জাপানে সুনামি: প্রবাসে আমরা উদ্বিগ্নতায়
সরকারী কর্মচারী হিসেবে আইলা ও সিডর প্রত্যক্ষ করেছি। দূর্গত এলাকায় জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসনের দ্বায়িত্বও পালন করেছি।কিন্তু এমন আতঙ্ক আর উদ্বিগ্নতা চোখে পড়েনি। সারা জাপানে চাঁপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। উদ্বিগ্ন জাপানে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা, অন্যান্য প্রবাসীরা, এমনকি জাপানীরাও। এক সপ্তাহ হতে চললো, থেমে থেমে ভূমিকম্প কাঁপিয়েই চলেছে। টোকিওর এক বাঙ্গালী বন্ধু বলছিলো- “কাঁপুনি খেয়ে জীবনের মায়ায় আট/দশ তলা থেকে দৌড়ে নেমে বাইরে বের হওয়া আবার উপরে উঠা যেন রোটিন হয়ে গেছে”। আমার অবস্থান ওসাকাতে ভূমিকম্প কম হলেও আতঙ্ক কম নয়। একেকবার ভূমিকম্প আাসে আর স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান নিয়ে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করি। আমার মেয়ের তো ভয়ে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বুক ধরফড় করা সময় পার করছি এখন। ভূমিকম্প ও সুনামির সাথে যোগ হয়েছে নিউক্লিয়ার তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস পাওয়া যাচ্ছেনা সুনামি আক্রান্ত জেলাগুলিতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়ে দোকান বা সুপার মার্কেট খোলা পাওয়া যাচ্ছেনা টোকিওর অনেক জায়গায়। ওসাকাতে যদিও বড় ধরণের কোন সমস্যা নাই তবুও গত রাতে ব্রেড কিনতে গিয়ে দেখি সবগুলি দোকান ফাঁকা। অনেক বাংলাদেশীদের কেউ দেশে চলে গেছেন, কেউ যাবার পূর্ণ প্রস্ততি নিয়ে রেখেছেন, কেউ পরিবার পাঠিয়ে নিজে জাপানের দক্ষিণের জেলাগুলিতে চলে গেছেন, কেউ বা চাকুরী বা সম্পদের মায়ায় জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে ঝুকিঁপূর্ণ স্থানেই রয়ে গেছেন। আমার জাপানী এক বন্ধু বলছিল-“তোমরাতো চলে যাচ্ছ নিরাপদে, আমরা যাবো কোথায়? আমরা আমাদের দেশেই মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবো”।তঁার চোখেমুখে কোন অসহায়ত্বের চিহ্ন দেখিনি দেখেছি দেশপ্রেম ও মাটির টান!আর আমি লজ্জা অনুভব করি আমাদের নিজেদেরকে স্বার্থপর ভেবে। কারণ জাপানের সুদিনে আসলাম আর দুর্দিনে সবাই চলে যাবার জন্য মরিয়া হচ্ছি। অবশ্য আমরা সাধারণের কি দোষ দেবো যেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেন দূতাবাস সরিয়ে নেবার? স্থানীয় সবগুলি টেলিভিশন ভূমিকম্প ও সুনামির ধংসযজ্ঞ দেখাচ্ছে একনাগাড়ে। সবাই দেখছে, বিষাদে আক্রান্ত হচ্ছে আর নিভৃতে চোখের পানি ফেলছে।
গতকাল সকালে আমার ফ্ল্যাট এর নিচতলার ৮৫ বছর বয়সী সিনোহারার সাথে দেখা, জাপানী ভাষায় কেমন আছেন জিজ্ঞেন করতেই তাঁর দুচোখ পানি টলমল করছিলো আর ঠোঁট দুটো কাঁপছিলো। সে জানালো যে তাঁর ছেলে কাজ করতো মিয়াগী জেলায় (সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা)। ভূমিকম্প ও সুনামির পর থেকে তাঁর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছেনা। টেলিভিশন দেখে আর এখানকার স্থানীয় জনগনের সাথে কথা বলে একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে তারা কেউ হাউমাউ করে কান্না করছেনা। এমনকি যাদের স্বজন নিহত হয়েছে তারাও না। ঘুমরে ঘুমরে কাঁদছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না লুকাচ্ছে, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ভেঁজা কন্ঠে কথা বলছে কিন্তু চিৎকার করছে না। আসলে এটাই জাপানীদের চরিত্র- অসম্ভব ধৈর্য আর মনোবলের অধিকারী এরা।বিপদে ভেঙ্গে পড়তে জানেনা, কর্ম আর দৃঢ়তা দ্বারা কঠিনকে সহজ করাই যে এদের ধর্ম।
আরেকটি অবাক করা ব্যাপার হলো এ দূর্যোগেও কোন লুটপাট হয়নি; আইন শৃংখলা বিঘ্নিত হয়নি।যুক্তরাষ্ট্রের হারিকেন কাটরিনা, হাইতি ও চিলির ভূমিকম্প, ইংল্যান্ডের বন্যাদূর্যোগ, বাংলাদেশের সিডর ও আইলা সবগুলিতেই কিছু লোককে আমরা লুটপাটে জড়িত দেখেছি। কিন্তু কেন জাপানে লুটপাট ঘটেনি? কারণ এটাই জাপানিজ সংস্কৃতি-দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদাবোধ, নিয়মানুবর্তীতা, পরিচ্ছন্ন ও সভ্য মনোভাব যে তাঁদের অন্তরে গাঁথা। আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে জাপানীদের থেকে।বাংলাদেশীদের বেশীরভাগই থাকেন টোকিওতে যারা তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে মারাত্মক সমস্যার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। আমি আমার পরিচিতদের ফোন করে বলেছি ওসাকা এলাকায় আমার বাসায় বা অন্য কোন জেলায় চলে আসার জন্য। ইতোমধ্যে বেশ কজন চলে এসেছেন। ভূমিকম্প কখন থামবে এটা কেউ নিশ্চিত করে বলছেনা, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ও এর প্রভাব নিয়েও সরকার সঠিক তথ্য দিচ্ছেনা। সরকার থেকে যেটুকু জানানো হচ্ছে সেটুকুও জনগণ বিশ্বাস করছেনা। একপ্রকার হতাশা আর অনিশ্চায়তার মধ্য দিয়েই নাগরিকদের দিন যাচ্ছে। জাপানের একতা ও নির্ভরতার প্রতীক সম্রাট আকিহিতোর বক্তব্যেও উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেলো। অবস্থা এমনি সঙ্কটময় যে লেখাটি সম্পন্ন করতে করতেও একবার ভূমিকম্প হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে গেলো!
সফিকুল ইসলাম, জাপান থেকে।(১৮/০৩/২০১১)
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )