লুঙ্গির মাজেজা
লুঙ্গির মাজেজা।
……………….
যদিও থাকি অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন সিটিতে। তবু লুঙ্গি নিয়মিত পরি আমি। ঘরেতো সারাদিনই পরি। বাইরেও যাই কভু কভু। এ নিয়ে ছেলে ও মেয়ে অস্বস্থিতে থাকে আর বিব্রত হয়। ছেলের বন্ধুরা এলে আমি যেন দরজা খুলতে না যাই, আমি যেন বাচ্চাদের আনতে বিকেলে পার্কে না যাই লুঙ্গি পরে। তাতে নাকি তাঁদের মানসম্মান থাকেনা। কিম্ভূতকিমাকার (weird) লাগে আমায় তাদের চোখে। আমি ওদের লুঙ্গির ঐতিহ্য নিয়ে লেকচার দেই। উদাহরণ দেই। ওরা আধা শুনে আাধা না শুনে হাসে। প্রশ্রয়ের হাসি হেসে মেনে নেয়।
আমার ভালোই লাগে। আমি লুঙ্গি পরে পাশের বাজারের দোকানে যাই। আশেপাশে হাঁটি। বিদেশীদের তাকানো ও অভিব্যক্তি সন্তর্পনে খেয়াল করি। ওরা তো জানেনা লুঙ্গি কত আরামের জামা। অন্তত এটা জানুক যে লুঙ্গি নামে একটা ড্রেস আছে। ওটা দেখতে কীরকম। ওটা পরে কীভাবে হাঁটতে হয়, ইত্যাদি। মার্কেটিং এর ছাত্র আমি লুঙ্গির ব্রান্ডিং করি, মার্কেটিং করি, নতুন জায়গায় পন্য উদ্বোধন করি। আমি সগর্বে লুঙ্গি পরি। আমি বড় কেউ হলে অস্ট্রেলিয়ার বড় কোন অনুষ্ঠানে গিয়ে লুঙ্গি পরে ভাষণ দিতাম।
লুঙ্গির সাথে দেশপ্রেমের সম্পর্ক সরাসরি। যার লুঙ্গি পরতে অস্বস্তি লাগে তার বাংলাদেশের অনেক কালচারেই অস্বস্তি লাগে। লুঙ্গিকে
যে ভালোবাসে মানে হলো সে বাংলাকেই ভালোবাসে। কারণ বাংলার যেমন রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, তেমনি লুঙ্গিরও রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। যে লুঙ্গির প্রতি অনীহা দেখাতে পারে, সে যে ধীরে ধীরে বাংলার অন্য্ ঐতিহ্যকে অবহেলা করবেনা……..এবং এভাবে পুরো বাংলাকেই ভুলবেনা তার নিশ্চায়তা কি? লুঙ্গি চেতনা তাই দেশপ্রেমের চেতনার মতোই জরুরি।
সেই বাল্যকাল থেকে লুঙ্গি পরি। লুঙ্গি পরে লুঙ্গির অনেক ব্যবহার করেছি। আম কুড়িয়ে লুঙ্গির কুর্চাতে রেখেছি, আমের কষে সাদা লুঙ্গি ধুসর হয়ে গেছে। জাম কুড়িয়ে লুঙ্গিতে রেখেছি, জামের রক্তে লুঙ্গি রঙিন হয়ে গেছে। গাব কুড়িয়েছি, বড়ই কুড়িয়েছি, মেথতুইন বা বেতফল কুড়িয়েছি, সীম কুড়িয়েছি আরও কত কী। ফসলও কুড়িয়েছি, ধান, গম, আলু, মরিচ, কী নয়? সবচেয়ে মজার বিষয় প্যাককাঁদায় মাছ ধরে সে মাছ লুঙ্গির কুর্চায় রেখেছি, শিংমাছ রেখে সেই শিং মাছের গুতোও খেয়েছি, ব্যথায় কাতরেছি,তবু লুঙ্গির প্রতি প্রেম এতটুকু কমেনি।
হালকা শীতে কাঁথা বা লেপ পাওয়া না গেলে হাতের কাছে লুঙ্গি গায়ে দিয়ে ঘুমানোর আরাম পাঁচতারা হোটেলেও পাওয়া যাবেনা। লুঙ্গির কাছা মেরে কত বার নদী, খাল আর নালা পেরিয়েছি তার কোন হিসেবে নেই। এখানেই প্যান্টের উপরে লুঙ্গির সুবিধা। যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু কাছা মেরে নিতে পারেন। এবং আশেপাশে কেউ না থাকলে বা দূরে থাকলে কাছার সীমানা কতদূর নিবেন তা কেবলি আপনার ইচ্ছা। লুঙ্গি দিয়ে চেয়ার পরিস্কার করা, পার্কের বেঞ্চি পরিস্কার করা কিংবা হাত মুছা ও মুখ মুছার মতো কত কত কাজ অনায়াসে করা যায়- তা লুঙ্গি যারা পরেনা তারা জানবেনা। কাছা মেরে কত খেললাম হাডুডু বা দাড়িয়াবান্ধা!
লুঙ্গি অনেকেই পরতে পারেনা। লুঙ্গি খুব বেশি টাইট করে পরলে ব্যথা পাওয়া যাবে। পেটে ও কোমরে। আবার খুব হালকা করে পরলে খুলে গিয়ে ইজ্জতের বারোটা বাজতে পারে। তাই লুঙ্গি পরা হলো প্রেমের সম্পর্ক বা বন্ধনকে ধরে রাখার মতো। যে ভালো করে যথাযথ গিট দিয়ে সুন্দর করে লুঙ্গি পরতে পারে সে প্রেমের বন্ধনও ধরে রাখতে পারে। সে সমাজ ও সংগঠনও ভালো চালাত পারে। টাইটও দিবেনা আবার ঢিলও দিবেনা। সব যথাযথ হবে।
এসব যথাযথের মাঝে অযথা কাজও করে লুঙ্গি। কত বিলিয়ন বিলিয়ন ভ্রুণ শুকিয়ে থাকে এ লুঙ্গিতে তা কেউ জানেনা কেউ জানেনা!
বাংলাদেশে যত হিরোই আসুক মাওলানা ভাসানী বা শেখ মুজিবের মতো জনপ্রিয় বা কারিশম্যাটিক হিরো আসবেনা। তাঁরা খুব সুন্দর করে লুঙ্গি পরতেন। কিংবা তাঁরা যেভাবেই লুঙ্গি পরুকনা কেন তাতে তাঁদের মর্যাদার কোন কমতি আজ অবধি হয়নি। ভবিষ্যতেও হবেনা। তার মানে লুঙ্গি পরলেই আপনার ভাব কমে গেলো বা নায়কোচিত মেজাজ নষ্ট হলো এমন ধারণা পোষণকারী মাত্রই আনস্মার্ট। আপনারা হয়তো দেখেছেন ড্যান মজিনার সাথে আমার একটা ছবি আছে মতলবে। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে হাসতে হাসতে আয়েশ করে ছবি তুলেছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এজন্য আমি ছবি তুলিনি। তিনি লুঙ্গি প্রেমিক, লুঙ্গি নিজে পরতেন- এটা জানার পর থেকেই তাঁর প্রতি আমার আলগা প্রেম দেখা দিয়েছিল।
নেপাল, ভূটান, বার্মাসহ অনেক দেশে রথি মহারথিরা লুঙ্গি পরে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হয়। আর আমাদের কতিপয় আজাইরা স্মার্ট গায়ে মানেনা আপনি মোড়ল লুঙ্গি দেখলেই নাক সিঁটকায়। গেলো গেলো রব তুলে। প্রশাসন ক্যাডারে তো লুঙ্গি পরে কোন অনুষ্ঠানে যাবেন- সে কথা চিন্তাই করা যায়না। ব্রিটিশরা আমাদের অনেককে পুরাই ব্রিটিশ বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
যাই হোক। আশা করি আমার এ ছবি দেখার পর কিংবা এ লেখা পড়ার পরে হাসতে হাসতে আপনার লুঙ্গির গিট খুলে যায়নি।
লুঙ্গির জয় হোক। লুঙ্গি পরার আরামের মতো সকলের জীবন আরামের হোক।
.
ড. সফিকুুল ইসলাম, ৩০ আগস্ট ২০২২।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )