আইসক্রিমওয়ালা ও আইন
আইসক্রিমওয়ালা ও আইন
-ড. সফিকুল ইসলাম
…………
”(অশ্রাব্য গালি….) ম্যাজিস্ট্রেটের বাচ্চা ম্যাজিস্ট্রেট! কয় টাকা দরকার তোর !? চাইলেই দিয়ে দিতাম! গরীবের পেটে লাথি দিতে তোর দিল একটুও কাঁপলনা? আমারে তুই পথে বসিয়ে দিলি!? বউ বাচ্চা নিয়ে কই যামু! ” রাগে ক্ষোভে যা মুখে আসে তাই বলে যাচ্ছিলেন আইসক্রিম ফ্যাক্টরীর মালিক জনাব মোতালেব। চোখে কোন পানি নেই, রাগে অগ্নিশর্মা মোতালেবের চোখ দিয়ে আগুনের ফুল্কি বের হচ্ছে। পাশেই তার বউ জোসনা বসে বসে বিলাপ করছে। সঙ্গে দাড়িয়ে থাকা ৫ বছরের বাচ্চাটা ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গেছে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছেনা।
একটা জীপ গাড়ী আসলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নামলেন। সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ ও অন্যান্য অফিসার ও স্যানিটারী ইন্সপেক্টরসহ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ফ্যাক্টরীতে (গলির মধ্যে্ বাশের তৈরী খুপরী ঘর) ঢুকেন। দেখেন, ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ড্রাম ভর্তি পানি, বিভিন্ন ধরণের রং, সেকারিনের প্যাকেট, ও বাশের তৈরী আইসক্রিম-স্টিক/ ময়লা-আবর্জনার তীব্র গন্ধ, স্যাতস্যাতে মেঝে, ও ভয়ানক নোংরা পরিস্থিতি! ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মোতালেবকে একে একে অনেক প্রশ্ন করেন “আপনার পড়াশোনা কতদূর?, আইসক্রিম বানানো বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ আছে কিনা? ব্যবহৃত পানি, রং, ও সেকারিন স্বাস্থ্যসম্মত কিনা, শিশু-খাদ্য তৈরীর কোন অনুমতি আছে কিনা? ট্রেড লাইসেন্স আছে কিনা? যারা ভিতরে কাজ করেন তাদের সকলের সিভিল সার্জন থেকে প্রত্যয়ন আছে কিনা? কর্মী সকলে হ্যান্ড-গ্লাভস, পরিস্কার পোষাক ব্যবহার করেন কিনা? প্যাকেটের গায়ে ফ্যাক্টরীর নাম, ঠিকানা, মেয়াদ, ইনগ্রেডিয়েন্ট উল্লেখ আছে কিনা? এ আইসক্রিম খেলে শিশুদের অনেক ক্ষতি হবে তা কি আপনি জানেন? মোতালেব নির্বাক রয়েছেন। কোন কথা বলছেন না। কারণ এর আগেও তাকে দুবার জরিমানা করা হয়েছে। তখনো সে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি এবং পরিবেশের কোন উন্নতি করতে পারেনি। সে ভেবেই নিয়েছে আবারো জরিমানা হবে। ম্যাজিস্ট্রেটেরতো টাকার দরকার! ম্যাজিস্ট্রেটকে যে ডিসিআর বহির টাকা সম্পূর্ণ সরকারের কাছে জমা দিতে হয় তা তো আর মোতালেবরা জানেননা! কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এবারে আর জরিমানা করলেন না। সবাইকে ফ্যাক্টরী থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। মালামালের জব্দ তালিকা করে এত সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর নিয়ে পিয়নকে আদেশ দিলেন ফ্যাক্টরীটি সীলগালা করার জন্য। বাস! ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে গেলো।
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে মোতালেব পাড়ি জমায় রাঙ্গামাটিতে। আশির দশকে প্রতিবেশীর কাছে শুনে সে রাঙ্গামাটিতে আসতে আগ্রহী হয়। বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার চলছিলনা তার। সংসার থেকে পালানোর উদ্দেশ্যেই তার এ যাত্রা। এ রাঙ্গামাটিতে এসে তার থাকার জায়গা নেই। প্রথমেই সে আইসক্রিম ফেরী করে বেড়াতো । আইসক্রিম ফেরী করতে করতে তার পোষাচ্ছিলনা। সে ভেবে দেখলো, শুধু পানির মধ্যে রঙ মিশালে আর সামান্য সেকারিন মিশিয়ে আইসক্রিমের সাচে ফেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেই আইসক্রিম। যার প্রায় পনের আনাই লাভ! এমন কাঁচা টাকা ! তাই একদিন আইসক্রীম ফ্যাক্টরী দিয়ে শখ মেটালো। একটি খুপরী ঘর ভাড়া নিয়ে এর মধ্যেই বিদ্যুৎলাইন সংযোগ করে, বরফকল স্থাপন করে, ড্রামে পানি, রং আর সেকারিন মিশিয়ে আইসক্রীম বানানো শুরু করে দিল। কয়েকমাসের মধ্যেই তার হাতে অনেক টাকা। এরই মধ্যে এখানে আরেকটি বিয়ে করে। কুমিল্লায় রেখে আসা বউ বাচ্চার কথা ভুলে যায়।
বেচারা ম্যাজিস্ট্রেট বিবেক-বিবেচনার দোটানায় ভোগে। শিশুদের রক্ষায় সরকারি আইনের বাস্তবায়ন করবে? নাকি গরীব মোতালেবের সংসারের শেষ ভরসা এ ফ্যাক্টরীকে চলতে দেবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে সরকারি আইনের বাস্থবায়নকেই তিনি প্রাধান্য দিলেন। দশের ভালোর জন্য একজনের ক্ষতি হলেও কিছু করার নেই। ম্যাজিস্ট্রেট যে ম্যাজিস্ট্রেট! তাঁর কি আর গরীব আইসক্রিমওয়ালার কথা ভাবার সময় আছে? তিনি যে এখন সমাজের উচু তলার বাসিন্দা।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )