বুদ্ধিজীবিতা কী?
সহজভাবে বললে, নিজস্ব কর্ম, শিক্ষা, জীবনাদর্শ কিংবা দর্শনবোধের মাধ্যমে যারা সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন তাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী (Intellectual) বলা হয়। যে কোন ঘটনা, তার বিভিন্ন দিক, তার কার্যকারণ বোঝার একটি সহজাত ক্ষমতা থাকে বুদ্ধিজীবীদের। তাঁরা গভীরভাবে, তলিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম, ও তা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।
.
মোদ্দা কথা বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যমান বিষয়াদিকে নানান দিক থেকে বিশ্লেষণই শুধু করেন না। এর ভিতরে বাহিরে নতুন বাঁক তৈরি করেন, ভেংগে চুড়ে নতুন দিকের সন্ধান দেন, অনুসন্ধান করে সত্যকে বের করে এনে নাগরিকদের মাঝে তুলে ধরেন। সাধারণরা যা বুঝতে পারেন না, ধরতে পারেন না, বুদ্ধিজীবীরা সেটাও ধরতে পারেন। বিষয়ের খুঁটিনাটি উপলব্ধি করে কার্যকারণ চিন্তা করে নতুন পথ, নতুন দিগন্ত, নতুন সৃষ্টির ইংগিত দেন।
.
বাংলার দিকে তাকালে প্রাচীন ও মধ্যযুগে বুদ্ধিজীবী বলতে হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগের যাজকদেরই বোঝানো হতো। আফগান ও মুগল আমলে সুলতান সুবাদারদের ফোকাসে আধ্যাত্মবাদী ও সুফিবাদীদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। ইংরেজ আমলে বেনিয়া বা মধ্যস্থকারীদের মধ্য থেকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তৈরি করা হয়েছিল। বিশশতকে পূর্ববাংলার মুসলমানরা বুদ্ধিজীবীদের দলে নিজেদের অন্তর্ভূক্ত করতে এগিয়ে আসে। মোটাদাগে শক্তিশালী বণিক শ্রেণী, সংবাদপত্রজগত, আর শাসকশ্রেণীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছত্রছায়ায় বুদ্ধিজীবী শ্রেণী নাম কামায়। কেউ বেশি গুরুত্ব পায়, কেউ কম গুরুত্ব পায়। গুরুত্ব পাক বা না পাক বুদ্ধিজীবীরা তাঁর কাজ দিয়েই বুদ্ধিজীবী।
.
বুদ্ধিজীবী কে হবেন না হবেন তা বুদ্ধিজীবীরা নিজেরাও ঠিক করেন। আবার প্রায়শ: ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, মিডিয়া, দেশ বিদেশের নানান সংস্থা মদদ দেন। অতীতেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
.
কেউ একজন বললো নিজেকে নিজে বুদ্ধিজীবী, তাতেই কেউ বুদ্ধিজীবী হয়ে যাবে- তা হয়তো না। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়- এর মতোই বাস্তবতা। আবার পুঁজিবাদ, মার্কেটিং আর স্বার্থের দুনিয়ায় গুটিবাজির খেলার মাধ্যমে অনেক সময় ছোট জিনিসও বড় করে দেখানো হয়। সেসব খেলায় ‘বুদ্ধিজীবীও‘ বাদ যায় না।
‘‘খেলিছ বিশ্বলয়ে বিরাট খেলা আনমনে…।‘‘ বিধাতা খেললে তাঁর সৃষ্টি খেলবে না?
-ড. সফিকুল ইসলাম, ২০২০
……………..
সমাজের অনেকেই বুদ্ধিজীবী, কিন্তু সবাই তাঁর বুদ্ধিজীবীতা দিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রে প্রভাব ফেলতে পারে ন। সুতরাং কে বুদ্ধিজীবী আর কে না তা নিয়ে সমাজের সকল শ্রেণীর মধ্যে একটা খেলা চলে, বিশেষ করে সচেতনমহলে বা প্রভাবশালী মহলে।
.
প্রথমেই বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে দুটো হালকা রসিকতা শেয়ার করি। ‘‘ সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করার পরে দেখলেন কিছু মসলা এখনো গামলায় পড়ে আছে। এবার কি করা? তো উনি এর মধ্যে আরো কিছু আটা আর হলুদ যোগ করলেন। তারপর তিন ব্রহ্মদিন ধরে দলাইমালাই এর পর যে জীবগোষ্ঠীকে সৃষ্টি করলেন এদের নাম দিলেন বুদ্ধিজীবী।‘‘
.
আরেকজন বলেছেন ‘‘আচ্ছা, কত জিবি বুদ্ধি থাকলে একজন মানুষকে বুদ্ধিজীবী বলা যায়?‘
হালকা আলাপ বাদ, সিরিয়াস মুডে আসি
Intelligentsia শব্দটি রাশিয়া থেকে উনিশ শতকে উতপত্তি হয়। Oxford English Dictionary শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে: ‘The class consisting of the educated portion of the population and regarded as capable of forming public opinion.’ (এমন একটি সম্প্রদায় যা জনসংখ্যার শিক্ষিত অংশ দ্বারা গঠিত এবং যারা জনমত সৃষ্টিতে সক্ষম)। ব্রিটেনে চ্যাটারিং ক্লাস বা বাচাল শ্রেণী বলে আখ্যায়িত করে এ শ্রেণীকে!
………..
‘‘বুদ্ধিজীবী সহজ কথাটাকে কঠিন করে বলে, আর শিল্পী কঠিন কথাটাকে সহজ করে বলে।‘
চার্লস বুকস্কি।
.
‘‘বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যিনি যা জানেন তার চাইতে বেশি শব্দ খরচ করেন।‘‘
আইজেন হাওয়ার
.
‘‘বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যার মন নিজে নিজেই দেখে।‘‘
আলবার্ট কামুস
.
‘‘বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যিনি সাইকেল কীভাবে পার্ক করতে হয় জানেন না।‘‘
স্প্রিও আগ্নেয়
.
ট্যারি আগ্লেটন বলেছেন ”বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যিনি ক্ষমতাবানের কাছে সত্যটা বলে।” কিন্তু নোয়াম চমস্কি এটা বাতিল করে বলেছেন যে ‘ক্ষমতাবনরা সত্য অলরেডি জানে, তারা ব্যস্ত সত্য লুকোনোতে। সুতরাং অত্যাচারিতদের কাছে সত্য তুলে ধরাই বুদ্ধিজীবীদের কাজ।”
.
বাণীগুলোর ভাবানুবাদ: ড. সফিকুল ইসলাম
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )