তুচ্ছ অনৈতিকতাটি কি আসলেই তুচ্ছ?: প্রসঙ্গ: স্কুল ম্যানেজিং কমিটি
অনৈতিকতা হলো অনৈতিকতা। এ আবার তুচ্ছ হয় কী করে? হক কথা। কোন অনৈতিকতাই তুচ্ছ নয়। কঠিন বাস্তবতা হলো চারপাশে আমরা যেভাবে নির্বিকার আছি তাতে এটা স্পষ্ট যে গুরুতর অনৈতিকতাকেও আমরা হালকাভাবে নিচ্ছি। গা করছিনা। তুচ্ছজ্ঞান করছি। প্রশ্ন হলো আসলেই কি তা তুচ্ছ? গ্রামের স্কুলগুলোতে ম্যানেজিং কমিটি স্থানীয়ভাবে করা হয়েছে। কারণ স্থানীয়রাই স্থানীয় সমস্যা ভালো বোঝেন। তাঁরা এ স্কুলে পড়েছেন। তাই তাঁরা স্কুলকে বেশি ভালোবাসেন। তাঁদের দ্বারাই স্কুল উন্নত হবে। স্থানীয়দের সন্তানরা স্কুলে পড়ে।সুতরাং তাঁরা নিজের সন্তানের ভালোর জন্য শিক্ষার মান বাড়াবেন। এটাই সঙ্গত। তাঁরা এলাকার মাতব্বর, রাজনীতিবিদ, সর্দার, জনপ্রতিনিধি।তাঁরাই মা-বাপ। তাঁরা স্কুল এলাকার অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো বোঝেন। তাঁরাই হবেন হর্তাকর্তা। কোথা না কোথা থেকে আমলারা আসেন। তাঁদের দ্বারা স্কুল পরিচালনা অসম্ভব! বড়ই যৌক্তিক কথা। সরকার বাহাদূর ভাবলো স্থানীয় লোকজনকে দায়িত্ব দেয়া উত্তম।সোশ্যাল ক্যাপিটালের যথার্থ ব্যবহার হবে। এবং তাঁরা লোকাল রির্সোসের কাম্য ব্যবহার করে স্কুলের উন্নয়ন করবেন। সরকারের খবরদারি কম হলেও চলবে বা বরাদ্দ কম দিলেও হবে।
কিন্তু বাস্তবতা বড় রুঢ়। এসব কমিটির লোকেরা গাছেরটাও খান তলারটাও কুড়ান। অর্থাৎ সরকার যদি কোন বরাদ্দ দেয় (যেমন-নতুন ভবন নির্মান, বিজ্ঞানাগার সামগ্রী, টিআর, কাবিখা, এডিপি) সেটাতে তাঁরা ভাগ বসান এবং আবার স্থানীয় সংগ্রহ থেকেও (পরীক্ষার ফি, ভর্তি ফি, এডমিট ফি, ফরম ফিলাপ ফি) হিস্যা বোঝে নেন।সরকারি প্রকল্পের কাজকে নিজস্ব ফান্ডের কাজ দেখিয়ে টাকা উঠান এবং ভাইস ভার্সা। কাজের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে আত্মসাৎ যাকে বলে। স্কুলের পুকুর ইজারা, দোকান ভাড়া দেয়া, মার্কেট সেল দেয়া, ভুমির সীমানা মেপে দেয়া…..আরও কত কী! দালালীর খাত অনেক। বলে শেষ করা যাবেনা।এটা বড় সমস্যা না। কারণ এতে আর্থিক ক্ষতি হলেও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি কম। বড় সমস্যা হলো শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ।যদিও শিক্ষক নিয়োগ কমিটি রয়েছে, নিয়োগ কমিটি যাকেই প্রথম নির্বাচন করুকনা কেন স্থানীয় এসএমসি শিক্ষক নিয়োগে প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয়কে নিয়োগ দিবেননা। পেছনের সারি থেকে নিয়োগ দিবেন।তাহলে হিসেব মিলে ভালো। কী করবে পাঁচে, টানে দশে! যার থেকে বেশি পাওয়া যায় তাঁর নিয়োগ কনফার্ম।প্রথমকে বাদ দেয়ার জন্য হেন কোন অজুহাত নেই যে তাঁরা দেননা, এমন কোন ছল নেই তাঁরা নেননা। যেমন রাজনৈতিক পরিচয়, মূদ্রা দোষ, নারী বিষয়ক অপবাদ থেকে শুরু করে কী বিষয় নয়? কন্সপাইরেসি থিওরী সব তাঁদের মূখস্ত। পঁচা মাল নিয়োগ দিলে যে সে ত্রিশ বছর ধরে পঁচা প্রডাকশন উপহার দিবে তা তাঁরা ভুলে যান।জাম বপন করেতো আর আঙ্গুর পাওয়া যাবেনা। কী ভয়ঙ্কর কাজটি তাঁরা করছেন তা বোঝেও না বোঝার ভান করেন। কমিটির সদস্যরা নিজেকে অনেক ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। স্কুল ড্রপ আউট কেন বাড়ছে বা শিক্ষার মান কেন কমছে তা নিয়ে তাঁদের মাথা ব্যথা নেই। কোন শিক্ষক সালাম দিলোনা, কোন মিলাদে দাওয়াত মিললোনা, কোন অনুষ্ঠানের কার্ড পেলোনা, কোন সাবকমিটিতে নাম থাকলোনা ইত্যাকার বিষয় নিয়ে প্যানর প্যানর, ঘ্যানর ঘ্যানর, হুমকী ধামকী চলতেই থাকে।ক্লাশে স্থান সঙ্কুলান না হলেও বা শিক্ষক পর্যাপ্ত না থাকলেও ছাত্র ভর্তি করতে হবে, টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করলেও ফরম ফিলাপ করতে হবে।ইত্যাকার নানা ইস্যু নিয়ে তাঁদের ব্যবসার শেষ নেই। সভাপতি মহোদয় নিজে কী দিলেন তাঁর চেয়েও বেশি ব্যাস্ত কী পেলেন তা নিয়ে।অনেক সভাপতি আবার ঢাকায় বসে বসে সভাপতিগিরি করেন। স্কুল দেখার সময় কই! প্রধান শিক্ষক বেচারা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচিঁ অবস্থা। কোন কোন ক্ষেত্রে মিলেমিশে একাকার। সোনায় সোহাগা। ভাগাভাগি কাড়িকাড়ি! অন্যান্য শিক্ষকদের অবস্থাতো ত্রাহি ত্রাহি।কমিটিরি সদস্যরা শিক্ষকদের বিভাজিত করে বিভিন্ন খেলা খেলে। শিক্ষকদের বিভক্ত করে শিক্ষকদের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে আরাম করে খায় কমিটির সদস্যরা। দেখার মতো দৃশ্য বটে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল থিওরী কার্যকরভাবে ব্যাপ্ত সকল খানে সবসময়।খেলারাম খেলে যা! সকল কমিটি সমান নয়। অনেক ভালো কমিটিও রয়েছে।অনেক ভালো সভাপতিও আছে। নিজের পকেটের টাকা দেন, সময় দেন। ভালো কাজ করেন। যেমন কোন কোন স্কুলে নিজস্ব ফান্ড থেকে বছরে ৫-২০ লক্ষ টাকার উন্নয়ন কাজ হয়। এগুলি ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারেনা। কোন কোন স্কুলে প্রতি বছরই টানাটানি। আবার একই স্কুলে এক কমিটির আমলে অনেক উন্নয়ন অন্য কমিটির আমলে লোকসান গুনে। ভিলেজ লেভেল সোশিও-পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টালিজম যেখানে শক্ত সেখানে কারো কোন ক্ষমতা নেই এসব বিষয়ে কথা বলে।
মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগতো অসহায়। নখরবিহীন ব্যাঘ্র।যদিও দুয়েক ক্ষেত্রে বেতন বন্ধ বা এমপিও বন্ধের প্রক্রিয়া করা হয় তা আবার কিছুদিনের মধ্যেই অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায়। মাঝখানে যারা নিয়ম মানানোর চেষ্টা করেন তাঁরা ভিকটিম হন। যে লাউ সে কদু। একটি উপায় ছিলো নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি চেঞ্জ করা। কিন্তু সরকার সব বিষয়ে উপদেষ্টা নিয়োগ করে রেখেছে।উপদেষ্টা মহোদয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সভাপতি হওয়া প্রায় অসম্ভব। এত বিষয়ে দ্বিমত বিভেদ থাকলেও একটি বিষয়ে সবাই একমত।অভিভাবক, শিক্ষক, কমিটির সদস্য সব। সকল ছাত্রকে যে কোন উপায়ে এ প্লাস পাওয়াতে হবে। এ বিষয়ে সকলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন।এ জন্য নকল সাপ্লাই, সিট প্ল্যনিং, পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষককে জিম্মি সকল অপকর্ম বাস্তবায়ন করেন।কোন জটিলতা নেই!! আমরা সবাই রাজা! অসহায়ত্বের দিক হলো যারা এসব করছে তাদের কারণে প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে পড়ছে। ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানের শিকার হয়ে এ থেকে আবর্জনা (কুলাঙ্গার ছাত্র) বেরুচ্ছে। এ আবর্জনারাই আমাদের বা এসএমসির সদস্যদের সন্তানদের, নাতি নাতনীদের ভবিষ্যত স্কুলে নেতৃত্ব দেবে। এসএমসির সদস্যদের সৃষ্ট আগুনে আমাদেরসহ এসএমসির সদস্যদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুড়বে।
এ শক্তি যে দুর্গম! তবে তা মহাশক্তি নয়। এ হলো অশুভ শক্তি।এর সাথে সম্পৃক্ত সকল ক্লায়েন্টদের মধ্যে একটা নিবিড় যোগ আছে। তাঁদের বোঝানো কঠিন। তাঁদের আরও ভাবা উচিত। যে জাতি চিন্তা করে কাজ করেনা তার চিন্তাশক্তি ক্রমশ বিকৃত হয়ে যায়; যে জাতি কেবল কার্য করে চিন্তা করেনা তার কার্যকরিতা নিষ্ফল হতে থাকে।তাঁদের উপর সরকার যে গুরু দায়িত্ব দিয়েছে তা কি তারা হৃদি দিয়ে অনুভব করেছে? কর্তব্যজ্ঞান ও কর্তব্যপালনের মাহাত্ম্য অবিসম্বাদিত। ক্ষমতাবানের এটা মূল ভিত্তি হওয়া উচিত। কর্তব্য অনুভব করে কর্তব্য পালন শুধু মানুষ-জীবই করে, পশু বা কীটপতঙ্গ নয়।মনে রাখা জরুরী, ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্ব আবশ্যক।যে ক্ষমতা স্কুল কমিটি পেয়েছে তা রাজনৈতিক হোক বা সামাজিক হোক তা কলুষিত হতে দেয়া উচিত নয়।পরার্থপরতায় বা জনসাধারণের হিতার্থে ত্যাগ করাই “পাবলিক লাইফ” বা রাজনৈতিক জীবন।সে জীবন সর্বদা সংযত ও সমুন্নত রাখা প্রয়োজন।আশঙ্কা হচ্ছে, ক্ষেত্র অদ্যপি প্রস্তুত হয়নি। প্রকৃত প্রজামূখী পলিটিক্স বা আমলাতন্ত্র বা সমাজ-ব্যবস্থা এখনো আমাদের অত্যন্ত অভাব। এটা আমাদের রক্ত মাংসে মেদ মজ্জায় মিশেনি।তা না হওয়া পর্যন্ত আলোর দেখা পাওয়া দুষ্কর।বোধ হয় এসএমসির মাধ্যমে কী ধরণের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তার কীয়দংশ উপরের আলোচনায় এসছে। এক্ষণে অশুভ চক্র কীভাবে উচ্চাকাশে মাথার উপরে আবর্তিত হচ্ছে তা সকল বিষয়ে খন্ড খন্ড ভাবে দেখা আবশ্যক।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )