কেন ‘স্যার’ ডাকবেন এবং কেন ডাকবেননা: পক্ষে বিপক্ষের যুক্তি-কুযুক্তির বাইরের সারকথা।
১। চাকুরির শুরুর দিকের কথা। আমি প্রবেশনার সহকারি কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট। মাদারীপুর জেলায়। এক ছুটির দিনে জেলা প্রশাসক স্যার আমাকে মোবাইলে ফোন দিয়েছে। আমি ফোন ধরেই সালাম দিয়েছি স্যারসহ। আসসালামু আলাইকুম স্যার। এরপর যত কথা বললেন ও নির্দেশনা দিলেন তার সাথে আমিও বলে গেছি, ইয়েস স্যার, আচ্ছা স্যার, জ্বী স্যার, স্যার ওই বিষয়টা, স্যার ওটা এভাবে, স্যার সেটা সেভাবে, …..স্যার….স্যার। মানে প্রায় প্রতিবাক্যেই স্যার বলে গেছি। বাসায় নতুন বউ। সে আবার আঙ্গুলের গাইটে গুনে যাচ্ছে আমি কতবার ‘স্যার‘ বলি। সেটা আমি খেয়াল করিনি। কথা শেষ হলে বউ আমাকে বলে তুমি এ কয়েক মিনিটের কথায় প্রায় শতবার ‘স্যার‘ বলেছো! বুঝেন অবস্থা অপ্রস্তুত চেহারা লাল হয়ে গেলো। (বলা ভালো কালো চামড়ার চেহারা আরও কালো হয়ে গেলো)।
২। ইংরেজি স্যার শব্দটা বারোশ শতাব্দী থেকেই ব্যবহার হয় ইংল্যান্ড, জার্মানী, ফেঞ্চসহ বেশ কয়েকটি এলাকায়। তবে পূর্বে এটি ছিল ‘Sire’। ম্যাডামও স্যার এর মতো ব্যবহৃত হতো যা Madame হতে এসেছে । কমনওয়েলথভূক্ত দেশগুলো এখনো এর ব্যবহার করে। স্যার, মাইলর্ড, হুজুর, ধর্মাবতার- এই সম্মানসূচক অনুষঙ্গগুলো প্রশাসনিক কাজের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল সেই ঔপনিবেশিক সময়ে অর্থাৎ ইংরেজরা যখন প্রথম ভারতবর্ষে আসে। তবে এসব শব্দের উদ্ভব হয় ইউরোপে সেই সামন্ত যুগে। ‘স্যার’ শব্দের উৎপত্তি ফরাসি দেশে, সেখানে জমিদার বা সামন্ত প্রভুদের প্রজারা সম্বোধন করত ‘স্যায়ার’ বলে, সেই ‘স্যায়ার’ শব্দটি কালক্রমে বারোশ শতকের দিকে ঢুকে পড়ে ইংরেজি ভাষায়। অনেকে বলে থাকেন যে পৃথিবীতে সামন্ত ও ঔপনিবেশিকতার যুগ শেষ হলেও সেসব যুগের ভূতগুলো এখনো চেপে আছে আমাদের ঘাড়ে। কিছুটা প্রয়োজনে আর কিছুটা অপ্রয়োজনে।
৩। প্রবাসে কেউ কাউকে স্যার ডাকতে হয়না- এটা অনেকেই সরলভাবে বলেন। এটা যেমন সত্য তেমনি সবাই সবাইকে স্যার ডাকে এটাও সত্য। বিদেশে স্যার ডাক এস্পেক্ট করেনা সত্য। কিন্তু স্যার কেউ ডাকেনা তা সত্য নয়। ইয়েস স্যার শব্দগুচ্ছের অনেক মানে আছে ইংরেজি ভাষায়। সম্মান করে বলে ইয়েস স্যার, কেউ ভদ্রতা করে বলে ইয়েস স্যার, কেউ ফরমালিটি মেনটেন করত বলে ইয়েস স্যার। এগুলো আমরা জানি। কিন্তু এর বাইরেও স্যারের ব্যবহার আছে। কেউ কাউকে ঠ্যাশ দিতেও বলে ইয়েস স্যার, কেউ উইট করতেও বলে ইয়েস স্যার, কেউ ফান করতেও বলে ইয়েস স্যার, কেউ বন্ধুর কথায় সহমত প্রকাশেও বলে ইয়েস স্যার, কেউ কোন কিছুতে খুশি হয়েও বলে ইয়েস স্যার, কোনকিছু বাছাই বা পছন্দ করতে বলে ইয়েস স্যার, কেউ বিরক্ত হয়েও বলে স্যার। যেমন রাস্তা দিয়ে আপনি হাঁটছেন। ধাক্কা দিলো কেউ এবং ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে নির্বিকারে। তখন আপনি বললেন ‘এক্সকিউজ মি স্যার!। এখানে স্যার ডাকা মানে সম্মান করা নয়, বরং বিরক্তি প্রকাশ করা ও মনোযোগ আকর্ষণ করা। এরকম উপরের প্রতিটি একজাম্পল দেওয়া যাবে।
৪। অনেকে বিষয়টার সহজ সুরাহা করেন। স্যার মানেতো জনাব। জনাব বলতে পারলে স্যার বলতে সমস্যা কোথায়? টিচারদের তো আমরা স্যার বলি তখন কি জনাব অর্থে বলি? কিংবা সব টিচারকে কি সমান অর্থে স্যার বলি? যদিও সব টিচারকে স্যার বলি সবসময় সকলের ক্ষেত্রে স্যার বলার মানে বা ধরণ বা অভিব্যক্তি এক হয়না। কোথাও অনেক রেসপ্কেট থাকে, কোথাও হালকা, কোথাও বলি ভয়ে, কোথাও বলি ঠেলায়। জনাব বলতে পারলে স্যার ডাকতে সমস্যা কোথায়? জনাব অর্থেই স্যার ডাকেন। জনাবই ডাকতে হবে কেন? চেয়ারকে কেদারা যেজন্য বলিনা, সেজন্যই স্যারকেও জনাব বলার কোন কারণ দেখিনা।
৫। বয়স বেশি হলেই বয়সে ছোট কাউকে স্যার বলা যাবেনা। এটাও একটা থাওহা যুক্তি সরল উপসংহার। স্যারের সাথে বয়সের কোন সম্পর্ক নেই। স্যার বয়সে বড়রাও বয়সে ছোটকে ডাকতে পারেন। যদি কেউ নিজেকে বড় মনে করে বা সিনিয়র মনে করে বা হোমড়া চোমড়া মনে করে এবং কোন স্যারকে স্যার ডাকতে না চান তবে তিনি তার পদের নাম নিয়ে বলতে পারেন যেমন এএসপি সাহেব, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, এসিল্যান্ড সাহেব। কোনভাবেই ভাই, মামা, খালু ডাকার সুযোগ নেই। ভাই ভাই হয়ে গেলে প্রশাসনিক শৃংখলা বজায় রেখে সেবা প্রদান ও শান্তি শৃংখলা রক্ষা সম্ভব না।
প্রধানমন্ত্রীকে ভাই বা আপা ডাকা যায়, রাজনৈতিক কারণে। রাজনৈতিক সম্পর্ক আর প্রশাসনিক সম্পর্ক আলাদা। প্রশাসনিক সিস্টেমে ভাই বন্ধু ডাকার সুযোগ নেই। বড়জোর পদের নামে সাহেব যোগ করে ডাকতে পারে। আনুষ্ঠানিক সম্বোধন।
৬। ব্রিটিশরা স্যার শুনতে চাইতো এখনো এটার বহাল আছে বাহিনীতে প্রশাসনে। তবে আগের মতো স্যার মানে ‘আমি তোমার দাস‘ এ মনোভাব বা অর্থ বহাল নেই।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এক লোক জয়েন করতে এসেছে। অফিসার প্রশ্ন করছেন‘ আপনার নাম কি?
লোকটি বললো স্টিফেন বেটন।
এসব ঢিলে আচরণ চলবেনা। এখানে অফিসারের প্রশ্নের জবাবে সবসময় স্যার বলতে হবে।
তারপর লোকটি বললো
ইয়েস স্যার, রাইট স্যার। মাই নেইম স্যার স্টিফেন বেটন।
৭। দু‘ধরণের লোকই ঝামেলার। এক. যারা স্যার ডাক শোনার জন্য জোর করেন তাঁরা ‘স্যার-অংশটুকু‘ ছাড়া নিজেদেরকে শূন্য মনে করেন। স্যার না ডাকলে নিজের সব শেষ হয়ে গেলো বলে হায় হায় করে উঠেন।
দুই. যারা গায়ের জোরে স্যার ডাকতে চাননা। তারা হয় নিজেরাই স্যার হয়ে বসে আছেন কিংবা স্যার হতে চেয়েছিলেন জীবনের খেলায় আর স্যার হতে পারেননি। তাই কোন স্যারকেও স্যার ডাকতে তাঁদের অনেক অনীহা ও জ্বালা।
স্যার ডাকলেই আমি ছোট হয়ে যাবো- এমন ভাবনা যাদের মনে তাঁরা নিজেরাই নিজের চিন্তায় ছোট হয়ে বসে আছেন। নিজেকে যে ছোট করে ভাবে তাকে অন্য কেউ বড় করতে পারেনা। হীনমন্যতায় ভুগে নিজেই আত্মহত্যা করেন প্রতিনিয়ত। উপযুক্ত স্থানে স্যারও ডাকবেন আবার নিজের অবস্থানও বজায় থাকবে-সেটা ভাবা ও এর যথোপযুক্ত মনোভাব, প্রকাশ ও অভিব্যক্তিতে রাখাও জরুরি। আবার স্থান কাল পাত্র ভেদে স্যার না ডেকেও ফরমাল সম্বোধন এমনভাবে করতে পারেন যাতে করে কোন স্যার বুঝতেই না পারেন যে অবহেলা করা হচ্ছে বা অসম্মান করা হচ্ছে বা স্যার ডাকা হচ্ছেনা। সেটাও বলার ভঙ্গি, ও অভিব্যক্তির প্রকাশও স্থান কাল পাত্র বোঝার সাথে সম্পর্ক।
৮। কর্মস্থলে অফিসিয়াল পরিবেশ রক্ষায় স্যার ডাকা বা ফরমাল সম্বোধন বজায় রাখাই সমীচীন। কিন্তু তাই বলে সারা দেশে আমাকে স্যার ডাকতে এটা আবার বাড়াবাড়ি। আমি সাবেক এক আমলাকে জানি যিনি বড় আমলা ছিলেন পরে এমপি ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি নিজ এলাকাতেও ভোটারদের কাছে স্যার ডাক আশা করেন। এটাও বাড়াবাড়ি কর্মস্থলের বাইরে মানুষ ব্যক্তিগত সম্পর্কের হিসেবে ডাকবেন বা কথা বলবেন। যেথায় যা প্রযোজ্য।
আবার আরেকটা মজার কেইস দেখেছি। জেলা পর্যায়ে এক অফিসার জেলা প্রশাসককে স্যার ডাকবেনা। তাতে তার নাকি প্রেস্টিজ চলে যাবে। কয়েকবছর পরে সে অফিসারকে দেখলাম অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র সহকারি সচিবকে স্যার স্যার ডেকে মুখে ফেনা তুলতেছেন। কারণ কি? কারণ হলো এখন তিনি যে প্রজেক্টের দায়িত্বে সে প্রজেজ্টের অর্থ ছাড়করণ ফাইলটি এখন সে জুনিয়র অফিসারের টেবিলে। এরকম দ্বিমুখী আচরণ হলে তো সমস্যা। সুবিধামতো স্যার ডাকার কোন সুযোগ নেই। ফরমাল রিলেশনে যতটুকু প্রযোজ্য ততটুকু মেনেই স্যার ডাকা উচিত।
৯। সমাজের সব ক্লাস বিদ্যমান। সব ক্লাস বজায় রেখে শুধু দেশের স্যারদের স্যার উঠিয়ে দিতে গেলে সেটা ধুপে টিকবেনা। সামাজিক সকল ক্লাস ধীরে ধীরে ভাঙতে হবে। তবে এটিও দিনে দিনে উঠে যাবে। উন্নত বিশ্বে স্যার ডাকতে হয়না বলে আমরা ডাকবোনা- এ উপসংহার অর্ধেক বোঝা উপসংহার। উনারা স্যার না ডাকলেও সম্মান করতে বা ফরমাল রিলেশন রক্ষায় পিছপা হননা। আমাদের উপমহাদেশে ভাই ডাকতে দিলে কাঁধে হাত দিয়ে বসে থাকবে। আইনের বাস্তবায়ন আর সম্ভব হবেনা। বিদেশে বাবা-মারা বাচ্চাদের ১৮ এর পরে ঘর থেকে বের দেন আমরা দেইনা, বিদেশে বৃদ্ধ বয়সে বাবামাকে দেখেননা, আমরা দেখি, বিদেশে মুরব্বীদের মানা হয়না, আমরা মানি। যেসব জিনিস শৃংখলা রক্ষায় চলমান আছে তার বহাল রাখাই সমীচীন। বিদেশের কোন কিছু আমলে নেওয়ার আগে আমাদের প্রেক্ষাপটে তা কতটা ফলপ্রসূ তা ভেবে নেওয়া জরুরি। শুধু কপি পেস্ট করলেই হবেনা। সাথে বদহজমের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
১০। “Sir ডাকবোনা”এ জেদটা “স্যার ডাকতে হবে” জেদের চেয়ে খারাপ। সম্মান করে কিংবা অবজেকটিভলি স্যার ডাকতে সমস্যা নেই। সিস্টেম হারমোনাইজড রাখতে স্যার ডাকের প্রচলন রাখাও দোষের নয়।
বিষয়টি খুব ইজি। স্যার ডাকা একটা সাধারণ কাজ।স্যার ডাকা বাদ দিতে হবে এ স্লোগান হঠাৎ করে ভাবনার ফসল। পারিপার্শিক সব বিবেচনায় নিলে , স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় নিলে, ভাষা ও শব্দের অর্থ ও লিগ্যাসি আমলে নিলে স্যার ডাকা যথাস্থানে অবশ্যই সমীচীন।
আমি রাজা তুমি প্রজা কিংবা আমি আকাশ তুমি মাটি এ অহমিকা নিয়ে স্যার ডাকতে বলা নিন্দনীয়। কিন্তু ফরমাল রিলেশন রক্ষায় স্যার ডাকার প্রচলন রাখা স্বাভাবিক । ব্রিটিশরা স্যার ডাকটা ইউজ করে অবজেকটিভলি , সম্পর্কের দূরত্ব বোঝাতে, ফরমলিটি রক্ষায়। প্রশাসন বা বাহিনীতে সিস্টেম ফলো করা হয়। তারা আমজনতার ভাই হয়ে গেলে আইন মানানো বা প্রতিষ্ঠান রক্ষা অসম্ভব। প্রশাসনে বা বাহিনীতে নিজেদের স্বার্থে এটা করেনা। বরং প্রতিষ্ঠানিক শৃংখলা রক্ষায় তা করে। এমনকি সার্ভিসের মধ্যেও নিজেদের মধ্যে তা রক্ষা করে।
আবারও বলছি স্থান কাল পাত্র বিষয় পারিপার্শিকতা বিবেচনা জরুরি। শর্টকাট উপসংহারের সুযোগ নেই।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )