শ্যামনিক্স : ইটালি-ফ্যান্স ও সুইজারল্যান্ড এর সম্মিলনস্থল
ইউরোপ ট্যুরের সেরা স্মৃতি শ্যামনিক্স ভ্রমন। জেনেভা থেকে বাসে যাবো। নিজেই টিকিট কাটলাম বাস এর। ২ ঘন্টা জার্নি। বাস চলছে তো চলছে। ঘন্টাখানিক চলার পরে যেখানে পৌঁছালো সেখানকার চারপাশে যেদিকে তাকাই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। আমি বাসের সামনের সিটে বসা। ছবি তুলতে থাকি। পরে ভিডিও করতে থাকি। পরে ফেসবুকে লাইভ দিয়ে দিই। মানে এত সুন্দর যে কীভাবে এ স্মৃতি ধরে রাখবো আর বন্ধুদের শেয়ার করবো বুঝে উঠতে পারছিলামনা। অনাবিল বৈচিত্র্যের এ রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম শ্যামনিক্স।
এটি হচ্ছে ইটালি, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড এর সংযোগস্থল। Chamonix-Mont-Blanc (usually shortened to Chamonix) মাউন্ট ব্ল্যান্ক নামে পরিচিত এটি। আল্পসের সর্বোচ্চ শিখর এখানে রয়েছে। ভূমি থেকে প্রায় ৫০০০ মিটার উপরে। সারাবছার স্কি করতে যায় পর্যটকরা আর ক্যাবল কার দিয়ে এর বিভিন্ন চূড়ায় নিয়ে যায় পর্যটনের লোকেরা। মাউন্ট ব্লাংক কে ইউরোপের ছাদ বলা হয়।
বাস থেকে নেমে মূল পয়েন্টে যাওয়ার পথ বুঝতে পারছিলামনা। লোকজন কম রাস্তায়। হাত ইশারায যতটুকু দেখায় তাতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যাই হোক এর মধ্যে নামলো বৃষ্টি। তুষারে চারপাশ শাদা। তার মধ্যে আবার বৃষ্টি। ঠান্ডায় জমে যেতে থাকলাম। খুব বেশি গরম কাপড়ও আনিনি। কারণ জেনেভাতে তেমন শীত ছিলনা। এ ট্যুরের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই বোঝা গেলো আমার। যাই হোক পৌঁছালাম মূল পয়েন্টে। টিকিট কাউন্টারে টিকিট কাটলাম রোপওয়েতে ক্যাবল কারে উপরে যাবো বলে। টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। আমার সামনে আরও প্রায় ১২ /১৩ জন। একটু পরেই বুঝলাম এ ১২ জন এক টিমের সদস্য। একসাথে ট্যুরে এসেছে। আমিই কেবল একা। কী আর করা মিশে গেলাম এদের সাথে। এদের বয়স ৪০-৬০ এর মধ্যে হলেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এরা এসেছে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে। এদের গায়ে পাতলা ফ্যাল ফ্যাল কাপড়। তবু এরা শীতে কাঁপছেনা। আর আমি শীতের কাপড় পড়া অবস্থায় কাঁপছি যেন। এদের এনার্জির কাছে আমি কিছুনা। হয়তো কিছু এলকোহল খেয়ে নিয়েছে এরা।
অনেকক্ষণ পরে আমাদেরকে চেক করে ঢুকতে দিল। ক্যাবল কার এক দফায় প্রায় ১০০০ মিটার উপরে উঠে গেলো। একটি স্থানে একটু থামলো আমাদেরকে ছবি তুলতে দিল। পরে সেই পাহাড়ের চূড়া থেকে আরও উপরে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি। ক্যাবল কার আবার চলতে শুরু করলো। পাহাড়ের ধাপে ধাপে শ্বেত পাথর আর তুষারের আবরণ দেখছিলাম নয়ন ভরে। সাথে রয়েছে আকাশে শাদা মেঘের ভেলা। সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে নিজে শীতের কথা ভুলে গেলাম। দেখছি আর ছবি তুলছি, ভিডিও করছি। সেই সাথে আমেরিকা থেকে আসা ১২ জনের সাথে গল্প করছি। এরাও আমাকে একা পেয়ে লুফে নিল। এরা সবাই বাংলাদেশ চিনে, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে জানে। বাংলাদেশে বন্যা হয় সেই খবরও জানে। আমি এদেরকে বাংলাদেশে আসার দাওয়াত দিলাম। কথা বলতে বলতে আমিও তাঁদের টিমের অংশ হয়ে গেলাম।
ক্যাবল কার চলতে চলতে আরও অনেক উপরে নিয়ে আসলো অন্য আরেকটি পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে কিছুক্ষণ বিরতি দিল। বাতাস, বৃষ্টি, তুষারের তুখোর আগ্রাসী মনোভাব চলছে। এরই মাঝে আমাদের ক্যাবল কারেরও যাত্রা চলছে তো চলছেই। ৪/৫ রাউন্ডে এত উপরে নিয়ে এসেছে যে মনে হচ্ছে আকাশের ঠিকানায় চলে গেছি আমরা। আর ফিরতে হবেনা! ক্যাবল কারটি আমাদেরকে ৪০০০ মিটার উপরে নিয়ে গেলো। তীব্র শীত, তুষারপাত, শাদা মেঘের ভেলা, পাহাড়ের গায়ে শ্বেত পাথরের খেলা আর উচ্চতার ভীতি আমাকে অন্যরকম অনুভূতিতে নিয়ে গেলো। ভয় মিশ্রিত এক রোমাঞ্চকর ভ্রমন অনুভূতিতে হারালাম বলতে হবে। আমার সাথের ১২ জনের সক্রিয় চলাফেরা, হাসাহাসি, ও উইট আমাকে ব্যস্ত রেখেছে। আনন্দ দিয়েছে।
উঠার সময় যেরকম আনন্দ পেয়েছি, শিহরণ লেগেছে, সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। নামার সময় তেমনি সব লেগেছে। নামার পরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি। পথ হারিয়ে অনেক ঘুরে বাস স্টপে আসলাম। আমার ফিরতে দেরি হওয়ায় শেষ বাস মিস করলাম। আমি কী ভাবে জেনেভা ফিরবো এ চিন্তায় উদ্বিগ্ন হলাম। দাঁড়িয়ে আছি যদি কোনো বাস আসে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কোনো বাস আর আসবেনা। মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত কার আসে যায়। অনুরোধ করি আমাকে নিবে কিনা, তারা জেনেভা যাবে কিনা। কিন্তু কেউ নেই যারা জেনেভা যাবে। কারণ এ জায়গা থেকে ফ্রান্স যায়, ইটালি যায়। আরও নানান জায়গার বাস বা গাড়ি আছে। আমার ভয় ও দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো। অনলাইনে উবারের মতো কিছু খুঁজতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু নেটওয়ার্ক দুর্বল থাকার কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছিলনা। এরই মধ্যে একটি মাইক্রোবাস আসলো। অনেকে নামছে। আমি দৌঁড়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম জেনেভা যাবে কিনা। বললো যাবে তবে যাদের আগের থেকে টিকিট বুকিং দেওয়া শুধু তাঁদের নিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম ১২ জন লোক আসলো। তাঁদের সবার টিকিট আগে থেকে বুকিং দেওয়া। তাঁরা উঠে গেলো। আমি ড্রাইভারকে বলছিলাম। ড্রাইভার বললো যদি ফাঁকা থাকে তবে তোমাকে নিতে পারবো এখন টিকিট কেটে। যদি আগেই সব বিক্রি হয়ে থাকে তবে তুমি যেতে পারবেনা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর জানা গেলো যে দুটো সীট ফাঁকা । পরে আমারে ডাকলো। আমি টিকিট কেটে উঠে গেলাম।
বড় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলাম। কারণ আমার পরের দিনের সব প্রোগ্রাম ঠিক করা। একটি মিস হলে পরের সব গুবলেট হয়ে যাবে। বাসে বসার কিছুক্ষণ পরে ফোন দিল আমার বন্ধু আলমগীর কবীর। যিনি এখন জেনেভাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে আছেন প্রথম সচিব (কমার্স) হিসেবে। রাতে ওর সাথে থাকবার কথা। আমি বললাম আরও দেড় ঘন্টা পরে পৌঁছাবো জেনেভা স্টেশনে। সেই মতো রাত প্রায় ৯টার দিকে পৌঁছলাম জেনেভাতে পুনরায়। বন্ধু আলমগীর স্টেশনে এসেছে গাড়ি নিয়ে। আমি স্টেশনে নেমে সকালে রেখে যাওয়া লাগেজ সিকিউরিটি লক থেকে বের করে গেলাম আলমগীরের কাছে। পরে গাড়িতে করে নিয়ে গেলো জেনেভার অফিস পাড়ায়। বেরিয়ে পড়লাম জেনেভার অফিসিয়াল Area টা একটু ঘুরে দেখতে। এখানে United Nation অবস্থিত। United Nation এর প্রধান শাখা অফিস জেনেভায় অবস্থিত। এটা UN (জাতিসংঘ) এর প্রধান কার্যালয়ের বাইরে সবচেয়ে বড় দায়িত্বশীল Station। একে ইউরোপের প্রাণ বলা হয়। এখানে কমপক্ষে ১৬০০ স্টাফ কাজ করে।
United Nation এর বাইরে সামনে চৌরাস্তার পাশে অর্থাৎ UN এর Gate এর ঠিক সামনে Land Mines ও Clusterbomb এর ব্যবহারের বিপক্ষে প্রতিবাদ স্বরূপ একটি পা ভাঙ্গা কাঠের চেয়ারের স্মৃতিসৌধস্বরূপ ভাস্কর্য্য রয়েছে। এটি সুইস শিল্পী “Daniel Berset” এর করা। এটা ৫.৫ টন কাঠের তৈরি এবং এর উচ্চতা বার মি: (৩৯ ফুট)। মূলত জেনেভা পরিদর্শনে আসা রাজনীতিবিদদেরকে তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। জেনেভার অফিসিয়াল এলাকা ঘুরতে ঘুরতে আমাদের প্রায় রাত দশটা বেজে যায়। সেখানে জাতিসংঘ হেডকোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বললাম। ছবি তুললাম। সেই সাথে দুই বন্ধুর পুরনো আলাপ চলতে থাকলাম।
পরে বাসায় নিয়ে গেলো। ভাবীর সাথে পরিচয় হলো। ভাবী অনেক রান্নার আয়োজন করে রেখেছেন। ইয়াম্মি সব রেসিপি দিয়ে ডিনার শেষ করে ঘুমাতে গেলাম। আলমগীর আর ভাবীর আপ্যায়ন ও আতিথিয়েতার কথা কখনো ভুলবোনা। জীবনের একটি সেরা দিন, বা অবিস্মরণীয় দিন কাটলো বলা যায়।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )