Detail

Home - আর্টিকেল/কলাম - শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রগতিশীলতা ও উদারতা জরুরি

শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রগতিশীলতা ও উদারতা জরুরি

শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রগতিশীলতা ও উদারতা জরুরি

-ড. সফিকুল ইসলাম

১.

কেইস-এক: রাঙামাটি বান্দরবান কিংবা মৌলভীবাজারে কাজ করার সময় কোন কোন গবেষক, অফিসার, এনজিও মালিক বা ক্ষমতাধরদের সাথে কথা হতো। কাউকে কাউকে বলতে শুনিছে যে ‘চাকমা, মার্মা, মণিপুরী তথা উপজাতীদের আলাদা স্কুল না রেখে সবখানে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর ব্যবস্থা করা,  তথা মেইস্ট্রিমে নিয়ে আসা দরকার। ওরা নিজেদের ভাষা শিখে পরে আবার বাংলায় ভালো করতে পারেনা। সবাইকে একমুখী শিক্ষায় নিয়ে আসা দরকার।“ আসলেই কি তাই হওয়া উচিত?

 

কেইস-দুই: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আশ্রমে, প্যাগোডায় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কতিপয় ভিক্ষু থাকেন। ওনারা সেখানে ধর্মীয় দীক্ষা লাভ করেন এবং নির্দিষ্ট জীবনাচরণ অনুসরণ করেন। অনেকে সমালোচনা করেন যে সেখানে ওসব না  করে মেইনস্ট্রিমে থাকা উচিত। জগত সংসার বিজ্ঞান সমাজ গণিতে শিক্ষা দরকার। অর্থনীতিতে ভূমিকা দরকার। আসলেই কি তাই হওয়া উচিত?

 

কেইস তিন: মন্দিরভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা ভারত-বাংলাদেশে ও চার্চ-ভিত্তিক শিক্ষা ইউরোপের অনেক দেশে ছিল ও আছে। কেউ কেউ এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পুরো জীবন পার করে দেন। অনেকে দাবি করেন এসব বন্ধ করে দেওয়া উচিত, এগুলো সেকেলে। আসলেই কি তাই হওয়া উচিত?

কেইস-চার:  ব্রিটিশরা আড়াইশো বছর আগে ভারতবর্ষে এসে বললো সবাইকে ইংরেজি বলতে হবে, শিখতে হবে, স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকায়, ফরাসীরা আফ্রিকায় গিয়ে তাঁদের ভাষা চাপিয়ে দিয়ে এসছে। ওসব ভাষা না হলে নাকি সভ্য, উন্নত আর আধূনিক হবেনা। আসলেই কি তাই হওয়া উচিত ছিল?

 

কেইস-পাঁচ: মাদ্রাসা শিক্ষা মানেই হলো ধর্মশিক্ষা। ওখানে আধুনিক সমাজ, বিজ্ঞান বা গণিতের মারপ্যাঁচ শেখানো হয়না বা কম শেখানো হয়। তাই মাদ্রাসা বন্ধ করার জন্য অনেকে সুপারিশ করেন। আসলেই  কি তাই হওয়া ‍ উচিত?

 

উপরের পাঁচটি বিষয়সহ এরকম আরো হাজার উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে আমাদের অনেকেই বলবো, হ্যাঁ ওসব ব্যাকডেটেড ধর্মভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক, কৃষিভিত্তিক, সংস্কৃতি ভিত্তিক পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। এবং আমাদের এই বলা অনেক যুক্তি দিয়ে যৌক্তিকতাসহ বলতে পারবো যে, এটা ওটা ভালো না, আধুনিক শিক্ষা ভালো।

প্রশ্ন হচ্ছে, আধুনিক শিক্ষা বা হালনাগাদ শিক্ষা কোনটা? আমি যেটা বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম আর অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপে বসে শিখছি -সেটা আধুনিক শিক্ষা? সেটা কি হালনাগাদ শিক্ষা? আমরা কি সুনিশ্চিত? যেটাকে আধুনিক শিক্ষা বলছি সেটা কি চাপিয়ে দেওয়া নয়? বানিয়ে বানিয়ে খাইয়ে দেওয়া নয়? গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ আর ভোগবাদের মতো পরিকল্পিত ফর্মূলা নয়?

 

আমি যেটাকে ভালো ভাবছি সেটা গ্রহণ করছি। যেমন বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম, অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা। আরেকজন যেটাকে ভালো মনে করবে সেটাকে সে গ্রহণ করবে। প্রত্যেকের ইচ্ছানুসারে গ্রহণের সুযোগ রাখাটাই গণতন্ত্র বা প্রগতিশীলতা। একজন ব্যক্তি বা, একটি সমাজ, একটি কমিউনিটি যদি মনে করে যে তাঁদের নিজস্বা ভাষা বা সংস্কৃতি ভিত্তিক শিক্ষা রাখা দরকার, যদি মনে করে যে ধর্মীয় শিক্ষা রাখা দরকার, যদি মনে করে যে বাংলা মিডিয়াম রাখা দরকার তবে তাঁদেরকে সে সুযোগ দেওয়াটাই আধুনিকতা, সেটাই প্রগতিশীলতা। সেটা করতে না দেওয়াটাই হবে সাম্প্রদায়িকতা বা কট্ররপন্থী আচরণ।

 

আমি নিজে না চাইতে পারি মসজিদ/মন্দির/প্যাগোডা/গীর্জাভিত্তিক শিক্ষা। কিন্তু যারা চায় তাদের চাওয়ার অধিকারের পক্ষে কথা বলাটাই হবে প্রকৃত শিক্ষা। প্রকৃত প্রগতিশীলতা।  আমি হয়তো অনেক বড় হবো, বড় বিজ্ঞানী হবো, বড় নেতা হবো, বড় ব্যবসায়ী হবো, বড় অফিসার হবো, বড় গবেষক হবো, বড় সমাজবিজ্ঞানী হবো -এটা আমার অ্যাম্বিশান। কিন্তু পৃথিবীতে অনেকের জীবনের  অ্যাম্বিশনই হলো নিজ ভাষার রক্ষার প্রচেষ্টায় জীবন পার করে দেওয়া, যাদের জীবনের লক্ষই হলো ইসলাম/হিন্দু/বৌদ্ধ/ক্রিশ্চানিটি ধর্ম শিক্ষায় জীবন পার করে দেওয়া, যাদের লক্ষ্যই হলো পীর সাহেব বা ভান্তের বা ঠাকুরের সেবায় জীবন কাটিয়ে দেওয়া, তাঁদেরকে বাঁধা দেওয়া বা নাকচ করে দেওয়া কখনোই গণতান্ত্রিক আচরণ নয়, আধুনিক আচরণ নয়, প্রগতিশীল আচরণ নয়।

 

গতকালের  আধুনিকতা আজকের সেকেলে, আজকের আধুনিকতাই কালকের পুরাতন। সবই আপেক্ষিক। কোথায় বসে কেন কীভাবে ভাবছি। নলেজের কোন প্রেক্ষাপটে কোন নলেজকে কোন নলেজের সাথে রিলেট করছি -সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

হ্যাঁ এসব ধর্মভিত্তিক বা ভাষাভিত্তিক বা সংস্কৃতিভিত্তিক বা অন্য কিছু ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার বেশকিছু সীমাবদ্ধতা আছে। -সেগুলো কীভাবে দূর করা যায়, কমপ্রেহেনসিভ করা যায় -সে নিয়ে কথা হতে পারে। একেবারে বাদ দিয়ে দিব-বলা মানে হলো মেজর কয়েকটি ধর্মসহ সকল ধর্মের ও সংস্কৃতির মনস্থাত্ত্বিক জগতে আঘাত হানা।

 

অনেকেই বলেন অমুক ধর্ম তমূক ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাসই জগতের সকল অপকর্মের কারণ। তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই-  এখন যেসব ধর্মের আধিপত্য সেসব ধর্ম যখন ছিলনা তখনো মানুষে মানুষে অপকর্ম বা হত্যাকান্ড চলমান ছিল। গুটি কয়েকলোকের দোষে গোটা সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অবান্তর। প্রতিটি মানুষের, প্রতিটি সমাজের, প্রতিটি চিন্তার, প্রতিটি তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা আছে। সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা জরুরি।

 

কুয়োয় বাস করার অভিজ্ঞতা দিয়ে সমূদ্র নিয়ে মন্তব্য যেমন অসমীচীন, তেমনি সমূদ্রে বাস করার অভিজ্ঞতা দিয়ে কুয়ো নিয়ে মন্তব্য করাও অসমীচীন।

 

জগতের প্রতিটি সমাজের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, শ্রেণী, পেশা, রঙ, গোত্র, দেশ বা কাল যাই হোকনা কেন প্রতিটি রীতি, আচার বা প্রতিষ্ঠানকে মর্যাদা দিতে হবে, টেকসই হতে দিতে হবে, সংস্কার বা প্রস্ফুটনের সুযোগ দিতে হবে, সংরক্ষণ করতে হবে। মৌল না হারিয়ে যতটা উন্নত করা যায় কমপ্রেহেনসিভ করা যায় তা করতে হবে। তাও সংশ্লিষ্ট কমিউনিটিকে আহত না করে। সময়ের বিবর্তনে যা কিছু ভালো, যা কিছু সেরা, যা কিছু উত্তম তা টিকে যাবে। যোগ্যরা-ই টিকে থাকে। সময় সব ঠিক করে নেবে।

.

২।

হাল জমানায় মানুষ নানান ইস্যুতে দুইভাগ হয়ে একে অপরের বিশ্বাস, আচার, ধারণাকে এমনভাবে নগ্নভাবে আক্রমন করছে আর ভাইরাল করছে তাতে সমস্যা বাড়ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কেবল ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। ঘৃণার চাষাবাদ বা ট্রল হচ্ছে।

.

একদল বলে পহেলা বৈশাখ পালন করা যাবে না, পান্তা ভাত বাদ দিতে হবে, লালসাদা শাড়ি পরা যাবে না, কপালে টিপ দেওয়া যাবে না। এগুলো আমাদের সংস্কৃতি না। আরেকদল বলে গীর্জা-মন্দির-মসজিদমাদ্রাসা ভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা রাখা যাবে না, ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সব আয়োজন বন্ধ রাখতে হবে, ধর্মীয় লেবাসের পোষাক পরা যাবে না। এগুলো আমাদের সংস্কৃতি না।

.

কালচার বা সংস্কৃতি কী? কিংবা আমাদের সংস্কৃতি কী? সহজ করে বললে মানুষের আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি,, রুচি, মূল্যাবোধ, কিংবা খাওয়ার বা ব্যবহার্য উপাদানসমূহ যা প্রজন্মের পরে প্রজন্ম টিকে থাকে তাই তাদের কালচার বা সংস্কৃতি। এখন আমাদের কোন কোন অনুষঙ্গগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে আছে?

.

পান্তা ভাত দাদার দাদারা খেতো, আমরাও এখন খাই। তাই এটা আমাদের কালচার। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ খাবে না, তখন আর কালচার থাকবে না। যতদিন পান্তা খাওয়া চলবে ততদিন এটি আমাদের কালচারের অংশই থাকবে। যখন বন্ধ হবে তখন এটা হবে অতীত ঐতিহ্য।

.

আচ্ছা আমাদের দাদার দাদাদের আমলে সবাই খোলা জায়গায় পায়খানা করতো। ওটা কি আমাদের কালচার ছিল? এখন সবার ঘরে ইংলিশ কমোড। এটা আমাদের কালচার হয়ে গেছে? .

.

বৌদ্ধ ধর্মের হাজার বছর, হিন্দু ধর্মের হাজার বছর আর ইসলাম ধর্মের এক হাজার বছরে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নানান অভ্যাস বা রুচি বা বিভিন্ন অনুষঙ্গ ছিল বা এখনো আছে। নানান বিবর্তন বা পরিবর্তনে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পেয়েছে। প্রজন্মের পরে প্রজন্ম যা টিকে থাকে তাই যদি সংস্কৃতি হয়, তবে আমাদের সংস্কৃতিতে যা যা ছিল তা তা আমাদেরই। যা যা এখন নেই তা তা আমাদের অতীত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। যেগুলো এখনো আছে সেগুলোও আমাদের সংস্কৃতি। ব্রিটিশরা দুশো বছর শাসন করে যেসব রেওয়াজ, আচার ও রীতি আমোদের দিয়ে গেছেন এগুলোর যেসব আমরা পুরোপুরি শত বছর ধরে পালন করছি-সেগুলো কি এখনো বিদেশী সংস্কৃতিই থাকবে? সেগুলো কি এখন আমাদের সংস্কৃতি হবে না? ইসলাম বা খ্রিষ্টান ধর্মের যেসব ধর্মীয় রীতি এ অঞ্চলের মুসলমান বা খ্রিষ্টানদের মধ্যে হাজার বছর ধরে পালিত হচ্ছে-সেগুলো কি তাদের সংস্কৃতি হবে না?

.

সুতরাং কোনটা আমাদের সংস্কৃতি বা সংস্কৃতি না-তা চট করে বলা যায় না। প্রতিটি মানুষ তার পূর্বপুরুষ ও এ অঞ্চলের হাজার বছরের নানান অনুষঙ্গের নির্যাস মনে মগজে বয়ে বেড়ায়। এ কারণেই বৈচিত্র্য দেখা যায়। যে যার মতো মানুষ পালন করুক। বিশ্বাস করুক। যে যা পালন করে বুঝতে হবে সে সেইসব অনুষঙ্গ দীর্ঘ চর্চা বা বিবর্তনের মাধ্যমে তার কাছে আসা সংস্কৃতিই সে পালন করছে।

.

উত্তম পন্থা হচ্ছে কাউকে আক্রমন না করা, হেয় না করা, অপমান না করা। যার যেটা ভালো লাগে করবে। আমাদের যদি কারো কাছে মনে হয় আমাদেরটা উত্তম সেটা আমরা বলবো সহনীয় উপায়ে নন্দিত ভাষায়। আক্রমন করে নয়, ঘৃণা ছড়িয়ে নয়।

.

কুকথা, কুতর্ক, অজ্ঞতা, অবজ্ঞা, নগ্নতা ওই পেট থেকে বেরিয়ে আসা বমির মতো। যে কথা বা কাজ মানুষ, সমাজ, দেশ ও সৃষ্টিতে ঘৃণা ছড়ায়, অশান্তি বাড়ায় তা না বলাই ভালো। যার প্রকাশ যত আক্রমনাত্মক ও ঘৃণা ছড়ানোর মতো, তার জানা ও বোঝা তত কম ও স্থুল। আকথা, কুকথা, হিংসা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ ছড়ানো সব পেটের ভিতরে রাখুন। বের হলে বমির মতোই দুর্গন্ধ ছড়ায়।

.

যদি আপনি উত্তম হন, আপনার মত যদি অন্যতম উৎকৃ্ষ্ট হয়, আর আপনার যদি উৎকর্ষ সাধন করার জন্য কিছু বলার থাকে তবে এমনভাবে বলুন যেন মিষ্ট শোনায়, পৃথিবী আলোকিত হয়, বিশ্ব শান্তিময় হয়।

.

যার যার সংস্কৃতি তাকে পালন করতে দিন। আপনার সংস্কৃতি আপনি পালন করেন। যারটা টিকার টিকে যাবে। অতীতকালের অনেক সংস্কৃতি আমরা এখন পালন করি না। আমাদের অনেক সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পালন করবে না। যদি করে ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহমান থাকে তবে সেটাই তাদের সংস্কৃতি!

 

এভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক অবস্থা প্রগতিশীলতা ও উদারতায় টেকসই হবে। মানকল্যাণ হবে আর পৃথিবীতে আলোকিত হবে।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart