রিকশাওয়ালা বনাম নারী যাত্রী: পুরুষদের ভাইরাল ফিভার।
(একটি কাল্পনিক কথোপকথন)
কণা: পুরুষ রিকশাওয়ালাকে এক নারী যাত্রী পেটাচ্ছে‘-এ ভিডিওটি সকল পুরুষরা দেদারসে শেয়ার করছে আর মহিলাকে বকাবকি করছে। ভাবখানা এমন পুরুষরা মনে হয় রিকশাওয়ালার গায়ে হাত তুলেনা। বাস্তবতা হলো প্রতিদিনই রিকশাওয়ালারা মাইর খায়। তবে সেসব ক্ষেত্রে যিনি মারছেন, তিনি পুরুষ। তাই পুরুষরা শেয়ার করেননা। এ ঘটনাটিতে একজন নারী পুরুষকে পিটিয়েছে বলে শেয়ার করছে।
ধুলি: আমিতো এতে দোষের কিছু দেখছিনা। প্রথম কথা হলো এ ভিডিওটি যিনি করেছেন হতে পারে তিনি পুরুষ। তিনি শেয়ার করেছেন, অন্য পুরুষরাও শেয়ার দিচ্ছেন। একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়েই শেয়ার করছেন। যখন পুরুষরা রিকশাওয়ালাকে মারে তখন নারীরা ভিডিও করলেই পারে, শেয়ার করলেও পারে। তারা করেননা কেন? মহিলাদের অনেকে হয়তো মনে করেন যে পুরুষরা রিকশাওয়ালাকে মারলে সেটা অন্যায়না। দ্বিতীয়ত যে মহিলা রিকশাওয়ালাকে মেরেছেন, তার এ মারাও তো পুরুষতান্ত্রিক আচরণের বহি:প্রকাশ। তথা যার ক্ষমতা বেশি সে অন্যকে মারবে। যে মহিলা নিজে পুরুষতান্ত্রিকতায় আক্রান্ত তার পক্ষ নেবার কি আছে?
কণা: আমি পক্ষ নিচ্ছিনা। পুরুষরা যখন পেটায়, সেই ভিডিওতো পুরুষরা এমন করে শেয়ার করেনা! তাছাড়া আমার মনে হয় মহিলার তাড়া ছিল, জরুরি কোন কাজ ছিল, আস্তে চালাচ্ছে দেখে মহিলা রেগে গিয়েছিল। রেগে গিয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে আচরণ করেছে। এখানে জেন্ডার ফেন্ডার টানা ঠিকনা। অথচ পুরুষরা গণহারে শেয়ার দিয়ে নারীটিকে হেয় করছে।
ধুলি:মানুষ রেগে গেলেও সবসময় এরকম আচরণ করেনা। যখন সে বুঝে পরিস্থিতি তার অনুকূলে বা ক্ষমতায় বা ক্লাসে সে উপরে তখনই সে রাগ দেখায় ও অন্যের উপর ঝাপিঁয়ে পড়ে।
কণা:তাই নাকি? আসলে নারীরা সবসময়ই ভিকটিম। এখানেও মহিলাটি ভিকটিম হলো। যে কাজ অনেকেই করে; কারো ভিডিও ট্রল হয়না, শুধু সে নারী বলে তার ভিডিও দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। এটি নারী ও তার পরিবারের উপর নির্যাতন।
ধুলি: বাহ! মার খেলো পুরুষ। নির্যাতিত হলো পুরুষ, আর আপনি নারী নির্যাতন খুঁজে পাচ্ছেন? ফেনীর সাবেক এমপি হাজারী কিংবা রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ খান যে বলেছিলেন “পুরুষ নির্যাতন আইন চাই“ সেটাই দেখছি বাস্তব এখন। আর আপনি নারী ও তার পরিবার নির্যাতিত বলছেন কেন? এ ট্রলের কারণে নারীটি এখন দেশের সবার পরিচিত। কে বলতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী এমপি ইলেকশানে নমিনেশন পেয়ে যেতে পারে। এমন মারদাঙ্গা যোগ্য নারী কোথায় পাবে ট্রাম্পের দল। তাঁকেই তো খুঁজছে সমগ্র বিশ্ব। কোথায় নারীরা খুশি হবে, তা না, আবারও পুরুষদের পেছনে লাগছে।
কণা:শারিরীক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক নির্যাতন অনেক বেশি দগদগে, কষ্টকর। এ নারীটি এ ঝামেলার উপর দিয়ে যাচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এ চিত্রটি বড়ই ভয়াবহ। ঘরে কিংবা বাইরে, দেশে কিংবা বিদেশে পদে পদে নারীকে হেয় করা, নিগৃহীত করাই পুরুষদের কাজ। এটা করতে না পারলে পুরুষদের পেটের ভাত হজম হয়না।
ধুলি: তাই? আচ্ছা আজ যদি রিকশাওয়ালা ছেলেটি পাল্টা নারীটির চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে দিতো তাহলেও কি ভিডিও শেয়ার কম হতো? তখন তো নারী পুরুষ সবাই ফেসবুকে শেয়ার করতো আর নারী নির্যাতনের মামলার জন্য আন্দোলন হতো। ছেলেটি জেলে যেতো। মোটকথা হচ্ছে ক্ষমতার লড়াই মূল কথা। এখানে নারী পুরুষ বিষয়না। মানুষ হিসেবে কোন মানুষকে এরূপ নিতান্তই অকারণে নির্যাতন করা কি আমাদের স্বভাবসিদ্ধ? না। যখনই ক্ষমতা ও শ্রেণীর ব্যবধান তখনই আমাদের মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ইগো।
কণা: আপনি এত প্যাচাচ্ছেন কেন? আপনি কি ওই সময় ওখানে ছিলেন? মহিলার সাথে রিকশাওয়ালার কি কথা হয়েছে আপনি জানেন? কোন কথার কারণে কী পরিপ্রেক্ষিতে মহিলার মেজাজ হারিয়েছে সেটা না জেনে মন্তব্য না করাই ভালো।
ধুলি: আমিও তাই বলি। আমি জানিনা। আপনিও জানেননা। না জেনেই আমরা সবাই মন্তব্য করছি, শেয়ার করছি। আপনি মন্তব্য করলেন, তাই আমিও করলাম। আসলে ফেসবুকে শেয়ারকারীদের চেয়ে আমি আপনিও কম দায়ী না। ঘটনাস্থলে না থেকে না জেনে ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের জানা জগত থেকে উপসংহার টানছি আর সিদ্ধান্ত দিচ্ছি।
কণা: ভিডিওতে দেখলাম একজন বলছে “আপনি মহিলা মানুষ হয়ে এরকম আচরণ কেন করছেন“? মানে হলো পুরুষ হলে এ আচরণ যথাযথ ছিল! যতসব পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা।
ধুলি: যে পুরুষটি বলছেন তিনি হয়তো পুরুষতান্ত্রিক। তবে এর অন্য দিকও ভাবা যেতে পারে। পুরুষরা সবসময় খারাপ আচরণ করে। এবং এধরণের আচরণ নারীরা করা মানে হলো সে পুরুষের মতোই খারাপ। মানে সেই মারমুখী নারীটিও পুরুষতান্ত্রিকতায় আক্রান্ত। সেই বোধ থেকে বলা। তাতে যে পুরুষ এমনটা বলেছিলেন তিনি পুরুষদেরই খারাপ বলার চেষ্টা করেছেন। তথা নারীরা ভালো, কোমল, মায়ের মতো, বোনের মতো, মারমুখী না, বদমেজাজি না, ধৈর্য্যশীল যাবতীয় ভালো গুণাবলী সব নারীদের। ওই পুরুষ হয়তো এটা ভেবেই বলেছেন্ আসলে প্রতিটি কথাই ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করা যায়।
কণা: যাই বলেন, মহিলা না হয় একটু ভুল করেছেন। কিন্তু যারা শেয়ার করছেন আর গালাগালি করছেন তারাও অন্যায় করছেন। এটা মোটেই সমীচীন নয়। এটা স্পষ্ট নারী নির্যাতন। নারীটির উপর ও তার পরিবারের উপর নির্যাতন।
ধুলি: হুম তা বটে। আমি সহমত। তবে এখানে যদি মেয়েটি নির্যাতিত হতো তাহলে এতক্ষণে মানবাধিকার কর্মী বা উকিলরা মামলা করে ফেলতো। হাইকোর্ট দেখিয়ে ছেড়ে দিতো। পুরুষগুলো বেকুবতো, শুধু ফেসবুকে শেয়ার আর গালি দিয়েই খালাস। মামলা করতে এখনো কেউ এগিয়ে আসেনি। পুরুষরা শুধু ফেসবুক চিনে, হাইকোর্ট চিনেনা।
যাই হোক, আমার মনে হয় এখানে জেন্ডার ইস্যু নেই, এখানে ক্লাস স্ট্রাগল বা শ্রেণী সংগ্রাম আছে।
কণা: নারীটি যা করেছে তাতে ক্লাস স্ট্রাগল থাকতে পারে, কিন্তু পুরুষরা ফেসবুকে পত্রিকায় যা করছে সেটা জেন্ডার ইস্যু।
কিছু লোক দেখলাম বলতেছে মহিলাটি বিএনপি কর্মী, কিছু বলছে আওয়ামীলীগ কর্মী। এনিয়ে দুদলের লোক দুদলকে টেনে এনে দলের দোষ দেখছে। ফেসবুক বড় তামাশার জায়গা। এত এডিটিং হয়! রাজনীতি আমাদের পিছু ছাড়েনা। রাজনৈতিক আবরণ দেয়া লাগবেই।
ধুলি : আসলে সে যে কোন পার্টিরই হোক, আচরণ একই হবে। ক্ষমতায় থাকলে মানুষের চেহারা পাল্টে যায়। যে ব্যবহার করেছে, মানুষ হিসেবেই করেছে। মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত শ্রেণী বৈষম্য, জেন্ডার বৈষম্য, রং বৈষম্য, ইত্যাদির উর্দ্ধে উঠা। নারী বা পুরুষ হবার আগে আমাদের মানুষ হওয়া জরুরি।
লেখক সফিকুল ইসলাম, ডিসেম্বর, ২০১৮, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )