পম্পে, ভেনিস, মিলান
ইটালির নেপলি থেকে পম্পে নগরী দেখতে যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে। ট্রেন যেন ইউরোপের নয়, মনে হলো বাংলাদেশের কর্ণফুলি ট্রেন। হাউকাউ, চিতকার চেঁচামেচি, ঘামের গন্ধ, ধাক্কাধাক্কি কী নয়?
এর মধ্যে দেখলাম চাইনিজ কয়েকজন মহিলা ওঠেছে। কীসব কথা বলতেছে। এর মধ্যে এক ভদ্র মহিলা একটা কাঠি বের করলো। সেটা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকাচ্ছিল। বিশেষ করে পিঠে যেখানে সচরাচর হাত পোঁছায়না। আমি কাঠের তৈরি হালকা এ শিল্পকর্মটি দেখে কৌতুক বোধ করলাম। আবার পছন্দও করলাম। এটা সহজে ফোল্ড করে ব্যাগে রাখা যায়, আবার সুন্দর করে চুলকানো যায়। মহিলা আরামছে চোখ বন্ধ করে জায়গামতো চুলকাচ্ছে। ট্রেনের কে কী ভাবছে ওসবে তার খেয়াল নেই। মহিলার পিঠ চুলকানো আর চোখ বন্ধ করা দেখে আমার কেবলি মনে হলো জগত কত সুন্দর।
এরই মাঝে পেছনে দেখি হারমোনিকার আওয়াজ। একটি মেয়ে হারমোনিকা বাজাচ্ছে আর দুজন ছেলে কাঠের ঝনঝনি কিছু এটা বাজাচ্ছে। মনে হলো ইটালির কোন স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র। এত সুন্দর সুরে হারমোনিকা বাজাচ্ছে আমার মনে হচ্ছি হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশির কোন আসরে আছি। কিংবা জগদ্বিখ্যাত কোন হারমোনিকা বাজানো শুনছি। পরে খেয়াল করে দেখলাম, এরা আসলে বাংলার বাউলদের মতো, হেঁটে হেঁটে গেয়ে গেয়ে বেড়ায়। মাঠের ঘাটের বাউল দল। কেউ দু চার ইউরো দিলে নেয়। তবে হাত পাতেনা। আপন মনে কেবল সুর বাজিয়ে যায়। মাঝে মাঝে গায় গানও। স্থানীয় ভাষায় কী গাচ্ছিল বুঝতে পারছিলামনা, কিন্তু খুব দরদ দিয়ে গাইছিল সেটা খেয়াল করছিলাম। ট্রেনের লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সব উপভোগ করছে। ট্রেনতো নয় যেন অজপাড়াগাঁয়ের মেটোপথে বাউলট্রেন চলছে অজানা পথে।
দাঁড়িয়ে কেবল ভাবছিলাম, আহা পৃথিবী কত সুন্দর।
………………
ভেনিস।
বহুদিন থেকে ইচ্ছা, ভেনিসে যাব। শহরটির সঙ্গে যে শুধু শিল্পকলা বা শেক্সপিয়ারের নাটকের সংযুক্তি, তা নয়, আছে পশ্চিমা রেনেসাঁসের, মসলা-রেশমি বস্ত্রের বাণিজ্যের, ক্ষমতার, বন্যা ও জলশাসন আর মার্কো পোলো অথবা কাসানোভার জড়িয়ে থাকার ইতিহাস। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে একটি কনফারেন্সে ইটালি গিয়েছিলাম। তখনই যাওয়ার সুযোগ হলো, কিন্তু মাত্র এক দিনের জন্য। ভেনিসে হাঁটতে হয়—শুধু পশ্চিমা ফ্ল্যানুর মতো উদ্দেশ্যহীন হাঁটা নয়, বরং নিশি পাওয়া মানুষের মতো হাঁটা। কত মাইল যে হাঁটলাম শহরটিতে, নৌকায় কত খাল ঘুরে ল্যাগুনে সময় কাটিয়ে এ শহরের দ্বীপের পাশ দিয়ে, বুড়ি ছুঁয়ে গেলাম, হিসাব নেই। দেড় হাজার বছরের সারা শরীরজুড়ে ইতিহাস, যেদিকে তাকাই স্থাপত্য আর নির্মাণকলার আঁকিবুঁকি। সারা দিন শেষে সন্ধ্যা নামলে মার্কোর গল্পে কান পাতলাম, কুবলাইয়ের মতো অনুভব করলাম, সবগুলো মিলে যে বাস্তুকলা, যে স্বপ্ন-কামনা, সূক্ষ্মতা-স্থিতিস্থাপকতার চিত্রকলার জন্ম দেয়, তাতে মানবসৃষ্ট অমরতা খুঁজে নিতে পারে, মানব নিজেও।
সাগরের জলরাশিতে ভেসে আছে নগরী। ইটালির যে কোনো শহর থেকে ট্রেনে বা গাড়িতে ভেনিসে যাওয়া যাবে। তবে স্টেশনে পৌঁছানো পর্যন্ত। এরপরে মূল নগরীতে আর গাড়ি চলেনা। ব্রিজটি পার হলে হেঁটে যেতে হবে। পুরো নগরী সাগরের উপরে ভেসে। কিংবা নৌকা বা লঞ্চ দিয়ে যাওয়া যাবে। খুব বড় শহর নয়, যেরকম নাম, সেরকম বড় শহর এটি নয়। ছোট্ট নগরীর সব খানে ফাঁকে ফাঁকে অনেক খাল। দেখলে মনে হবে খাল, আসলে পুরো নগরীই জলাশয়ে অবস্থিত। কাঠের উপর দাঁড়িয়ে অনেক ভবন। ওক গাছের কাঠ সহজে পঁচেনা। কাঠ সাধারণত পঁচন ধরে যদি পানি ও অক্সিজেন একসাথে পায়। সাগরের জলরাশিতে অক্সিজেনের কমতি থাকায় শক্ত ওক কাঠ সহজে পঁচেনা। যুগের পর যুগ টিকে যায়।
নগরীতে ভর্তি শত শত চকলেটের দোকান। এত পরিমান চকলেট, এত ধরণের চকলেট তা আমার চিন্তার বাইরে। নানান উপকরণ, নানান রঙ, নানান ডিজাইন, নানান ব্রান্ড। এ যেন চকলেটের শহর। স্বাদে গন্ধে ভরপুর প্রতিটি চকলেট, মুখে দিলেই মিশে যায়। কিংবা কড়কড়ে নাট এর আমেজ। ভিজু ভার্চু হচ্ছে ভেনিসের সেরা চকলেট ব্রান্ড যার প্রতিষ্ঠাতা মারিয়েনজেলা পেঞ্জু। স্পাইস, কোকোয়া আর চিনি দিয়ে সেরা চকলেট বানায় এ কোম্পানী। চার্লস ডিকেন্সের প্রিয় ছিল হট গাঢ় ডার্ক চকলেট। আমি এক দোকানে যাই, বিভিন্ন ধরণের চকলেট টেস্ট করি খেয়ে খেয়ে। পরে যেটা ভালো লাগে সেটা এক প্যাকেট কিনি। এভাবে নতুন দোকানে যাই, আবার নানান ধরণের চকলেট খাই। যেটা পছন্দ সেটা এক প্যাকেট দিতে বলি। বিনা পয়সায় চকলেট খাবার এমন সুযোগ কে ছাড়ে?
ভেনিস হচ্ছে আলোর নগরী, পানির নগরী, খালের নগরী, ভাসমান নগরী, ভালোবাসার নগরী, নৌকার নগরী। ঐতিহ্যবাহী নৌকা গন্ডোলাতে না উঠলে যেন জীবন বৃথা। গন্ডোলা মানে ছোট ডিঙি নৌকা। যারা গন্ডোলা চালায়, তাদের বলে গন্ডোলিয়ার। একাদশ শতাব্দী থেকে বয়ে চলেছে এই পেশা। আগের দিনে ছই দেওয়া গন্ডোলায় চড়ে ধনীরা ভেনিসের খালপথে এখানে ওখানে যেতেন। মালপত্রও বহন করা হতো এই গন্ডোলা দিয়ে। একসময়ে ভেনিসে নাকি দশ হাজার গন্ডোলা ছিল। বর্তমানে স্বল্প পরিমাণে হলেও শুধু ট্যুরিস্টদের জন্য টিকে আছে গন্ডোলার ঐতিহ্য। ১১৮টি ছোট্র দ্বীপ, ১৭৭টি খাল আর ৪০৯টি সেতুর কারিশমায় নির্মিত ভেনিস নগরীতে বাস করে প্রায় তিন লক্ষ লোক। মানুষ প্রধানত চলে নৌকায় আর চলে পায়ে হেঁটে।
স্বপ্নের শহর ভেনিসকে অন্য দুনিয়ার মূর্তি বললেও ভুল হয় না। বিশেষ থিমে বানানো মুখোশ পরে পালিত হয় প্রধান দুই উৎসব। ভেনিসের রংবেরঙের মুখোশগুলো এমনিই জগদ্বিখ্যাত। তার ওপর ফেস্টিভ্যালের সময় দর্শনীয় চিত্র-বিচিত্র সব মুখোশ শোভা পায় প্রায় সবার মুখে। সারা বছরই চলে তার বিকিকিনি। হরেক রকমের মুখোশ পরে লোকজন উৎসব পালন করে। যারা মুখোশ তৈরি করে তাদেরও একটা আলাদা সম্মান আছে সমাজে। এই মুখোশের কোনটা পাখির ঠোঁট, কোনটা বিশালাকৃতির, কোনটা পালকময় আবার কোনোটা মুখের অবয়বে তৈরি। বিলিয়ন ডলার মূল্যের মুখোশ দেখে আমি অবাক বনে গেছি। ফেস্টিভালে তারা কত খরচ করে মুখোশ কিনে সেটা কল্পনা করে আমার মাথা ঘুরছিল।
সাধারণত যে কোনো জায়গায় গেলে ছবি তোলার জন্য লোকেশন খুঁজতে হয়। কিন্তু ভেনিস এমন নগরী যেখানে প্রতিটি অংশই যেন ছবি তোলার জন্য পারফেক্ট লোকেশন। জল ও স্থলের সম্মিলনে, সাজিয়ে রাখা ভবন আর বিস্তির্ণ জলরাশি আর খোলা আকাশ মিলে প্রতিটি স্থানই যেন ছবি তোলার স্পট। ক্লিক করা মাত্রই বেস্ট ছবি।
ভেনিস নগরীতে প্রথম কোনো মসজিদ নির্মিত হয়েছে বছর দুই আগে। এর আগে সেখানকার মুসলিমদের স্টোর রুম বা দোকানে নামাজ আদায় করতে হতো। মসজিদটি একটি খ্রিস্টান চার্চকে সংস্কার করে স্থাপিত হয়। প্রায় ৪০ বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া মিজেরিকডিয়া নামের চার্চ এটি। প্রতি বছর ভেনিসে লাখো মুসলিম পর্যটক যান। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন, শহরে ইসলামের ইতিহাসের বহু নিদর্শন দেখা গেলেও মসজিদ নেই কেন? এই মসজিদটি সেই প্রশ্ন হয়তো বন্ধ করেছে। কাতার সরকারের অর্থায়নে আধুনিক শিল্পকলা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা প্রদর্শনী ‘ভেনিস বিনালে’র অংশ হিসেবে এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। সুইডেনের শিল্পী ক্রিস্টোফার বুশেলের ডিজাইন অনুযায়ী প্রদর্শনীর প্রবেশ পথে মসজিদটি স্থাপন করা হয়।
ভেনিস নির্মাণের ইতিহাস শুরু হয় পঞ্চম শতকের দিকে। সময়টা ছিল পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের শুরুর দিক। উত্তরের দিক থেকে বর্বর ও অসভ্য জাতি রোমের প্রাক্তন অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য উঠে পড়ে লাগে। নিরীহ বাসিন্দাদের উপর বর্বর হামলা চালানো এবং লুটপাট খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এসব হামলা থেকে বাঁচার জন্য বাসিন্দারা অন্য কোথাও ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ভূমি ছেড়ে জলাভূমির উপরই বাসস্থান নির্মাণ করা তাদের কাছে উপযুক্ত বলে মনে হয়। বালুময় তিনটি দ্বীপ- টরসেলো, জেসোলো এবং মালামোক্কোর কাছেই শুরু হয় ভেনিস শহরের নির্মাণ।
দিনে দিনে এসব জায়গায় মানুষের আগমনের কারণ ছিল বহিঃশত্রুদের আক্রমণ। এদের জন্য জলাভূমিতে আক্রমণ করা কষ্টকর ছিল। সেজন্যই ধীরে ধীরে সবাই নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে সমুদ্রের উপরই বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। বাসস্থানের ভিত্তিকে মজবুত এবং টেকসই করতে কোনো শক্ত মাধ্যমের প্রয়োজন আছে, আর এক্ষেত্রে বাসিন্দারা এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে ব্যবহার করে কাঠ। কাঠের খুঁটি, কাঠের পাটাতন একের পর এক জোড়া লাগিয়ে শুরু হয় ভেনিস নির্মাণের কাজ। দুর্ভোগের সময় ভিত্তি তৈরির জন্য শুধু কাঠের যোগাড় করাই তাদের পক্ষে করা সম্ভব ছিল। তাছাড়া, এসব নির্মাণকাজে তখন আধুনিক যন্ত্রপাতিও ছিল না। তাই কাঠই হয়ে দাঁড়ায় তাদের ভিত্তি নির্মাণের মূল উপকরণ।
মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন বাঁচার পথ খুঁজে নেয়, কঠিন সময় সহজ পথ বের করতে ধাবিত করে, অসময়ই সময়কে ডেকে আনে। ভেনিস নগরীর উথ্বানও সেভাবেই হয়। সমস্যাই সুযোগকে আনতে তাড়িত করে।
ভেনিস শহরে অবস্থিত বিখ্যাত সান্তা মারিয়া ডেলা স্যালুট চার্চ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ১১,০৬,৬৫৭টি কাঠের খুঁটি। প্রতিটি খুঁটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৪ মিটার। চার্চটি নির্মাণ করতে সময় লাগে দু’ বছর দু’মাস। প্রক্রিয়াটি বেশ কষ্টকর, তাই সময় বেশি লাগারই কথা। তাছাড়া কাঠের যোগাড় করতে হতো অন্য জায়গা থেকে। আর যোগাড় করে পানিপথে আনা হতো কাঠগুলো। এভাবেই নির্মিত হয় ভেনিস নগরী। তবে অনন্য সৌন্দর্যে ঘেরা শহরটির পরিস্থিতি এখন অবনতির পথে। কাঠের ভিত্তির উপর তৈরি ভাসমান নগরী ভেনিস ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে পানির নিচে। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ০.০৪ থেকে ০.০৮ ইঞ্চি ভূমি চলে যাচ্ছে সাগরের নিচে। এর একটি কারণ অবশ্যই সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাওয়া। আর এর পেছনে দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা।
………………..
মিলান
ভেনিস থেকে মিলান যাবো, যে শহরে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির দ্যা লাস্ট সাপার ম্যুরাল অবস্থিত। মিলানে কার কাছে যাবো তার ঠিক নেই। ঢাবির বন্ধু শিপু এখন মিলান থাকে। ফেসবুকে জানিয়েছিলাম যে যেতে পারি। শিপু আমাকে খুবু আন্তরিকভাবে ফোন দিয়ে জানালো আমি যেন যাই। যাবো কি যাবোনা ভাবছি, তবু ভেনিস থেকে মিলানের টিকেট কেটে ট্রেনে উঠিয়ে দিল এনাম, কিবরিয়া, ও হানিফ ভাই। ট্রেন চলছে, দুপাশে রাশি রাশি জমি-খাল-প্রান্তর পেছনে ফেলে ট্রেনে বসে আমি ধাবিত হচ্ছি ভেনিস থেকে মিলানের পথে।
ট্রেনে বসেই সাজু ভাইয়ের ফোন পাই। বললেন ‘‘ভাই, আমি শিপুর বড় ভাই‘‘। মিলানে কীভাবে নামবো টিকেট কাটব তার পরামর্শ দিল। পরে বললাম, ভাই কি ফ্রি আছেন?
বললেন যে ফ্রি আছেন।
আমি বললাম চলেন দুই ভাই মিলে ঘুরি মিলান সিটি। বললেন, আচ্ছা।
সেই থেকে শুরু। গাড়ি নিয়ে এলেন আর একের পর এক দেখাতে থাকলেন।
কিছু মানুষ সারাজীবন আপনার সাথে চললেও আপনার উপর প্রভাব ফেলতে পারেনা। কিছু মানুষ কয়েকঘন্টায় আপনার জীবন দর্শন ও ভাবনার সব খোলনলচ বদলে দিতে পারে। সাজু ভাই তেমনি একজন।
মিলান ট্রেন স্টেশনে নেমেই পরের দিনের জেনেভা যাওয়ার টিকিট কিনলাম স্টেশন থেকে। আমার সময় আর গন্তব্য বলার পরে কাউন্টারের লোকটি কম্পিউটারে কি টেপাটিপি করে টিকেট ধরিয়ে দিল।
প্রথমে সাজু ভাই এক বন্ধুর এখানে গেলেন। চাঁটগায়ের ব্যবসায়ী মিলানে থাকেন। সবে মিলে কফি খেলাম। ওনারা স্ট্রং ডোজ নিলেও আমি কাপোচিনোতে সন্তুষ্ট।
কফি শেষ করে দুজনে বেরিয়ে পড়ি। রাজবাড়ি দেখি, দুমো দেখি, ইমানুয়্যাল গ্যালারি দেখি। Duomo বিশ্বের বৃহত্তম গোথিক ক্যাথেড্রাল এবং ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম গির্জা। বিল্ডিং শুরু ১৩৮৬ এবং প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলেছে! এর মার্বেল চমতকার এবং এর ছাদে ১৩৫ টি স্পিরি এবং ৩২০০ মূর্তি রয়েছে। ক্রুশবিদ্ধ খ্রীষ্ট রয়েছে। এই দোমো কেন্দ্র করে মিলানের হাব।
এরপরে অনেক দূর হেঁটে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির বিখ্যাত শিল্পকর্ম “দি লাস্ট সাপার” নামের একটি ম্যুরাল দেখতে গেলাম। এই ম্যুরালে ১২ জন শিষ্যসহ যিশুকে দেখানো হয়। এই শিল্পকর্মটিসহ ভিঞ্চির আরও বেশ কিছু কাজে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও মিথলজির প্রভাব পাওয়া যায়।
তারপরে দেখলাম রাজবাড়ি। যেটাকে রয়েল প্যালেস বলে যেখানে ডিউক অব মিলান থাকতো। এ রাজবাড়ি মধ্যযুগ ১৬ শতকে নির্মিত হয়। সাত হাজার বর্গমিটারের এ রাজবাড়ি এখন মিলান সিটির আর্টকেন্দ্র। এখানে সমসাময়িক বিভিন্ন সংগ্রহ প্রদর্শন করা হয়, জাদুঘর অংশ রয়েছে। বছরে প্রায় ১৫০০ মাস্টারপিস দেখানো হয়। রাজবাড়িটি দেখে আমি ভাবছিলাম সবদেশের রাজারাই এক। প্রজাদের রক্ত চোষে প্রাচীর তৈরি করে। খাজনার নামে চলে নানান অত্যাচার। যুদ্ধের খরচ সহজে মেটায় রাজা, প্রজার ক্ষুধা নিবারণের অর্থ থাকেনা রাজার হাতে।
ফ্যাশন এবং ডিজাইনের জন্য প্রসিদ্ধ শহর মিলান। তাই একে আবার বিশ্বের ফ্যাশন এবং ডিজাইন ক্যাপিটাল বলা হয়। ইমানুয়্যেল ভিট্টরি গ্যালারীর চারপাশে অনেক ব্রান্ডের দোকান। গ্যালারিটি নীল কাঁচ, মার্বেল মোজাইক, আর বড় ডোম মিলে অনবদ্য স্থাপনা। নয়নজুড়ানো স্থাপনা। দেখছিলাম মন ভরে। ও হ্যাঁ, এই শহরের পরিচয় ফুটবলের জন্যও আছে। নামকরা সব ফুটবলের মাঠ এবং ফুটবল দল যেমন ইন্টার মিলান, এসি মিলান এই শহরের নামে।
হাঁটি আর দেখি, আর সাজু ভাই কথা বলে। সিগারেট টানে ধোঁয়া ছাড়ে আর কথা বলে। আমি মিলানের ঐতিহাসিক সব স্থাপনা, রাস্তাঘাট, মানুষের চলাফেরা দেখে দেখে অবাক হই , সাজু ভাইয়ের কথায় আরও বেশি মুগ্ধ হই। আমার মাথা ঘুরে, জীবন তুচ্ছ মনে হয়, দুনিয়াকে বেফানা লাগে।
টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি না , সে এক অন্য জগতের কথা বলছেন সাজু ভাই। বছর পার করা মানে জীবন না, প্রতি মুহুর্তেই জীবন খুঁজে নেন সাজু ভাই।
আমি হাসতে থাকি জীবন ভাবনায় হারাই। বব মারলের নানান গান শোনাতে থাকেন। জ্যামাইকান ধারার আরো অনেক শিল্পীর গান। বাউল গান আর গণসংগীত । প্রতি গানের শানেনুযুল বলেন অর্থ বলেন। আমার মুগ্ধতা বাড়তে থাকে, সংসার তুচ্ছ লাগে।
দুপুরে ঘুরাঘুরি শেষে একটি স্থানীয় পিতজার দোকানে যাই। দুটো পিতজা অর্ডার দেন। ক্ষুধার্ত পেটে ইয়াম্মি পিতজা অমৃত লাগে। ঝাঁল ঝাঁল পিতজায় আমার তৃপ্তি চরম শিখরে ।
সাজু ভাই প্রায় ২৫ বছর ধরে আছেন মিলানে, চাকরির পাশাপাশি সামাজিক কাজ করেন, ভলান্টিয়ার হন, শ্রম আন্দোলনে আছেন এখানে।
বিকালে নিয়ে যান অনেক দূরে নদী দেখাতে। মিলান থেকে দূরে অরণি এলাকায়। নদীর নাম টিসিনো যেটি সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত প্রবাহমান। পুরো পথটা ড্রাইভিং করে নিয়ে যান। এত সুন্দর! আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। সবুজ পাহাড় আর নদীতে একাকার। আমি লাইভে থাকি ফেসবুকে। সাজু ভাই হাল্কা টোনে গভীর কথা বলেন। গাড়িতে গান বাজে, সাজু ভাই তর্জমা করে, উপমা দেয়, ঠাট্টা করে, সিগারেটে সুখটান দেয়, মাঝে মাঝে গান গায়। বব মার্লে , মাটির গান, মানুষের মন জয় করার গান, বিদ্রোহের গান, বিদ্রুপের গান একের পর এক বাজতে থাকে। গান শুনি, দৃশ্য দেখি, আর আমি হাসি আর ভাবি।
সাজু ভাই এ এক অন্যরকম সঙ্গ দিলেন। কেউ বাড়ি গাড়ির কথা বলে, কেউ গবেষণা পাবলিকেশন পান্ডিত্য দেখান, কেউ ক্ষমতা দেখান।
আর সাজু ভাই এসব কিছুই না দেখিয়ে আমাকে জীবন দেখিয়ে দিলেন।
সাজু ভাই , আপনি আমার মনে থেকে যাবেন সারাজীবন। আর আপনার মাধ্যমে দেখা মিলান সিটিও থেকে যাবে আমার মননে মগজে।
রাতে ফিরি সাজু ভাইয়ের বোন তথা আমার ঢাবি বান্ধবী শিপুর বাসায়। টেবিল ভর্তি খাবার সাজানো দেখে আমি বলি ‘‘কী দরকার ছিল এতকিছুর।‘‘ বত্তা শাক আর সিদল শুঁটকির লেটকা ভর্তাটা হেভি ছিল। খেতে খেতে হাতের আঙ্গুল চাটতে চাটতে শিপুরে বলি ‘‘তোর বোম্বাই মরিচের আচারের রেসিপি নিব‘‘ আর মনে মনে ভাবি ‘‘তোর ধৈর্য্য আর ত্যাগের দীক্ষা তো নিয়েছিই ।বন্ধুকে ধন্যবাদ দিতে নাই। তাই দিলামনা। কিউট দুইটা বাবুর জন্য এত্তগুলা আদর। ভালো থাক নিরন্তর।‘‘
শান্ত স্নিগ্ধ এ মিলান শহরটি আমার কাছে সব মিলে আর্টিস্টিক মনে হয়েছে। পুরাতনকে ধরে রাখার ও সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার একটা চেষ্টা , ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ও যত্নে লালন করার একটা প্রয়াস আমি শিখলাম মিলান থেকে। শিপুর আতিথিয়েতা আর সাজু ভাইয়ের সঙ্গ, হয়ে থাকলো এ ভ্রমনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )