Detail

Home - সাহিত্যকর্ম - সাপ ও আমি

সাপ ও আমি

১.

ব্রিসবেনে গ্রিফিথ ইউনিভারসিটিতে সারাদিন গবেষণার কাজ করি।দিনশেষে ক্লান্ত বদনে সন্ধ্যায় বের হই।যথারীতি একদিন বের হয়ে ইন্টারক্যাম্পাস বাসে করে দু ক্যাম্পাসের মাঝে নামি। সেখানে গাড়ি রাখা। বাস থেকে নেমে গাড়ির দিকে যাচ্ছি। সাথে একজন পিএইচডি সহপাঠী। ছোট জংগলের পাশ দিয়ে ২০০ মিটার হাঁটলেই গাড়ি। নিশ্চিন্তে দুজনে একাডেমিক আলাপচারিতায় হাঁটছি। হঠাৎ দেখি পায়ের কাছে লম্বা লাঠির মতো। মুহূর্তের মধ্যে ভালো করে চোখ ফেলে খেয়াল করলাম। দেখি কু্ন্ডলী পাকিয়ে ফণা ধরা সাপের মাথা । সাপ সাপ বলে চিৎকার করে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়লাম।সাথে সাথে সহকর্মীও লাফ দিল। বিদেশী সাপ তাই নামও জানি না। পরে সাপের আলাপ করতে করতে গাড়িতে উঠি। গাড়ীতে উঠেই লাইট জ্বেলে নিলাম। মনের অজান্তেই গাড়ির কোণাকাঞ্চি দেখে স্টিয়ারিং ধরে নিয়ে বসলাম।অন্ধকার ঘরের সবজায়গায়ই অগণিত সাপ আছে বলে মনে হয়! অস্ট্রেলিয়াতে সাপের ঘটনা নিত্তনৈমিত্তিক। সারাদেশ বনে জঙ্গলে সাপের কারখানা। বর্ষাকালে অনেকেই পথে ঘাটে সাপের দেখা পায়। তাই সাপের গল্প হেথায় মুখে মুখে ফিরে।

২.

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি আর জহুরুল হক হলে থাকি। এক্সটেনশানের ১০১৬ নম্বর কক্ষ। বর্ষাকাল। যথারীতি একদিন সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পাশেই টয়লেটে যাই। অভ্যাসবশতঃ চোখ বন্ধ করে কর্ম সারছি।কী মনে করে হঠাৎ চোখ মেলে কমোডে তাকাই। দেখি কমোডে কুন্ডলী পাকিয়ে সাপটি বসা মাথা উঁচিয়ে; যার উপরে আমি কর্ম সারছি! চিৎকার করে আত্মারাম ছাড়া কীভাবে সেদিন বের হয়েছিলাম বলতে পারি না।বুকের ধরফর বন্ধ হতে সময় লেগেছিল। আমার চিৎকার শুনে অন্য বন্ধুরা আসে। পরে রুম থেকে লাঠি নিয়ে গিয়ে সাপটি মেরেছিলাম সবে মিলে। এরপরে প্রায় একটি বছর বাথরুমে গেলেই কল্পনায় সাপ দেখতে পেতাম!

৩.

মা আর দাদুর মুখে পঙ্খীরাজ সাপের গল্প অনেক শুনেছি। সেসব আধা বিশ্বাস করি আধা করি না।এরই মধ্যে গ্রামে বন্ধুদের নিয়ে একদিন বিকেলে উঠানে খেলছি। দশ বারো জন ছেলে মেয়ে দু’দলে ভাগ করে গোল্লাছুট খেলছি। খেলার মাঝখানে কার যেন চিৎকার শুনে সবাই উপরে তাকাই। দেখি একটি লম্বা সাপ মাথার অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।সে কী ক্ষিপ্র গতি আর ঢেউ খেলানো উড়াল! ভাবাই যায় না!  সবার চেহারা উৎকন্ঠা আর ভয়ে নীল হয়ে গিয়েছিল।সবার চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল। বড়রাও দৌড়ে এসে দেখেছিল। সাপটি পাশের একটি বড় নারকেল গাছ থেকে উড়াল দিয়ে কয়েকটি ঘর পেরিয়ে পাশের কবর স্থানের কাঠাল গাছের দিকে গিয়েছিল। তারপর থেকে পঙ্খীরাজ সাপ বিষয়ে সন্দেহ কমে গিয়েছিল।

৪. আহসান হাবীবের ইচ্ছে কবিতাটি অনেকেই পড়ে থাকবেন। ”মনা রে মনা কোথায় যাস/ বিলের ধারে কাটবো ঘাস/ঘাস কি হবে? বেচব কাল/চিকন সুতোর কিনব জাল….”। তো ঘাস বেচা বা জাল কেনার বিষয় আমার ছিলো না। এমনি শখে শখে একদিন বাড়ির গরুর জন্য ঘাস কাটতে বিলে গেছি।বিলের নাম ফাটাবিল।নবীনগর শহর থেকে কুটি বাজারের দিকে তাকালে যে বিশাল বিস্তীর্ণ বিল দেখা যায়; এ বিল তারই অংশ। ধান ক্ষেতের আইলে ঘন বাড়ন্ত ঘাস। দেখেই বসে গেলাম।বাম হাত দিয়ে মুঠিয়ে মুঠিয়ে ঘাস ধরি আর ডান হাতে কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটি। এভাবে আপন মনে ঘাস কেটে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি একটি সাপের শরীর কেটে ফেলেছি! সাপের রক্তাক্ত লম্বা বড়ি ও লেজ গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাম হাতে তাকিয়ে দেখি আমার হাতে সাপের মাথাটা ঘাসের সঙ্গে ধরা। হাতের চিপায় আর শরীরের ব্যথায় রাগে সাপের মুখ হা করে আছে।কামড় দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা! কাস্তে আর ঘাসসহ সাপের মাথা ফেলে এমন দৌড় দিয়েছিলাম যে বুকের ভিতর পানি ছিলো না! পরে অনেকদিন আর ঘাস কাটার নাম নেইনি! সাপটির জন্য আমার অনেকদিন কষ্ট হয়েছিল। ভাবতাম এভাবে না দেখে কেটে ফেলা ঠিক হয়নাই। আবার একধরণের বীরত্বও মনে মনে ছিল! এইটুকু ছেলে আমি সাপ কেটে ফেলেছি!

৫. গ্রামে বর্ষাকালে বিলের জমিতে বন্যার তুড়ে কচুড়িপানা জমে। তাই জমির ওসব কচুরিপানা পরিস্কার করতে হয়। নতুন করে চাষাবাদ শুরু করার জন্য। তো আমার মামা আমাকে নিয়ে মেলাবন বিলে গেলেন। আমিও খুশি মনে গেলাম। হাঁটু সমান, বুক সমান পানিতে দেড় কিলোমিটার পানিপথ পেরিয়ে নির্দিষ্ট জমিতে পৌঁছলাম।জমিতে আমার বুক সমান পানি। মামা কচুরিপানা কয়েকটি ধরে ধরে একসাথে স্তুপ করে রাখবেন। তো শুরু হলো। ওমা! কচুরিপানায় হাত দিলেই লাল রঙের জলপুরা সাপ ফণা ধরে তেড়ে আসে। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যায়। প্রতিমিনিটেই একটি সাপ! এ যেন সাপের আস্তানা বা কারখানা। মামার অনেক সাহস। কোন টা মারে কোন টা পানিতে ডুব দিয়ে চলে যায়। এভাবেই চলছে। বিশাল জমি। পুরোটা পরিস্কার করতে হবে। সাথে আরো কয়জন দিনমজুর ছিলো। তাঁদের নাম এখন আর মনে নেই। মামা শুধু বলে কিচ্ছু হবে না। আমি কচুরিপানায় হাত দেয়ার সময় এক কদম আগাই তিন কদম পেছাই। মামা আমায় ধমক দেন। ভীতু বা আকাইম্যা বলে তিরস্কার করেন। আমিও নিজেকে ভীতু ভেবেছিলাম। সবাই পারছে। আমি কেন শুধু শুধু ভয় পাচ্ছি। এরপরেও জোর করেই কচুরিপানা পরিস্কারের কাজ চালিয়ে গেছিলাম।ভয়ে আমার কালো চেহারা নীল বর্ণ না হয়ে আরো কালো হয়ে গিয়েছিল। অনেক সাপই ওদিন আমার সামনে ফণা ধরেছে। দিনমজুররাসহ মামা কতটি সাপ মেরেছে মনে নেই। মামাসহ সবাই হয়তো বিষয়টি ভুলে গেছে। কিন্তু আমি এরপর কয়েকরাত ঘুমাতে পারিনি। ঘুমালেই দেখতাম আমার চারপাশে জলপুরা লালচে সাপ। ফণা ধরে কামড় দেয়ার জন্য আমায় তাড়া করছে। বিষয়টি শিশু-মনোবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে দেখলে অনেক বড় বিষয়। মোটেই আমার ওখানে অবস্থান করা ঠিক হয়নি। তবে গ্রামে এসব ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। আমিও তাই বিশ্বাস করতাম। তাই নিজেকে অনেক বকেছি মনে মনে নিজের অতিশয় ভীরুতার জন্য।

৬। মেটে বা দোড়া সাপের ঘটনা শতশত। মেটে বা দোড়া সাপকে আমরা পাত্তা দিতাম না। মেটে সাপ তো খেলার জন্য প্রিয় ছিল। মেটে সাপের লেজ ধরে ইচ্ছামতো চরকির মতো ঘুরাতাম।ঘুরানোর সময় মেটে সাপের মেরুদন্ডে গাইট ছাড়ার আওয়াজ হতো। ঘুরাতে ঘুরাতে মেটে সাপ আরেকটু লম্বা হতো। তারপর ঘুরানোর মাঝে চরম গতির সময় হঠাৎ ছেড়ে দিতাম। যারটা যত দূরে যেতো সে তত জয়ী হতো।কারো খেলা কারো কষ্টের কারণ তা তখন বুঝিনি। দোড়া সাপে বিষ না থাকলেও কামড় দেয়। বিষ নেই তাই দোড়া সাপ মারতাম না। শখের বসে মাছ ধরার জন্য কইয়া জাল (কই মাছ ধরার জন্য মাঝারি/ছোট ছিদ্রের জাল) পাতলে দোড়া সাপ জালে প্যাচিয়ে থাকতো। জাল কেটে কেটে সাপ ফেলতে হতো। আন্তা (বেতের তৈরি মাছ ধরার ফাঁদ) পানিতে পাতলে মাঝে মাঝে দোড়া সাপ আন্তায় ঢুকে যেতো। আন্তার সব মাছ মাছ খেয়ে দোড়া সাপের পেট ফুলে থাকতো। তখন মাছ কেন খেয়ে ফেললো এজন্য দোড়া সাপকে মাটিতে ফেলে ইচ্ছামতো পেটাতাম।মরে যাওয়ার পরেও পেটাতাম! না জেনে কত পাপ করেছি কে জানে!

হে দোড়া সাপ/মেটে সাপ সকল, আমাকে মাফ করে দাও! প্রাণী হত্যা মহাপাপ বা প্রাণীকে কষ্ট দেয়া অন্যায় এসব বুঝে উঠার আগেই এসব ভুল করে ফেলেছিলাম।

৭. স্বপ্নে সাপ দেখা আর স্বপ্নের তাবির করে শত্রু চিহ্নিত করা ছিলো আমার মনোজগতের আরেকটি কাজ। জীবনে অনেক বার স্বপ্নে অনেক বার বিভিন্ন রকম সাপ নানা পর্যায়ে স্বপ্নে দেখেছি। পরে আশেপাশের অনেককে নিজের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছি। জীবনের এ বেলায় এসে দেখি ওসব স্বপ্নের তাবির আর শত্রু চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া সব ভুল ছিল। যাদেরকে শত্রু চিহ্নিত করেছিলাম, তাঁদের কেউ শত্রু ছিল না। সমসাময়িক কিছু ইস্যু নিয়ে হয়তো নিজস্ব ভাবনা জগত ছিল যা থেকে স্বপ্নের তাবির আর উপসংহার টেনেছিলাম। এ জীবনে সবাইকে বন্ধু হিসেবেই পেয়েছি। শত্রু হিসেবে কাউকে দেখি না!  যদিও অনেকে বলে সাপের বিষের চেয়ে মানব-বিষ আরো বিষাক্ত- আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না!

সাপ নিয়ে আমার আরো অনেক ভয়াবহ ঘটনাবলী আছে। এসব ঘটনা আর আমার সাথে ঘটা সাপুড়ে আর বেদেদের সাপফাঁকির গল্পও অন্যদিন অন্য কোথাও করা যাবে!

ভয় পেয়েছেন? আপনার পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখেন, একটি সাপ বসে আছে!

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart