সরো অবাক, ভেবে পায়না সে; চোস্ত ইংরেজি বুঝে স্যার, অশ্রু বোঝেনা ক্যান?
ক্লাসের সবাই আনন্দ করছে। সরো মন খারাপ করে বসে আছে। পরের ক্লাসটি হু স্যারের। স্যার লুঙ্গি পড়ে স্কুলে আসা সহ্য করেননা । কিন্তু সরো আজও প্যান্ট পড়ে আসে নি।লুঙ্গি পড়ে এসছে।শুধু আজকে আসছে তা নয়; প্রতিদিনই আসে। একটিমাত্র লুঙ্গি। তাই তার বুক ধরফড় করছে।হু স্যার হনহন করে ক্লাসে ঢুকলেন। হাতে ঝালি বেত ধরা। পুরো ক্লাশে নিস্তব্ধতা নেমে এল।এতক্ষণ ক্লাসজুড়ে যে শোরগোল ছিল তা নিমিষেই উবে গেল। একেবারে পিনড্রপ সাইলেন্ট যাকে বলে তা। সদা পরিপাটি ইংরেজি শিক্ষক হু স্যার। ক্লাশের নিয়ম কানুনে বড়ো কড়া। তার ক্লাশে কোন ছাত্র ফুল প্যান্ট না পড়ে আসতে পারবে না। তিনি নিজে শুধু প্যান্ট পড়েন তা নয় শার্ট প্যান্ট জুতো মিলিয়ে সবসময় তকতকে ঝকঝকে একটা ভাবে থাকেন। নিজেকে স্মার্ট ভাবেন।কোকরানো চুল সাজিয়ে আচড়ান। ক্লাশে ঢুকেই ইংরেজিতে কথা বলেন। খুব ভালো বলেন তা নয়। তবে ক্লাশ এইটের ছাত্ররা তো আর ভুল ঠাহর করতে পারেনা। তাই সমস্যা নেই। তবে এটা ঠিক যে তাঁর চাইতে ভালো ইংরেজি গাঁয়ের আর কেউ হয়তো পারেন না। এ নিয়ে তাঁর অহমটা চোখে পড়ার মতো।স্যারের মূল নাম হু নয়। ক্লাসের ছেলেরা কোন দুষ্টুমি করলেই হু ইজ দিস? হু? হু? হু? বলে এমন চিৎকার করে যে কান ঝালাপালা। বারংবার হু হু করায় ছেলেদের কাছে এটি হাস্যকার শুনায় তাই সবাই স্যারকে এখন হু স্যার নামেই ডাকে। হু স্যারকে সরোর খুব পছন্দ। কত স্মার্ট! অন্য স্যারদের মতো ঝিমানো টাইপের না। সবসময় সতেজ ও প্রাণবন্ত। সবকিছুতে টিপটপ। এলাকায় হু স্যার নামেই তিনি অধিক পরিচিত।ক্লাসে ঢুকেই তিনি আরাম করে চেয়ারে বসলেন।তাঁর শ্বাস উঠানামায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি শশুর বাড়ি থেকে দশ মিনিটের পথ হেঁটে আসতে গিয়ে হয়তো হাপিয়ে উঠেছেন।হ্যাঁ তিনি শশুর বাড়িই থাকেন। সকাল থেকে ৪/৫টি ব্যাচ পড়িয়ে এসছেন। কপালে চিকন ঘাম। চেহারায় একটা কাঠিন্য ভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি কি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন নাকি হাঁটার ক্লান্তিতে চেহারার এ অবস্থা তা পরিস্কার নয়।খাটো মানুষ চেয়ারে বসায় টেবিলের জন্য দেখা যায়না প্রায়। তাই চেয়ার থেকে উঠে এসে টেবিলের উপরেই বসেছেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লাসের সবাইকে দেখছেন। সরো খুব ভয় পাচ্ছে।সাধারণত সে ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসলেও আজ ক্লাসের মাঝখানে পাঁচজনের লম্বা বেঞ্চের মধ্যিখানে বসেছে।যাতে স্যার দেখতে না পান।সরোর বিশ্বাস স্যার তাকে মারবেন না। স্যার প্রথম যেদিন ক্লাস নেন সেদিন সেই একমাত্র ছাত্র যে কিনা লেসন ৭ এর পুরো গল্পটা স্পষ্ট করে রিডিং পড়ে জোর উচ্চারণে শুনিয়েছিল। স্যার সেদিন খুব খুশি হয়েছিল।নিশ্চয়ই স্যার সেটি ভুলে যাননি।না না নিশ্চয়ই ভুলে গেসেন। এর আগেও প্যান্টের জন্য তিনদিন তাকে বেত্রাঘাত করেছেন। স্যার চিকন তিক্ষ্ণ সুরে ইংরেজিতে শুরু করলেন। ইজ দেয়ার ইনিওয়ান হু হেজ নট ওয়ের্ড প্যান্ট টুডে? স্যার বলার সাথে সাথে আওয়াজটি পুরো কক্ষময় ছড়িয়ে পড়লো। পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ।এত নিস্তব্ধ যে স্যারের বলার আওয়াজটি দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে সকলের কানে পুনঃ বাজলো। সবাই এদিক ওদিক দেখছে। স্যারের চোখও পিটপিট করে দেখছে আর খুঁজছে। সরোর পাশের কয়েকজন তার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল দেখে স্যারের দৃষ্টিও নিবদ্ধ হলো তার উপর। ভয়ে ভয়ে উঠে দাড়ায়। স্যার রেগে ফেটে পড়লেন। মুখে চিৎকার করে বললেন “হাউ ডেয়ার ইউ! কনজিকিউটিভ থ্রি ডেইজ ইউ আর নট ফলোয়িং মাই অর্ডার।” বলতে বলতে স্যার তার দিকে ত্যাড়ে আসলো। কালো তুফানের বেগে। এসেই খপ করে তার ডান হাতের বাহুটা শক্ত করে ধরলো। সরোর মনে পড়লো মায়ের গল্পের দৈত্যর কথা যে কিনা পরীর ডান হাতটা এভাবেই ধরেছিল।রাগে স্যারের কান মুখ লাল হয়ে গেল। হাতের বেত দিয়ে সরোকে বেত্রাঘাত শুরু করলো।সপাৎ সপাৎ। বেত্রাঘাতে সরো অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। সারা শরীর মোড়ামোড়ি করছে। কিন্তু বেত্রাঘাত থামেনি। পিঠ ও হাতের কোন স্থান বাদ যাচ্ছে না।সপাৎ সপাৎ। মারছে আর চিৎকার করে প্রশ্ন করছে কেন তুই প্যান্ট পড়ে আসিস না? হোয়াই নট? হাউ ডেয়ার ইউ? পুরো ক্লাস স্তব্ধ হয়ে শুধু দেখছে। সরোর দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। অঝরধারায় বহমান ঝরণার মতো। এত জল এ ছোট চোখে কোথা থেকে আসে সরো বুঝতে পারে না। চোখের জলের মধ্যে প্যান্ট না পড়ে আসার কারণ দেখতে পারার কথা শিক্ষকের। কিন্তু স্যারের সে হিতাহিত জ্ঞান নেই এখন। যতই মারছেন ততই রাগ বাড়ছে স্যারের। সরো মুখ না খোলায় আরও রেগে যাচ্ছেন স্যার। কোন উত্তর না দেয়ায় এটাকে স্যার তাচ্ছিল্য বা বেয়াদবি হিসেবেই দেখছেন।এতে আগুনে ঘি ঢালার মতো রাগের আগুনে জ্বলছে স্যার। আর সরোকে পেটাচ্ছে। গরুপেটা।সরো কিছুই বলছে না। স্যারের ক্লান্তি হওয়া অবধি বেত্রাঘাত চলেছে। সরোর দুগাল বেয়ে অশ্রু বহমান। এরপরেও ক্লাসের বাকি সময়টা সরোর চোখের জল বন্ধ হয়নি। হেচকি উঠে উঠে আবেগ উথলে উঠছিল।লজ্জা আর অপমান তাকে আরও নাজুক করে দিয়েছিল। সব কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছিল। ক্লাস শেষে ফেরার পথে ভেবে পাচ্ছেনা সে বিষয়টি কাকে বলবে। এ বেত্রাঘাতের কথা কাকে বলা যায়।স্যার কি আগামীকাল আবার মারবেন? এর পরের দিন? তার পরের দিন? স্যারের প্রশ্নের কী উত্তর দিবে সে? ভেবে পায় না। ভেবে না পেয়ে সব রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট ধলা হয়ে জমে বুকের ভিতর। কান্না হয়ে বেরিয়ে আসে। দুগাল বেয়ে বেয়ে গ্রামের মেঠোপথ ভিজে যায়।সরো অবাক, ভেবে পায়না সে; চোস্ত ইংরেজি বুঝে স্যার, অশ্রু বোঝেনা ক্যা?
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )