গল্প: পাম্পচালকের স্বপ্ন
পাম্প-চালকের স্বপ্ন
-সফিকুল ইসলাম
পানির পাম্প চালক মনির শুয়ে আছে চৌকিতে। শুয়ে শুয়ে হালকা ঝিমুনিতে আছে। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। তবু কপালজুড়ে ঘাম, ঘামে পিঠও ভিজে যাচ্ছে। বড় অফিসার কী জানি কি অফিসার আসবেন পরিদর্শনে। তাকে ফোনে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে তার টেনশন চলছে। টেনশনে ঘাম ছাড়লেও তার চোখে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কমছে না। সে ভেবে পাচ্ছে না এত এত অফিসার থাকতে প্রধান অফিসারকেই কেন আসতে হবে এরকম পরিদর্শনে। তাও এই ভাঙ্গাচোরা পানির পাম্প হাউজে। কী এমন অপরাধ বা ভুল হয়েছে তার দ্বারা। সে কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছে না নিজের। ছোটখাটো ত্রুটি বিচ্যুতি যা যা করেছে সেসব তার চোখে ভাসছে। চোখ জুড়ে তাঁর রাজ্যের ঘুম ভর করছে। মাথার উপরে ফ্যানের বাতাসের কারণে তার চোখজুড়ে ঘুম আরও ভারী হচ্ছে। আধো ঘুমে আধো জাগরণে স্বপ্নময় অবস্থার মধ্যেই হালকা ভয় ও আতঙ্কে কী কী ভুল তার দ্বারা হয়ে থাকতে পারে সেসবের দৃশ্য তার চোখে ভাসছে।
পানির পাম্প প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে ৮টা এবং বিকাল তিনটা থেকে ৫টা পর্যন্ত চালানোর কথা। সে মাঝে মাঝে পানির পাম্প ছাড়তে ভুলে যায় বা দেরি হয়। সবসময় ভুলে যায় তা নয়। কোথাও হয়তো ঘুরতে গেলো, বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাবে, শশুরবাড়িতে গেলে একদিন থাকতে হবে। তখনতো কোনো উপায় নেই। দুনিয়ার সবারে সে থামাইতে পারে, কিন্তু বউয়ের আবদার না করে কী করে? রাজা-বাদশাহরা যেখানে বউয়ের কথায় কাইত, সেখানে সেতো সামান্য পানির পাম্প চালক। তার উপর শ্যালিকার আহলাদিপনা ঠাট্টা মশকরাতো আছেই। কে না চায় শ্যালিকার আশকারা! তাছাড়া শাশুড়ি খুব ভালো রান্না করে। সেসব উপাদেয় সুস্বাদু খাবার ফেলে এই ভাঙ্গা পানির পাম্পে এসে রাত কাটাবে, তাই কি হয়? সুতরাং তার পানির পাম্প চালু করার কাজটি নিয়মিত হয় না। মহল্লার লোকজন এ নিয়ে তাকে ধরলে সে সাফ জানিয়ে দেয় ‘ পানির পাম্প ভালো ছিল না‘। পাম্প কাজ করে না। পাম্প না কাজ করলে তার কী করার আছে? জিজ্ঞাসাকারী যদি একটু দুর্বল কিসিমের হয় তাহলে কথা নেই। পাম্প চালক মনির রীতিমতো খেকিয়ে উঁঠে। “পাম্প ছাড়লে ছাড়ুম না ছাড়লে নাই , তাতে তোর কি?‘‘ আর যদি জিজ্ঞাসাকারী শক্ত কিসিমের হয়, তবে নরম করে পাম্প মেশিন নষ্ট তথা যান্ত্রিক সমস্যার কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে। পানির পাম্প নিয়মিত না ছাড়ার খবর কি অফিসে গেলো? এজন্যই কি বড় অফিসার আসতেছে?- এ প্রশ্ন তার মনে কাজ করে। স্বপ্নাচ্ছন্ন আধো ঘুমে থাকা মনিরের কপালে চিন্তার চিহ্ন।
যে ঘরে শুয়ে আছে সে ঘর ছোট। তার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে পাম্প মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। ধুলোবালির আস্তর পড়ে থাকে। একপাশে তার বিছানা যেখানে সে পাম্প চলার সময় শুয়ে বসে থাকে। পাশেই বাড়ি; সেখানেই সে সাধারণত ঘুমায়। পাম্পঘরকে তাই তার নিজের ঘর মনে হয় না। সঙ্গতকারণেই সে পাম্পঘর পরিস্কার করে না, ঝাড়ু দেয় না। ময়লার আস্তর পড়ে থাকে, পুরোণো যন্ত্রপাতি বা পরিত্যাক্ত মোটরপার্টসগুলো জঙ ধরে আছে। মাকরসার জাল ঘরজুড়ে ফ্যানের বাতাসে খেলা করে। কোনো কিছুই তার গায়ে লাগে না। কোনো রকরেম গা বাঁচিয়ে পানির পাম্প চালু ও বন্ধ করে, আর ছোট্ট চৌকিতে সে শুয়ে পড়ে। আজ অফিসার আসবে, তবু সে এই রুম পরিস্কার করে না। পরিস্কারের বিষয় তার মাথায়ই আসে না। পানির পাম্প ঘর- এটার আবার পরিস্কার কি? মেশিন চালাতে পারলেই হয়। এই স্যাতস্যাতে জীর্ণ ঘরে সে মাঝে মাঝে তাসের আসর বসায়। নিজে খুব একটা খেলে না। পাড়ার লোকেরা খেলতে আসে। তখন সে দেখে। পাড়ার যারা তাস খেলে তারা আসলে টাকা দিয়ে খেলে। এটাকে জুয়া বলে পাড়ার লোকজন সমালোচনা করে। কিন্তু সে এইসব মাথায় তুলে না। মাঝে মাঝে যে খেলায় জিতে তাকে পাঁচশো টাকা দেয়, তাতেই সে খুশি। পাম্পঘরতো পড়েই আছে। পাড়ার লোকেরা একটু তাস খেলবে এর মধ্যে দোষের কি আছে? এলাকায় কয়েকজন মাদকসেবি আছে। ওরা রাতে এসে ঘরে ঢুকে। মনিরকে ডেকে নিয়ে আসে। প্রায় জোর করে দরজা খুলতে বলে। মাদকসেবিরা ঘরে ঢুকে মনিরকে বলে বাইরে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। মনির দাঁড়িয়ে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা। মাদকসেবীরা আরাম করে মাদক সেবন করে। কেউ ইয়াবা, কেউ ফেনিসিডিল কেউ বা অন্যকিছু। খেয়ে কেউ চলে যায়, কেউ বা এখানেই পড়ে থাকে রাতভর। মনিরকে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। মনির কিছু বলে না। সব গোপন রাখে। মনির এসব খায় না। তবে মাঝে মাঝে একটু একটু চেখে দেখে। এসব ঘটনা মনির যতই গোপন রাখুক, পাড়ার মানুষ জেনে যায়। কারণ মাদকসেবীরাই এসব বলে বেড়ায়। মাথা যখন পুরো ঝিম ধরা তখন মাদকসেবীরা কী বলে আর কী বলে না-তার ঠিক নেই। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। মনির ভেবে পাচ্ছে না এই তাসের আড্ডার খবর বা মাদকের আখড়ার খবর কি কেউ দিয়ে দিল অফিসারর কাছে? স্বপ্নের মধ্যেই মনির ঘেমে নেয়ে যায় প্রায়।
পাম্প চলতেছে। ফ্যান ঘুরতেছে। মনিরের তন্দ্রা ভেঙ্গে ভেঙ্গে ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। পাম্পের পানি যায় পুরো মহল্লাতে। সবার বাড়িতে লাইন দেওয়া। কারো বাড়িতে এক ইথ্চি পাইপের লাইন, কারো বাড়িতে দেড় ইঞ্চি পাইপ, কারো বাড়িতে দুই বা তিন ইঞ্চি পাইপের লাইন। সবার বাড়িতে পানি সমান তালে যায় না। পানির সংযোগ নেওয়ার সময় টাকা দিতে হয়। যত বড় মাপের পাইপ তত বেশি ফি। সুতরাং পানি সবার এখানে একই পরিমাণে যায় না। ভাড়াটিয়াদের অনেকে এসব জানে না। তাই পানি কম করে যায় বলে তাদের টাংকি ভরে না। তিন ঘন্টা পরে পাম্প বন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা পাম্পচালক মনিরকেই ধরে। যতই মনির ব্যখ্যা দিক, মনিরের কথা পাবলিক শুনতে রাজি না। গালাগালি শোনা মনিরের নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকের বাড়িতেই পানির লাইন নেই। পাম্পের পাশে একটি কল আছে যেখানে পাম্পের পানির ট্যাপ আছে। ওখান থেকেই অনেকে পানি নিতে আসে। বস্তির মহিলারা, ভাড়াটিয়াদের বাড়ির কাজের লোকেরাসহ নানান জন। পানি নেওয়ার সময় পাম্পচালক মনির সবাইকে দেখে। তাদের কারো কারো উপরে মনিরের নজর পড়ে। সামনের টিনশেড বাড়ির কাজের মেয়ে পারুল এখান থেকে প্রতিদিন পানি নেয়। পারুলের সাথে মনিরের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রথম প্রথম আচমকা চোখাচোখি হওয়া বা দৃষ্টি বিনিময় হলেও পরে তা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। একে অপরের চোখের ভাষা বুঝে নেয়। হালকা কৌতুক, ঠাট্টা মশ্করা করতে করতে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। একদিন গায়ে জ্বর নিয়েই পানি নিতে আসে পারুল। পানির কলসী নিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। মনির তাকে তুলে বাড়িতে কলসীসহ দিয়ে আসে। সেই থেকে মনিরের প্রতি একটু বেশিই ঢলে পড়ে পারুল। এভাবেই দিনে দিনে এদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাঝে মাঝে পারুল সন্ধ্যার পরে দোকান থেকে মুদিমাল আনার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। ওই ফাঁকে মনির পাম্পঘরে ঢুকিয়ে নেয় পারুলকে। দুজনের মধ্যে মানসিক সম্পর্ক ছাড়াও শারীরিক সম্পর্ক চলতে থাকে। একদিন পারুল পাম্পঘর থেকে বের হবার সময় তা প্রতিবেশী জলিল দেখে ফেলে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি হওয়ার কথা। কিন্তু জলিলকে মনির কবজা করে ফেলে কিছু টাকা দিয়ে। জলিল চুপ করে যায়। সেই জলিল কি এসব কথা বলে দিয়েছে কিনা অফিসে সেটাও এখন চিন্তার বিষয় মনিরের।
অফিসার তো আসার কথা । আসতেছে না কেন? সময় যাচ্ছে না যেন! খোদা জানে কোন ঘটনা কীভাবে অফিস জেনেছে। মনির কোনো কূল কিনারা করতে পারে না। তার বউ ও দুই বাচ্চা পাশের বাসাতেই থাকে। এই দুতিনশো মিটার দূরেই তার বাসা। পানির পাম্প এর সাথে যে বিদ্যুত মিটার সেখান থেকেই সে তার বাসায় বিদ্যুত লাইন দিয়েছে। এতে করে তার মাসিক বিদ্যুত বিল লাগে না। অফিসের নামে বিল হয়, সুতরাং অফিস পানির পাম্পের বিল দিয়ে দেয়। শুধু নিজের বাসায় লাইন দিয়েছে তা না। আশেপাশে আরও কয়েকটি বাসাতে সে পানির পাম্পের বিদ্যুত মিটার থেকে লাইন সংযোগ দিয়েছে। প্রতিটি বাড়ি থেকে সে ৫০০ টাকা করে নেয়। বিনিময়ে বাড়িগুলো ইচ্ছামতো বিদ্যুত ব্যবহার করে। অফিসের বিদ্যুত লাইন বিক্রি করে মনির টুপাইস কামাই করে। শুরুর দিকে এটাকে মনিরের চুরি মনে হতো। এখন আর সে তা মনে করে না। সারাদেশেই তো কত বড় বড় চুরি হয়। সেখানে তার সামান্য বিদ্যুত সংযোগ কোনো বিষয়ই না। সে তার মনকে বুঝিয়ে নিয়েছে। এই অনিয়মকে তার অতি স্বাভাবিক বিষয় মনে হয়। এই বিদ্যুত লাইন সংযোগের বিষয়টা কি কোনোভাবে অফিস জেনে গেছে? মনিরের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ঘুম আরও গভীর হয়।
ঘুমঘুম চোখেই মনির অপেক্ষা করতে থাকে অফিসার আসার। আসলে আসুক , না আসলে নাই। না আসলে আরও ভালো। শুনেছে এ অফিসার খুব কড়া। পাম্প মেরামতের বিল পাঠিয়েছিল কয়েকদিন আগে, এতে নাকি ১৪ টা প্রশ্ন করেছে নথিতে। সামান্য পাম্প মেরামতের বিলে এত প্রশ্ন করলে হবে? নগরজুড়ে কত পানির পাম্প, কত কত বিল। এসব বিল প্রশ্ন করে আটকালে পানির পাম্প চলবে? নগর চলবে? সব পানির পাম্প চালক যদি একযোগ হয়, আর কোনো প্যাঁচ লাগায়, পানি সরবরাহ না করে তখন অফিসার একা কিছু করতে পারবে? ভাবতে ভাবতে মনির স্বপ্নের মধ্যেই গোঙ্গাতে থাকে। প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিতে থাকে। পাম্প যেহেতু মেশিন তা নষ্ট হতেই পারে। নষ্ট হলে মেরামত করা লাগবেই। জবাব দিতে দিতে মনির গোঙ্গাতে থাকে বটে। তবে মনে মনে এটাও ভাবে যে পানির পাম্প নষ্ট হয় বটে, তবে তা কয়েকমাসে একদুবার। কিন্তু মনির প্রতি পনেরো দিনেই একটা করে বিল পাঠায়। পানির পাম্প, পাইপ মেরামত, রাস্তা খুঁড়া ইত্যাকার বিল। নিয়মিত পাঠায়। কিছু বিল বাস্তব আর কিছু বিল ভুতুরে। না পাঠিয়ে উপায় কি? মাত্র ৯০০০ টাকা বেতন দিয়ে কি ঘর চলে? সংসার চালানো, বাচ্চাদের পড়াশোনা, ইত্যাদিতে অনেক টাকা খরচ হয়। সুতরাং এসব ভুতুরে বিল বানিয়ে পাঠিয়ে কিছু টাকা সে পায়। সবটা পায় না। কারণ অফিসের কেরানি যাদের মাধ্যমে বিল জমা হয় তারাই ভাগের টাকা মেরে দেয়। তাদেরকে না জানিয়ে কোনোভাবেই বাড়তি বিল পাঠানো যায় না। আচ্ছা , এসব অনিয়মের কথা কি জেনে গেছে, অফিসার!? না হলে তিনি আসবেন কেন- তা ভেবে ঠিক ঠাহর করতে পারে না মনির।
পানির পাম্প ঘরে তাকে থাকতে হয় দীর্ঘসময়। যেহেতু শিফটিং ডিউটি নেই তাই ছুটি কাটাতে পারে না। এ নিয়ে আত্মীয়স্বজন সবাই ভুল বুঝে। মাঝে মাঝে রাতে থেকে যেতে হয়। দিনে পানির পাম্প না চললে রাত জেগেই তা চালাতে হয়। এতসব ঝামেলায় পরিবারকে সময় দিতে পারে না। বেশিরভাগ সময়েই মনির পাম্পের ভিতরে বসে থাকে বা পাম্পের বাইরে হাঁটাহাঁটি করে। বাসা কাছে হলেও খুব কমই যায়। ঘরে তার মন বসে না। বউয়ের নানান বিষয়ে অভিযোগ, সংসারের অভাব অনটন, বাচ্চাদের চাওয়া পাওয়া মেটাতে না পারা, ইত্যাকার অভিপ্রায়, অনুযোগ লেগেই থাকে। এসব হাউ কাউ তার ভালো লাগে না। এমনিতেই সামর্থের অভাবের কারণে মেজাজ গরম থাকে, তার উপর সবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিযোগ অনুযোগে তার কান ঝালাপালা হয়ে যায়। তখন সে রেগে যায়। মানুষের এটা অমোঘ নিয়ম। যখন আর পারে না তখন রেগে যায়। তেমনই মনির রেগে গিয়ে বাসায় বাসন ছুঁড়ে মারে। বউ তখন আরও ক্ষেপে। মুরোদ নাই ব্যাটার রাগতো কম না। কথায় কথা বাড়ে, উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে। হাত তোলা পর্যন্ত গিয়ে গড়ায়। তখন সংসার থেকে রাগ করে মনির বিদায় নেয়। কয়েকদিন বাসায় যায় না। দোকান থেকে রুটি কিনে খায় আর পাম্পের ঘরে ঘুমায়। কয়েকদিন পরে রাগ পড়ে গেলে বাসায় ফিরে। তখন কথায় কথায় বউ ঠিশারা করে হোক আর সিরিয়াস করে হোক বলে যে, বাইরে মানুষ থাকলে ঘরে আসার কি আর দরকার পড়ে! তখন মনিরের বুকের ভিতরে ধক করে উঠে। বউ কি তাহলে পারুলের কথা জেনে গেলো? জলিলতো বলার কথা না। তাহলে জানলো কী করে? আসলে বউদের কাছে কিছু লুকানো যায়না। কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি প্রখর, আর বউদের অনুধাবন শক্তি। মুখ চোখ আর কথার ধরণ দেখেই বউরা বলে দিতে পারে স্বামীরা কখন কোথায় কী ধরণের কাজে ছিল। মনির মনে মনে ভয় পায়। ভাবে বউ কি তাহলে অফিসে গিয়ে আমার নামে কোনো অভিযোগ দিয়েছে? নিজের ভেতরেই সব কথা উথলে উথলে উঠছে। যার মনে যা ফাল দিয়ে উঠে তা – প্রবাদের মতোই মনিরের মন আজ। অফিসার কখন আসবে পরিদর্শনে কী জানে? মনিরের আজ তন্দ্রা রোগে ধরেছে। শুয়ে শুয়ে ঝিমাচ্ছে আর স্বপ্ন ও বাস্তবতার এক খেয়ালি অবস্থাতে সময় যাচ্ছে।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মনির ঘুমচোখে বুঝতে পারে না যে এটা দরজাতে কেউ কড়া নাড়ছে নাকি অন্য কোথাও। আরও জোরে দরজা কড়া নাড়ার আওয়াজ পায় এবং তাকে কেউ ডাকছে বলে শুনতে পায়। হচকচিয়ে দ্রুত উঠে দরজা খোলে। সামনে দাঁড়িয়ে সহকারী প্রকৌশলী ও অফিসার। মনির ভয় পেয়ে যায়। অফিসাররা ঘরে আসে। একে একে সব দেখে। রুমটি অপরিস্কার কেন, মাকড়সার জাল কেন, ময়লা আবর্জনা কেন, পাম্প মেশিনে জঙ ধরা কেন, ইত্যাকার প্রশ্নে প্রশ্নে মনিরকে জর্জরিত করে। মনির চুপ থাকে। মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। কেবল আস্তে করে বলে ‘‘স্যার সব ঠিক করে নেবো‘‘। তারা আরও জানতে চায় কত বাড়িতে পানি যায়, সব লাইন ঠিক আছে কিনা, পানির প্রবাহ ঠিক থাকে কিনা, প্রতিদিন পানি সময়মতো ছাড়া হয় কিনা, এলাকার কারো কোনো অভিযোগ আছে কিনা। মনির আমতা আমতা করে ভয়ে ভয়ে সব প্রশ্নেরই উত্তর দেয়। বিদ্যুৎ কানেকশন ঠিক থাকে কিনা, এ পাম্পের বিদ্যুৎ বিল বেশি আসে কেন, আশেপাশের কোনো হোল্ডিং এর পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ আছে কিনা ইত্যাকার প্রশ্ন করে করে কিছু নোট নেয় অফিসাররা। ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে বলে যায়। তারপর চলে যায় সবাই।
মনিরের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। কেন বড় স্যারেরা আসলো কেন কী প্রশ্ন করলো, পরে কী হবে এসব নিয়ে সে ভাবতে চায় না। তাছাড়া বড় স্যারের আচরণ ও ব্যবহার তার ভালো লাগে। তার শারীরিক খবর জানতে চায়, কোনো কষ্ট আছে কিনা জানতে চায়। সে লাজুক হাসিতে কোনো উত্তর দেয়নি বটে, তবে তার ভালো লেগেছে যে কেউ একজন তার খবর নিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে আরাম করে গোসল করে, খেয়ে দেয়ে একটা ঘুম দেয়। তারা এসে চলে গেছে মানে মনির তার রাজ্য আবার ফিরে পেয়েছে। তবু কয়েকদিন একটু ভয়ে থাকে, চাকুরি থেকে তাড়িয়ে দেবার কোনো পত্র আসে কি না। কোনো পত্র বা ফোন কিছুই আসে না। সে মনে মনে নিজেকে বকা দেয়। বড় স্যার আসলো, তাঁর কোনো ভুলই ধরলো না প্রায়। কোনো শাসন বা তিরস্কারও করলো না। অথচ সেদিন সে শুয়ে শুয়ে কতকিছু ভেবে ফেলেছিল। জীবনের যত অপরাধ, ভুল ত্রুটি তাঁর মনের মধ্যেই খেলেছিল। সব সিনেমার মতো ভাসছিল। মানুষের মন এমনই। যেন স্বচ্ছ আয়না। নিজের কাছে সে ধরা খায়, সবসময় সবখানে। বুকের ভেতরে বাজে সকল কাজের ও অকাজের কর্মঘন্টা ও দৃশ্যকল্প। বড় স্যার ধরুক বা না ধরুক, মনির জানে মনির কি।
যাই হোক, দিন পনেরো যাবার পরে সে আবার আগের মতো শক্ত হয়ে বসে। ভয় কেটে যায়। আবার তার কাজ কর্ম আগের মতোই চালিয়ে যেতে পারবে। সেই বিদ্যুৎ চুরি, পারুলের সাথে লটরফটর, বউয়ের সাথে লুকুচুরি রাগ গোঁসা, মাদক আর জুয়ার আড্ডা বসিয়ে টুপাইস কামানো, হোল্ডিং মালিকদের মাঝে মাঝে ধমক দেওয়া সব চলবে। যখন খুশি পাম্প চলবে, যখন খুশি বন্ধ করবে। কেউ তাঁকে কিছু বলতে আসলে খেঁকিয়ে উঠবে। দুনিয়ার সবাই রাজা নিজ আয়ত্ত্বের রাজত্বে। মানুষ এমনই। অভ্যাস ছাড়তে পারে না, স্বভাব ছাড়তে পারে না। আর দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও ভ্রষ্টতা চলতে থাকলে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মনে হয় যা করছে সব স্বাভাবিক। তাতে জগতের ক্ষতি হলেও সে নিজের মোহ থেকে সহজে সরতে পারে না। মনিরেরা তথা মানুষেরা তেমনই।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )