গুণ যখন গালি
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে আপনার গুনও গালি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে আপনাকে পচাঁনো হয়। অন্য দেশেও কি হয়? হতে পারে আমার জানা নেই। অন্য প্রাণীর মধ্যেও কি হয়? হতে পারে আমার জানা নেই। প্রাণীর মনোজগত নিয়ে কাজ করেন যারা তারাঁ বলতে পারবেন। আপনি হয়তো বেশি সাদা বা লাল, বাংলাদেশে যাদেরকে সুন্দর বলে। কিন্তু আপনার এ ভালো দিকও গালি হয়ে প্রতিষ্ঠা হবে। ধলা ব্যাটা বা লাল বেটি নামে আপনাকে তাচ্ছিল্য করে এমনভাবে ডাকবে, যেন আপনার সাদা বা লাল হওয়াটা অন্যায় আর কি! আপনি হয়তো বিদেশ গিয়ে অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করছেন। প্রতিবেশিরা আপনাকে মুখ বাঁকা করে বলবে- ওঅ ওতো দুইদিনের বড়লোক। বিদেশ গিয়া টাকা কামাইছে! আপনি হয়তো পড়াশোনা করেছেন- আপনাকে বলবে দুইকলম শিকখ্যা এখন বড় বড় আলাপ করে। ওইরহম শিকখিত ম্যালা দ্যাখছি! আপনি হয়তো বেশি সামাজিক। প্রায় আড্ডা দেন।আপনাকে বলা হবে- ওতো আড্ডাবাজ! কাম-কাইজ নেই। খালি কথা বইলা বেড়ায়!আপনি হয়তো অনেক কষ্ট করে ইংরেজি শিখছেন, প্রনানসিয়েশানসহ ভালো বলেন। এ নিয়েও কটুক্তি হবে। বলা হবে- হ্যা তো অহন চুস্ত ইংরাজি মারায়। আপনার তখন মনে হবে কোন ভুলে যে ইংরেজি শিখতে গেছিলাম। আপনি হয়তো এমপি বা মন্ত্রী বা ক্ষমতাধরের ভাই। তখন আপনার যতগুনই থাকুক আর যত ভালোই করেন, আপনাকে বলা হবে- তিনিতো ভাইয়ের পাওয়ারে ওইসব করছেন। আপনি হয়তো কম বয়সেই ভালো কিছু লিখে ফেলেছেন, আপনাকে নিচে নামানোর জন্য দুনিয়ার সমালোচনা জুটবে। পরিবারও বাদ যাবেনা সে সমালোচনা থেকে। আপনি হয় বিদেশ থেকে তিনটি ডক্টরেট করে ফেলছেন। তারা বলবে তিনিতো বাইরে বাইরে থাকেন দেশের জন্য কিছু করেননা। আপনি হয়তো দেশেই সারাজীবন শ্রম দিয়েছেন। তখন বলবে তারতো আউটলুক নেই। আপনি হয়তো আইটিতে ভালো। লোকে বলবে সে তো টেকনোলজি ছাড়া কিছু বোঝেনা। আপনি হয়তো টেকনোলজি কম বুঝেন বাট অন্য দিকে ভালো।তখন বলবে সে তো ট্রাডিশনাল, আধুনিক না।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এসব আপনার গায়ে লাগেনা। কারণ আপনি কামিনী রায়ের পাছে লোকে কিছু বলে ভালো করেই জানেন।
”করিতে পারি না কাজ, সদা ভয়, সদা লাজ, সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে।…
আড়ালে আড়ালে থাকি, নীরবে আপনা ঢাকি,সম্মুখ চরণ নাহি চলে, পাছে লোকে কিছু বলে।
মহৎ উদ্দেশ্যে যবে একসাথে মিলে সবে, পারিনা মিলিতে সেই দলে, পাছে লোকে কিছু বলে।
বিধাতা দিয়েছেন প্রাণ, থাকি সদা ম্রিয়মান, শক্তি মরে ভীতির কবলে, পাছে লোকে কিছু বলে।”
আপনি হয়তো দৃঢ়সঙ্কল্প করেছেন, পেছনে কে কী বললো গাঁয়ে লাগাবেননা। কিন্তু দিন এখন বদলাইছে। আশেপাশের মানুষ এখন আর শুধু বলেই ক্ষান্ত হননা, খোঁচা মেরেই থেমে থাকেননা। বরং আপনার পেছনে লেগে যায় কিভাবে আপনাকে ল্যাং মারা যাবে। বহুসংস্কৃতির হরেকরকম সঙ্কর বাঙ্গালীর এ সমস্যার সমাধান কে করবে?! বঙ্গবন্ধু এজন্যই বলেছিলেন “পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। আগে তো পরের শ্রী দেখলে কাতর হতো এখন আর কাতর হয়না, রাগে জ্বলে উনুন হয়ে যায়, সুবিধামতো পেলে একেবারে পুড়িয়ে দেয়। দরকার হলে নিজের ক্ষতি করে হলেও আপনার ক্ষতি করবে। প্রবাদতো আছেই, “ নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ “ । রবী ঠাকুরও বলে গেছেন- আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে, হেনেছে নিঃসহায়ে”। সংসারে কত লোকের মনে কত ঈর্ষার আগুন ধিকিধিকি জ্বলে! কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল পরশ্রীকাতরতায় ভূগেই। আল্লাহর রাসুল বলছেন ”আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয় , হিংসা তেমনি পূণ্যকে ধ্বংস করে দেয়”। কুরান হাদীস দিয়ে কী হবে? ধর্ম মানি আর না মানি বাঙ্গালী মাত্রই পরগুনকে অসহ্য লাগে। যাদের অসহ্য লাগেনা, তাঁরা ব্যাতিক্রম।
-ড. সফিকুল ইসলাম। (লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )