আমার নাম
আমার নাম সফিকুল ইসলাম।নামটি আমার নানা রেখেছেন। আমার নাম যখন রাখা হয় তখন আমার করার কিছু ছিল না। নাম রাখতে আমার মতকে কোন গুরুত্ব দেয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। তাই যারা ভালোবাসতো তারাই বিভিন্ন নাম রেখেছেন।তারা হয়তো মুখ দেখে, কান্না দেখে, রঙ দেখে বা বড় কোন মানুষের সাথে মিল পেয়ে বা কিছু একটা ভেবে নাম রেখেছেন। অথবা ইমাম সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে পরে তার কাছ থেকেও ভালো নামের সাজেশান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যখন নাম রাখে তখন কিছুই বুঝিনি। পরে আস্তে আস্তে কিভাবে যেন নিজের নামকে ভালোবেসে ফেলেছি। এটিও আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। কেউ আমার নাম ধরে ডাকলে এত ভালো লাগে। যে নাম আমি রাখিনি সে নাম শুনতে কেন এত ভালো লাগে কে জানে! স্কুলে কলেজে, অফিসে আদালতে, ব্যাংকে, পাসপোর্টে কোথায় নেই নামটি।অদৃশ্যভাবে আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। পালিয়ে যাবার কোন উপায় নেই।মৃত্যুর পরেও বোধ হয় এ নামেই ডাকা হবে, কবরে কিংবা বিচারের দিনে! নিজের নাম জীবনে যতবার শুনি ততবার আর অন্য কিছু শুনি? মনে হয় না। সে নামের অর্থ কী? সে আবার অনেকেই জানিনা।
কলেজে পড়ার সময়ে ইচ্ছা হলো শফিক শব্দের অর্থ কী দেখি। দেখলাম, দয়ালু, সহানুভূতিশীল, উদার, ভালো কাজের প্রতি আগ্রহী এরকম। এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সময় নামটির বানান শ এর স্থলে স হয়ে যায়। লিখতে স লিখলেও বলার সময় শ উচ্চারণই করি বা লোকে করে। শফিকুল ইসলাম মানে নাকি ইসলামের প্রিয়।লোকে আমায় শফিক নামেই ডাকে। কেউ কেউ শফিকুলও ডাকে। বাস্তব জীবনেও নামের অর্থের সাথে নিজের মিল পাই। বৃশ্চিক রাশির জাতিকা হিসেবেও নামের অর্থের কিছু মিল লক্ষ্য করা যায়। অন্যের ভালো করার জন্য মন আকুপাকু করে। এ জীবনে যত ঝামেলা হয়েছে তা অন্যকে মূল্য দিতে গিয়েই হয়েছে। সবাইকে ভালো রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের জীবনের অনেক ছোট ছোট স্বাদ আহলাদের জলাঞ্জলি দিয়েছি। ভালোবাসার কাঙাল বৃশ্চিক রাশির সফিকের চাপা অভিমানও প্রবল। কে বা কারা একটু অবহেলা করলো বা গুরুত্ব দিলোনা তা নিয়ে সারাক্ষণ ভিতরে ভিতরে ফুঁস ফুঁস করাও কম হয়নি জীবনে। কত সময় চলে গেলো এমনি করে! অভিমান হতেই পারে। এটা সমস্যা না। সমস্যা হলো যার প্রতি অভিমান সে বুঝতে না পারা। এটাও সমস্যা না। অনেকেই এরূপক্ষেত্রে বিষয়টিকে পাত্তা দেয়না, ইগনোর করে। কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছে যার জন্য এ অভিমান সে বুঝতে না পারায় আরো বেশি করে অভিমানে ভূগি। যে নিজেই কুয়োয় ঝাপ দেয় তাকে বাঁচানোর উপায় নাই। সুতরাং অভিমানের জ্বলা জ্বলবেই।
আমার দাদু অন্য একটি নাম রেখেছিলেন আমার।জসিম। সে নামেও আমাদের গ্রামের কতিপয় প্রতিবেশী ডাকেন এখনো।কোন নামটি পরবর্তীতে টিকবে এ নিয়ে প্রত্যেকের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে একটি ঠান্ডা স্নায়ুযুদ্ধ চলে, ক্ষেত্রবিশেষে কুরুক্ষেত্রও হয়। আমার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির কোন গল্প শুনিনি আমি। তবে ঠান্ডা যু্দধ হয়নাই এমনটা বলতে পারিনা। স্কুলে এ নাম না দেয়ায় এই নামটি আর গ্রামের প্রতিবেশীর গন্ডি পেরুতে পারেনি। আমি যখন গ্রামে যাই, তখন জসিম করে কেউ ডাক দিলে আমি ফিরে তাকাই।নিজের গ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও ওই নামে কেউ চিৎকার করলেও আমার মনে অনুভব হয়না যে এটি আমার নাম। মস্তিস্ক হয়তো সিগনাল ঠিক করে নিয়েছে কোথায় কোন পরিবেশে গেলে জসিম নামে ডাকের রেসপন্স করতে হবে। মস্তিস্ক আসলেই জটিল। পানির মতো জটিল।
ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় নাকি কলেজে পড়ার সময় নিজেই নিজের একটি নাম দিয়েছিলাম।সরো। দুঃখ এর ইংরেজি। ওই বয়সে যেরকম হয় আর কি। অনেক দুঃখবোধ জমা হয়েছিল বুকের ভিতরে। হয়তো এ কারণে নামকরণ করে নিজেকে হালকা করতে চেয়েছিলাম কিনা কে জানে। মানুষ মাত্র দুঃখের ফানুস উড়াতে ভালো লাগে। নিজের দুঃখী দুঃখী ভাব আর দুঃখের স্মৃতি ভেবে হয়তো অনেকেই বিলাস করে। দুঃখবিলাস। আমারও হয়তো ওরকম কোন বিলাসরোগে ধরেছিল। যা না পাইবার তাই কেন চাইরে টাইপের দুঃখ কার জীবনে নেই? আমিও মানুষ, আমারও হয়তো ছিলো।
আমার নামের সাথে পদবী যুক্ত নাই। পিতৃকুল থেকে “জমাদ্দার” বা মার্তিৃকুল থেকে ভূঞা লাগানোই স্বাভাবিক ছিল। যে কোন একটা নাম নিতে পারতাম। সে চেষ্টা যে আমার ছোটকালে হয়নি তা নয়।পিতৃকূল জমদ্দার বলে বড়াই করে। আর মাতৃকূল ভূঞা বলে বড়াই করে। আত্মীয়রা চেষ্টা করেছিল বটে। যার যার মতো করে ডাকতে। তবে সেসব আর হয়নি। যখন আমার ক্লাস নাইনে নিবন্ধন করা হয় তখন এসব পদবী বাদ গেছে। কেরাণী বাদ দিয়েছে না আমি বড় নাম লেখার ফ্যাঁসাদ থেকে বাঁচার জন্য বাদ দিয়েছি মনে নেই। তখন যদিও বংশপদবী বিষয়ক ইতিহাস জানা ছিলনা। ভালোই হয়েছে। পদবী বাদ গেছে। কারণ এখন জানি বাংলার ইতিহাস, বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম-ব্রিটিশ ধারা পেরিয়ে আমার আসল পদবী আদৌ কী তা বের করতে আরেকটি গবেষণা দরকার। এ নিয়ে রাজনীতি ও সমাজনীতিও কম না। ইংরেজদের ফ্যামিলি নেইম খুব জরুরী। আমাদের দেশে দু ধারাই বহাল আছে। হালে অনেকেই এসব পদবী নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তবে পরিচিত অনেককেই দেখি পদবী দেখে শ্রেণী নির্ণয় করে তারপর আত্মীয়-সম্বন্ধ করতে আগ্রহী হয়।
আমার নামটাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।মনে প্রাণে লেগে আছে এ নাম। শুধু আমি ভালোবাসি তা নয়। হয়তো অনেকেই ভালোবাসে। হয়তো আমি জানিনা। এমনও হতে পারে আরও অনেকের মনেই আমার নাম খোদাই করা আছে। কবে কখন কার হৃদয়পটে কীভাবে খোদাই হয়ে গিয়েছে কে তার খবর রাখে। সেসব হৃদয়পট কোথায় কী করে আঁকা হয়েছে সে নিয়ে ইতিহাসবিদ বা প্রত্নতত্ত্ববিদরাও আনাগোনা করে বের করতে ব্যর্থ হবে হয়তো ।সেদিকে আর না যাই। কতকিছুই তো আমাদের অজান্তেই হয়ে যায়।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )