সে কী চাহনি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মারামারি
সে কী চাহনি! দীর্ঘকাল পরে এখনো হৃদয়ে আরামের পরশ বুলিয়ে দেয়।
(পাগল বা পাগলামি শব্দটা জীবনে অনেকবার শুনেছি। পাগলামি ছাড়া কোন ভালো কাজ কি সম্ভব? ভাবের পাগল, রঙের পাগল, এ দুনিয়া পাগলের কারবার। এমন যদি হতো, দুনিয়া পাগলে ভরে যেতো!)
২০০০ সালের ঘটনা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি আর সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকি। প্রতিদিনের মতো বিকেলে টিউশনিতে বেরিয়েছি।মিরপুর যাবো; নীলক্ষেত থেকে বাসে উঠতে হয়। দেরি হয়ে গেছে তাই খুব তাড়াহুড়া করে খুঁচি দৌড়ের মতো হাঁটছি।দূর থিকা আবসা ৯ নম্বর বাস দেখে খুশি হলাম যে বাসটা সঙ্গে সঙ্গে পাওয়াতে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারবো। ছাত্রীর মার জেরা শুনতে হবেনা। নীলক্ষেত মোড়ে পৌঁছামাত্র দেখি, ৯ নম্বর বাস থেকে তিনটি ষন্ডা টাইপের ছেলে আরেকটি ছেলেকে শার্টের কলার ধরে টেনে হিচড়ে নামাচ্ছে। নামিয়েই অনবরত কিল ঘুষি লাথি মারছে।ভিকটিম ছেলেটা অনুনয় বিনয় করেও ছাড়া পাচ্ছেনা। যথারীতি চারপাশে মুহূর্তের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গেল। আমি দেখছি যে হারে ছেলেটিকে মারধর করা হচ্ছে তাতে ছেলেটির যে কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আমি একজনের লাথি ফিরাই তো আর দুজন গিয়ে কিল ঘুষি মারে। আমি আরেকজনের কিল ঘুষি ফিরাই তো অন্য দুজন গিয়ে লাথি মারে। এরকম ২/৩ মিনিট চললো।চারপাশে এত লোক, কেউ এগিয়ে আসছেনা। সবাই তামাশা দেখছে। আমি ফিরাচ্ছি আর করজোরে অনুরোধ করছি। চিৎকার করে প্লিজ প্লিজ বলছি। ভাই শোনেন ভাই শোনেন বলে বলে বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাদের তিনজনের বীরত্ব চলছে।ভিকটিম মাটিতে পড়ে গেছে।এ দেখে তিন বীরের চেহারায় দিগ্বীজয়ীর ভাব চলে এলো। জঙ্গলের পশু যেমন শিকার কুপোকাতের পর খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় সেরকম। আরো মারার জন্য পুন: হামলে পড়ছে। আমি হাঁটু গেড়ে বসে নুয়ে ভিকটিমের উপর । উপুর হয়ে দুই হাত মেলে ধরে আক্রমনকারীদেরকে আর না মারতে অনুরোধ করি। এরপরও তারা ভিকটিমের পাযে ইচ্ছামতো বুটের লাথি মেরে আঘাত করতে থাকলো। ভিকটিমের অবস্থা প্রায় শোচনীয়। সঙ্গে আমার আমার অবস্থাও নাজেহাল। আমার শার্টের বোতাম ছিড়ে গেলো। দুচার ঘা আমার গায়েও লাগলো। তবে শেষ পর্যন্ত ওরা আমার বারংবার অনুরোধে হোক কিংবা পরিশ্রান্ত হয়ে হোক থেমেছিল। ভিকটিম শোচনীয় আহত হয়েই আমার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাঁকিয়ে থাকতে থাকতে বিদায় নিল।মাথায় হাত দিয়ে ল্যংড়াতে ল্যাংড়াতে বলতে গেলে দৌড়ে পালালো। আর ষন্ডা টাইপের ছেলে তিনটি আমার দিকে চেয়ে গালি দিতে দিতে সরে গেলো।
যাক পরের বাসে উঠলাম। আমিসহ যারা এতক্ষণ ভীরের মধ্যে দাড়িয়ে রঙ দেখছিল তারা। বাসে বসে নিজেকে গুছাচ্ছি, শার্টের কলার ঠিক করছি, চুলগুলো ঠিক করছি। এর মধ্যেই একজনের গলা শুনতে পেলাম। “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা এরকমই। সন্ত্রাসীপনা ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা।বাপ মা টাকা পাঠায় আর ক্যাম্পাসে থাইকা মাস্তানি করে। আর কিছু আছে চাঁদাবাজি করে” ইত্যাদি। সাথে অনেকেই গলা মেলালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধারে লেগে গেলো। হঠাৎ আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম। জাস্ট শাট আপ। একদম চুপ। বলার সাথে সাথে পুরো বাসে নিস্তব্ধতা নেমে এল। বললাম, এতক্ষণতো এই আপনারাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা উপভোগ করলেন। কই, কেউ তো ছেলেটিকে রক্ষায় এগিয়ে এলেন না। কোন আওয়াজও করলেন না।কিছুই কইলেন না। তো কিভাবে জানলেন যে ছেলেগুলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের? তখন মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলোনা। এখন দেখি রাজ্যের সব গল্প আপনারা জানেন। না, আপনারা আসলে কিছুই জানেন না। যে ছেলেরা মারধর করছিল তাদের আপনারা চিনেন না, হ্যা আমিও চিনিনা। এখন আমাকে চিনেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমিই ওখানে ভিকটিমকে রক্ষা করলাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্র। আমি আমি আমি । চিৎকার করে করে আমার বুকে আঙ্গুল দিয়ে নিজেকে দেখালাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মানুষকে রক্ষা করে। হ্যা এখন জানেন। জেনে কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিমাসে ঢাকার সব হাসপাতালে হাজার হাজার ব্যাগ রক্ত দেয়। আমি ১১ বার দিয়েছি। আপনারা দিয়েছেন? আমরা দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মানুষ বাচাঁতে রক্ত দেয়। এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। চিৎকার করে করে কথা বলতে বলতে আমার গলা ফ্যাসফ্যাস হয়ে আসে। আমি রাগে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকি। মুরব্বী ধরণের একজন আমাকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বসিয়ে দেয়। এরপর বাসটিতে মিরপুর যাওয়া অবধি আর কেউ কোন কথা বলেনি। আমি নিশ্চিত তাঁরা সবাই হয়তো অল্প বয়সী আবেগী ছেলের আজাইরা আবেগ, পাগলামি আর উত্তেজিত প্রলাপ নিয়ে জাবর কেটেছেন। মুখে কিছু বলেননি। হয়তো আরও অনেক কিছুই তাঁরা ভেবেছেন।মিরপুর পৌঁছতে পৌঁছতে আমার শরীর স্থিতু হয়ে আসে। মাথায় একপাশে ফোলা অনুভব করলাম।সাথে চিনচিনে ব্যথাও।তবে সব ছাড়িয়ে ভিকটিম ছেলেটির চলে যাওয়ার সময় তার কৃতজ্ঞতার যে চাহনি আমি দেখেছিলাম তা মনটাকে চনমনে করে দিল। সে কী চাহনি! দীর্ঘকাল পরে এখনো হৃদয়ে আরামের পরশ বুলিয়ে দেয়।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )