে এবং একা আসতে চায়। আবুকে নিয়ে দুদিনের মধ্যে না আসলে আমি বাড়িতে পুলিশ পাঠবো বলে ভয় দেখালে সে ভাতিজাসহ হাজির হয়। আবু জানালো সে ৮০,০০০ টাকায় জমি কিনেছে এবং সে সরাসরি জমির মালিক মহসীনকে টাকা দিয়েছে। গ্রামপুলিশ আনিস জমি কেনাবেচায় সাক্ষী হয়েছে মাত্র। বাশারকে আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কেন আমার নিকট ঐদিন মিথ্যা অভিযোগ করলেন, আমার সাথে মিথ্যা বললেন, মিথ্যা সালিশ করলেন, মিথ্যা জরিমানা করলেন। জবাবে সে অনেক ধানাইপানাই করার চেষ্টা করলেন। আমি তাকে থানায় দিলাম এবং গ্রাম পুলিশ কর্তৃৃক প্রতারণার মামলা রুজু করা হলো ও ওসিকে বলে গ্রেফতার করে চালান দেয়া হলো।
গ্রামে গ্রামে মোড়লদের অবস্থান ইস্পাত কঠিন। এরা ধর্মীয় নেতাদের (ইমাম-মুয়াজ্জিন-পুরোহতি) ছায়া পায়, এরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রচ্ছায়ায় থাকে, এরা স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্বদের আস্কারায় ধরাকে সরাজ্ঞান করে। গ্রামপর্যায়ের এ ট্রাডিশনাল নেতৃত্ব গ্রামের উন্নয়নে (গ্রামের শান্তি-শৃংখলা রক্ষা, শিক্ষার উন্নয়ন, অবকাঠামোর উন্নয়ন) ভূমিকা রাখছেনা। বরং গ্রামের মানুষদেরকে ডিভাইড এন্ড রুল এর মাধ্যমে শাসন করে, অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে অসহায় গ্রামবাসীর রক্তচোষাই যেন এ মোড়লদের প্রধান ধর্ম। মোড়লীপনা নিপাত যাক।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )