সানসাইন কোস্ট, অস্ট্রেলিয়া
প্রশান্ত মহাসগারের তীরঘেষে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের উত্তর পূর্বে একটি প্রাকৃতিক পর্যটন শহর অবস্থিত। নাম তার সানশাইন কোস্ট।ক্যালন্দ্রা সম্প্রাদায়রা সেখানে বাস করতো। প্রথম সেটেলার হিসেবে ১৭৭০ সালে ক্যাপে্টইন কুক প্রথম পা রেখে যাত্রা শুরু করেন। এরপর বিশ্বরাজনীতি বা অর্থনীতির কল্যাণ ও বাণিজ্যের খেলায় এ তীরও বাদ পড়েনি।কাঠ পাচার, বন পাচার, মৎস্য শিকার, মানব স্থানান্তর কোনকিছুই রহিত থাকেনি।
প্রকৃতিই তার মূল সৌন্দর্য। ১৯৮০ সালের পর মূলত পর্যটন, সার্ফিং, ও হলিডে উদযাপনকে কেন্দ্র করে সানশাইন কোস্টের রাস্তাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামো দ্রুত উন্নতি লাভ করে।গত সপ্তাহে ওখানে ভ্রমণে গিয়ে অনেক বিষয় চোখে পড়লো।
কিউইউটি, কুন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, সিকিউইউ, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটিসহ ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ জন পিকনিকের উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাস আমাদেরকে বিচের পাশে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। দূরে কোথাও যেখানে ট্রাফিক সমস্যা নেই। আবার বিকেলে নির্দিষ্ট সময়ে বাস আসলো, আমরাও ফিরলাম। উক্ত বাস বা বাসের ড্রাইভার যাত্রী বা পথচারি কারো কোন সমস্যা তৈরি করলোনা।
কীংস বিচে গেলাম। হাজার হাজার পর্যটক সী বিচে সাঁতার কাটছে, সার্ফিং করছে, লাফালাফি করছে, বিভিন্ন খেলা খেলছে, সান বাথ নিচ্ছে কোন আওয়াজ নেই। মাছের বাজার টাইপ চিৎকার চেচামেচি নাই। স্বল্পবসনা নারী-পুরুষ যে যার মতো সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময়ও নেই।তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমাদের মতো ঝগড়াও নেই।
পাশেই সুইমিং পুল। স্বচ্ছ পানিতে ছেলেপুলেসহ ফ্যামিলির সবাই সাঁতার কাটেছে। খুব মজার। কেউ কোথাও কাউকে বিরক্ত করছেনা। বা বিরক্ত হচ্ছেনা। পাশের ড্রেস চেঞ্জিং কক্ষে বা টয়লেটে হাজার লোক যাচ্ছে। টয়লেটে কোন অযাচিত ময়লা বা নোংরা পরিবেশ তৈরি করছেনা।
কৃত্রিম ঝরণায় গোসলও খুব ফান! বাচ্চাদের জন্য ছোট খাটো রাইড, বয়স্কদের জন্য শরীরচর্চার সরঞ্জাম। কী নেই? একটু দূরে দূরেই সমূদ্রে নামার জন্য সারিবদ্ধ সিড়ি। এবং গোসলের জন্য ঝরণাকল পয়েন্ট ও ড্রেস পরিবর্তনের জায়গা। না দেখলে বিশ্বাসই হয়না প্রকৃতির সাথে আধুনিক সরঞ্জামাদির কী সুন্দর সংযোগ ও সমন্বয়। মিলেমিশে একাকার। পর্যটকরা যত প্রয়োজন অনুভব করতে পারে সব আছে ওখানে। আমাদের ট্রলি ব্যাগ এক জায়গায় রেখে কত জায়গায় গেলাম। কোন চোর এসে সেটা নিয়ে যায়নি। আহা এমন যদি হতো!
অবাক লাগার মতো একটি বিষয় হচ্ছে, সী বিচে রোদে তপ্ত বালুর মধ্যে শুয়ে শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পর্যটক বই পড়ছে একমনে। একজনকে দেখলাম ২ টা বই শেষ করলো একটানা। আমরা তো সী বিচে গেলে ছবি আর সেলফি তুলেই হুশ পাইনা। বই পড়াও ওদের ধ্যান-জ্ঞান। যারা বই পড়েনা তারাও বিভিন্ন খেলা যেমন ফুটবল, বলিবল, সার্ফিং ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের মতো সেলফি নিয়ে ব্যস্তনা।
বিচের পাশে পার্কে আমরা আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করলাম। কিছু মজার খেলধুলা ও র্যাফেল ড্র হলো। মজার বিষয় কোথাও কেউ কোন ময়লা ফেলেনি। অথচ এ আমরাই দেশে গেলে বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র ময়লা ফেলি!
বিচের সব দেখে আমার কেবলি হলো মনে প্রাকৃতিকভাবে আমাদের কক্সবাজার অনেক সুন্দর। এর ধারে কাছে অন্য বিচ আসবেনা। অন্তত আমার চোখে তাই মনে হয়েছে। তবে অন্যান্য সুবিধা, অবকাঠামো, মানুষের ব্যবহার, আচরণ, গতিবিধি, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনায় আমাদের যেতে হবে অনেক দূর।
ছেলে আমার প্রশ্ন করে, বাবা আমার লজ্জা লাগে ওরা এত ছোট কাপড় পড়ে কেন? আমি বলি ওতে তোমার সমস্যা কি? ছেলে বলে আমি তাকাতে পারিনা, শরীর দেখা যায়। আমি বলি তাকাবানা। থেমে বলি , অথবা তাকালেও সমস্যা নাই। পরে আমি ছেলেকে ডেকে কাছে আনি ওর হাত ধরে চিমটি দিই। কেমন লাগে? ও বলে, সামান্য ব্যথা। আবার তার পেটে চিমটি কাটি। কেমন লাগে? প্রশ্ন করি। ছেলে উত্তর দেয় সামান্য ব্যাথা। প্রশ্ন করলাম হাত আর পেটে ব্যথা কী একই রকম? বলল হুম। তার মানে দুটোই চামড়া। শরীরের পুরো অংশই চামড়ামাত্র। ওটা খোলা কী ঢাকা বিষয়না। সবই সমান। এ নিয়ে লজ্জারও কিছু নাই। আবার অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকারও কিছু নাই। নির্লিপ্ত থাকতে শেখো। ছেলে চিন্তা করার ভান করে। মনে হয় কিছুটা বুঝতে পারছে। আমি আবারও বলি আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা শরীর ঢেকে রাখা পছন্দ করি। তুমি কি পছন্দ কর? সে বলে শরীর ঢেকে রাখা। আমি বলি গুড। তবে মনে রাখতে হবে। অন্য সংস্কৃতিতে এসছো। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সংস্কৃতি ও দৃষি্টভঙ্গীর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। অস্বস্তি লাগলেও সেটা প্রকাশ করা যাবেনা। বা দেখারও দরকার নাই। ওকে? ছেলে স্মিত হাসে। আধাআধি কিছু একটা যা বুঝেছে তাই বোঝাতে চেষ্টা করছে হাসিতে। কী সুন্দর হাসিটা!
ফেরার পথে ভাবি, হবে। একদিন আমাদের দেশেও এরকম সুবিধাসম্পন্ন সী বিচ বা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। আমরাই করবো। স্বপ্ন দেখতে পারলে বাস্তবেও সম্ভব। অপরাধীদের নির্বাসনস্থল অস্ট্রেলিয়া যদি ২৫০ বছরে পরিবর্তন হতে পারে, আমরা কেন নয়?
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )