প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে করণীয়
এসি রুমে বসে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে তা ব্যুমেরাং হবে। আকবার আলী খানের ফ্রেন্ডলি ফায়ার তত্ত্বের বাস্তব নতুন উদাহরণ তৈরি হবে।থানচি-শাল্লা কিংবা স্বন্দীপ-হাতিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রাখতে হবে। ঢাকায় যারা বুদ্ধি দেন তাদেঁর মধ্যে আইসিটি ব্যবসায়ী আছেন, ডিভাইস ব্যবসায়ী আছেন, কোচিং ব্যবাসায়ী আছেন, বই ব্যবসায়ী আছেন, শিক্ষা ব্যবসায়ী আছেন, আছেন অনেক দালালশ্রেণী;এদের থেকে সাবধান হওয়া লাগবে। বুঝতে হবে শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি।মনে রাখতে হবে কিছু লোক মানুষের সমস্যার মধ্যে তার ব্যবসা খুজে পায়! তাই শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত সকল স্টেকহোল্ডারের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টিকে ধারণ করতে হবে। দরকার তিন থেকে ছয়মাস সময় নিয়ে গোপনীয়ভাবে পরোক্ষভাবে ২০/২৫টি একাডেমিক কোয়ালিটেটিভ গবেষণা। হঠাৎ করে ঢাকায় এসিরুমের সেমিনার দিয়ে কোন ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত হবেনা। যত বড় গবেষক, সুশীল ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ আর আমলাই সেমিনারে আসুকনা কেন, কার্যকর কিছু হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ।তাঁদের অনেকে জানে বেশি, বুঝেনা; বুঝে বেশি, জানেনা। তাত্ত্বিকের মাথায় অভিজ্ঞতা নাই; অভিজ্ঞের মাথায় তত্ত্ব নেই।সরলের জ্ঞান নেই; জ্ঞানীর সহজিয়া ভাব নেই। অপরাধের বহুমাত্রিক মাত্রা ও ধরণ বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তটি হতে হবে বাস্তবমুখী, উপযোগী, বাস্তবায়নযোগ্য, সার্বজনীন এবং টেকসই।
কোন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। প্রশ্নপত্র ফাঁস কীভাবে হয় বা কারা করে এর চাইতে বড় প্রশ্ন হলো কেন ফাঁস হয়। কেন বা কারণ না জানলে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তা ফলপ্রসু হবেনা। লোকদেখানো লম্ফজম্প হবে।কিছু কাজ আছে গিনিপিগ টেস্ট করে করে ধারণা লাভ করে আস্তে আস্তে উন্নত করা যায়। কিন্তু শিক্ষাখাতে এরকম ভুল করে ছাত্রদেরকে গিনিপিগ বানানো যাবেনা। যেকোন সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নিতে হবে।বিষয়টির গভীরে ঢুকতে হবে; এর সাথে জড়িত সকল বিষয় ও ব্যক্তিকে বুঝতে হবে।দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে হবে।
কতগুলো প্রশ্ন করি:
১. শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তারা শিক্ষকদেরকে বলেন “সবাইকে পাস করাতে হবে, বেশি করে এ প্লাস পাওয়াতে হবে”। -এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত নয়?
২. জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষায় বাচ্চাদেরকে ফলমুখী করেছে, শিক্ষামুখী করেনি।- -এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
৩. অনেকেক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটিগুলো যথাযথভাবে হয়না। –এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
৪. অনেকক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ যথাযথভাবে হয়না। –এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
৫. সিজিপিএ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়না। তাই, যেভাবেই হোক উচ্চ সিজিপিএ চায়। শিখতে চায়না।–এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
৬. লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দেওয়া আছে তিনি লাইব্রেরিতে বসেননা, বাচ্চাদের বই পড়ানো নিয়ে একটি কথাও বলেননা। শুধু ক্লাস আর পরীক্ষা নেন। —এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
৭. ক্রীড়া শিক্ষক ও ধর্ম শিক্ষক তাঁর নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননা। অন্য শিক্ষকের মতো গৎবাঁধা ক্লাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।- –এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
৮. শিক্ষার সাথে জড়িত জেলা উপজেলার কর্মকর্তারা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীদের মতো স্কুল ভিজিটের প্রমাপ পূরণে ব্যস্ত থাকেন।শুধু ফরম পূরণে ব্যস্ত থাকেন। কাজের কাজ কিছু করার সময় পাননা। —এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
৯. শিক্ষার সাথে জড়িত জেলা উপজেলার কর্মকর্তারা আগের মতো কোন অন্যায়ে যুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননা। ব্যবস্থা নিতে গেলেই শিক্ষক-সমিতির নামে সবাই একজোট হয়ে বিষয়টিতে রাজনীতি যুক্ত করে শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে লাগেন। আগে শিক্ষা পরিদর্শক স্কুলে গেলে স্কুল কাঁপতো। এখন স্কুল ভিজিটে গিয়ে শিক্ষা অফিসার কাঁপে।- –এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১০. যাদের জীবনের স্বপ্ন কোটিপতি হবে, বড় রাজনীতিবিদ হবে বা বড় ব্যবসায়ী হবে তারা এসে এখন স্কুলের শিক্ষকতায় ঢুকে। তাহলে সে পড়াবে কি? সারাক্ষণ টাকা কামানোয়, রাজনীতিতে বা ব্যবসায় মন। কোচিং, প্রাইভেট, শিক্ষক-রাজনীতির রমরমা। -এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১১. সবাইকে এমএ পাস করতে হবে এ ধারণা থাকা। তাই টেকনিক্যাল স্কূল কলেজকে আরও বেশি শক্তিশালী, জনমুখী, চাকুরি-নিশ্চিতকরণ ও জনপ্রিয় করা হচ্ছেনা -এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১২. পাঠ্যবইয়ে শ্রেণী অনুসারে মানসম্মত বিষয়াদি নেই, কারিকুলামের ঠিকঠিকানা নেই। যা আছে তাও ভুলে ভরা থাকে অনেক সময়। -এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১৩. মূল বই বাদ দিয়ে নোটবই আর কোচিংনোটের ছড়াছড়ি। –এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১৪. প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার উপকরণ, বিষয়, শিক্ষক ও পরিবেশ ইত্যাদি মৌলিক ইস্যুগুলোতে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যতা অনেক ক্ষেত্রে নেই।–এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১৫. যত্রতত্র কোচিং সেন্টারে ভরে গেছে দেশটা –এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১৬. শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা কোন অনিয়ম করে অনেকক্ষেত্রেই পার পেয়ে যায় —এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
১৭. সবাই অন্যের দোষ দেখি, নিজের দায় দেখিনা, করণীয় করিনা —এটি কি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত বিষয় নয়?
এরকম আরো ১০০টি প্রশ্ন করুন, উত্তর খুঁজুন। দেখবেন কারণ ও সমাধান দুইই মিলবে।শিক্ষার মানোন্নয়নের চেষ্টার সাথে প্রশ্নফাঁস বন্ধকরণের প্রচেষ্টার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমার কাছে সব সমাধান নেই। কারণ ব্যক্তি হিসেবে আমার জানা ও অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ।
আপাতত কয়েকটি সমাধান বলি।
১. প্রতি উপজেলায় একটি বড় পরীক্ষাকেন্দ্র করা যেখানে উপজেলার সবাই পরীক্ষা দেবেন। তাতে পরীক্ষার একঘন্টা আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেনা। এবং পরীক্ষায় নকল হবেনা, দেখাদেখি হবেনা এবং শিক্ষকরা অসদুপায়ে সহযোগিতা করবেনা। এবং সারা উপজেলার সকল পরীক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগসম্পন্ন পরীক্ষা পরিবেশ হবে। এবং পরীক্ষাচলাকালীন শ্রেণীকার্যক্রম বন্ধ থাকবেনা। পরীক্ষার নামে অনেক স্কুলে শ্রেণীকার্যক্রম প্রায় ৫ মাস বন্ধ থাকে।
২. জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষা উঠায়ে দেওয়া। অথবা পিইসি ও এসএসসি পরীক্ষা উঠায়ে দেওয়া।কারণ ১২ বছরে ৪টি পাবলিক পরীক্ষা অ্যাবসার্ড ধারণা। দুটোই যথেষ্ট।
৩. ডিজিটাল সমাধানের দরকার আছে। আমি ডিজিটাল প্রযুক্তির বিরোধীনা। ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যেও ফাঁক থাকে।যারা প্রশ্ন ফাঁস করতে পারে তারা ডিভাইসও সরাতে পারে এবং পাসওয়ার্ডও ব্রেক করতে পারে। আছে এর বাস্তবায়নে সমস্যা। হতে হবে বাস্তবমুখী, উপযোগী, বাস্তবায়নযোগ্য, সার্বজনীন এবং টেকসই।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি করতে হবে। আগের জিপিএ কাউন্ট করা হবেনা। তাতে সবাই পড়তে শিখতে চেষ্টা করবে। সিজিপিএ নিয়ে ভাববেনা। অহেতুক সিজিপিএর জন্য প্রশ্নফাঁস করতে যাবেনা।
*অনেকে বলতে পারেন, আমিও হুট করে সমাধান দিয়ে দিলাম। এটা সমাধান নয়, এটি অভিজ্ঞতা থেকে প্রস্তাবমাত্র।এখন এরকম হাজারটি প্রস্তাব থেকে উত্তমটি বেছে নিতে হবে।
*মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার বিষয়টিতে আন্তরিক। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দরকার শুধু সঠিক পরামর্শ, সঠিক সময়ে , সঠিক স্থানে পৌঁছানো।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ব্রিসবেন।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )