মৃত্যুভাবনা ও কিছু মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণ
১।
কয়েক তরুণের মৃত্যু ও আমার জীবনশংকা!
অকালে প্রাণ হারানোর বিষয়টা নিয়ে আজ আমার মন ভীষণ ভাবনায় ডুবেছে। আমার পরিচিত কিছু মানুষের অকস্মাৎ মৃত্যু হয়েছে। এ কারণে অতি পরিচিত শব্দ মৃত্যুর সাথে নিজের পরিচয় অনেক ঘনিষ্ঠ হলো। জগৎ আর জীবনের সাথে এত ওতপ্রোত জড়ায়ে আছি যে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবাও কঠিন। আসলে চারপাশের সব ধোয়াঁশা, কেবলি মায়া।সংসার এতটা মিছা তা নতুন করে টের পাই। এর আগে অনেক ধর্মীয় বাণী, নীতিকথা আর উপদেশ শুনেছি। কিন্তু এখন দেখি সবই ক্ষণিকের খেলা। ভাবনার মধ্যেই সকল অকালে ঝরা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিছুতেই অশান্ত মনকে দমানো যাচ্ছেনা।
বন্ধু জাহাঙ্গীর, ৭ বোনের একমাত্র ভাই। বাবা-মার নয়নমনি। সেসহ আমরা সকলে পুকুরে সাতাঁর দিলাম। উত্তর থেকে দক্ষিণ পাড়। সবাই পুকুরের দক্ষিণ পাড় গেলাম। সে চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে ওপাড়ে।
বন্ধু মুজিব, কত কথা বলতো সে। ক্লাশে ফার্স্ট হওয়া ছিল তার প্রতিদিনের চাওয়া ও বাস্তবতা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে করেও দেখালো। দুচোখ ভরা কত স্বপ্ন ছিলো তার।সকল স্বপ্ন বাদ দিয়ে স্নাতক শেষে বিএসসি শিক্ষক তথা মানুষ গড়ার কারিগর হলো। হঠাৎ একদিন নববধু ও কোলের সন্তান রেখে ওপারে চলে গেলো।সামান্য গাড়ি দূর্ঘটনায় এত স্বপ্নের সলিল সমাধি। কিন্তু কেন? মৃত্যুর চেয়ে কঠিন হচ্ছে জীবন- এ কথা কি সে বিশ্বাস করতো? তার স্বপ্নভরা অবারিত কথা শুনলে কখনোই তা মনে হয়নি। তবে কেন সকল দুঃখ-কষ্ট বিপদ-আপদ হতাশা থেকে মুক্তি নিলো?
বন্ধু সোহাগ। কত প্রাণবন্ত আর হাসি খুশি ছিলো। হাজারো সামাজিকতা আর নেটওয়ার্কে তার ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। নিয়মিত জিম করতি ফিটনেসের জন্য। অনেকের আকর্ষণও ছিলো তার প্রতি ঈর্ষণীয় পর্যায়ে।ক্যামেরায় ছবি তোলায় তার ভালো হাত ছিল। বাবা-মার আশা ছিল, মাস্টার্স শেষে পরিবারের হাল ধরবে। তা না কর্মসংস্থান হতে না হতেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে দিলো।
ঢাবির মার্কেটিং এর সদাহাস্য মুখ বন্ধু আরেক সোহাগ, তুখোড় ছাত্রনেতা নাজিম, মেধাবী ছাত্রী শিশু রিষা, মিষ্টি শিশু আনিকা, প্রাণপ্রিয় রোপন ভাই, ফুফাতো ভাই কিশোর মানিক, আরও কত!
সব ভাবনা আজ আমাকে ভাসায়ে নিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু কী সহজ! নিরবে আসে। অথচ আমরা সবসময় জীবন নিয়ে গর্ব করি।অন্যত্র লিখেছিলাম, আমি সরকারি কর্মচারী?মরিবার আগে শতবার মরি। আসলে আমরা সব মানুষই প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে মরি। ছোট ছোট মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা অমোঘ নিয়তির মৃত্যুর দিকে ধাবিত হই। কোথায় যেন পড়েছিলাম -মৃত্যু হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ উদ্ভাবন। এটি জীবনকে পুরোনো ও সেকেলে জিনিস থেকে মুক্ত করে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য উল্টোটা বলেছেন। “যদি মৃত্যু না থাকিত, জগতের যেখানকার যাহা তাহা চিরকাল সেখানেই যদি অবিকৃতভাবে দাড়াঁইয়া থাকিত, তবে জগৎটা একটা চিরস্থায়ী সমাধিমন্দিরের মতো অত্যন্ত সংকীর্ণ, অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত বদ্ধ হইয়া রহিত। এই অনন্ত নিশ্চলতার ভার বহন করা প্রাণীদের পক্ষে বড়ো দুরুহ হতো। যে দিকে মৃত্যু সেই দিকেই জগতের অসীমতা।” তবে কি আমি অসীমের মাঝে ক্ষুদ্র সসীম।তিনি মনে হয় স্বাভাবিক পরিপূর্ণ বয়সে মৃত্যুর কথা বলেছেন। যারা অকালে প্রাণ হারায় তাঁদের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রভাবনা কি জানা নেই। তবে তারাসঙ্করের কবি উপন্যাসের কয়েকটি লাইন জবর দাগ কাটে মনে।”এই খেদ মোর মনে/ ভালবেসে মিটল না আশ/- কুলাল না এ জীবনে/ হায়,জীবন এত ছোট কেনে?”
তাইতো আমরা কেউ মরতে চাইনা। এমনকি যদি কাউকে বলা হয় তোমার মৃত্যুমাত্রই তুমি স্বর্গে যাবে, তবুও আমরা মরতে চাই না।বাঁচতে চাই। শুধু মুহূর্ত অতিক্রম করা মানেই জীবন নয়। প্রতিটি মুহূর্তে জীবন্ত কর্মমূখর ছিলাম কিনা, সেবামূখর ছিলাম কিনা, মানুষের মনে দাগ কেটেছি কিনা, সৃষ্টির কল্যাণে কোন ভূমিকা রাখছি কিনা এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কয়দিন বাঁচা সে কয়দিন বাঁচার মতো বাঁচাই ভালো। জীবনের মুখোমুখী হবার ভয়ে মরার আগেই মরার কোন মানে হয়না।মরবার সময় হলে মরবো।তার আগে কিছু একটা করি। এপিজে আবুল কালামের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই। “জন্ম যখন নিয়েই ফেলেছিস তবে চিহ্ন রেখে যা।” তাই প্রতিনিয়ত ভালোবেসে যাই। সৃষ্টিকে, স্রষ্টাকে, প্রকৃতিকে, দেশকে, প্রতিবেশিকে, মাটিকে, বিশ্বকে, সবাইকে ভালোবেসে যাই। এমনকি আমার মতের সাথে যার মিলেনা তাকেও। যাতে মনে কোন খেদ না থাকে। ”জীবন এত ছোট কেনে? ভালোবেসে মিটলনা আশ, কুলালনা এ জীবনে। জীবন এত ছোট কেনে?”
…………………………
২। মৃত্যু কত কাছে?
মৃত্যুকে আমরা মানতে নারাজ। কিন্তু মৃত্যু আমাদের জীবনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে কখন চলে যাব কেউই জানি না। এই জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হয়, দুনিয়াতে এত লড়াই করে কী হবে? ক্ষমতা ক্ষণিকের বিষয়। মানুষ চলে গেলে কোনো কিছুই থাকে না। সবকিছু একজন মানুষের সঙ্গে চলে যায়। আগের দিনে মানুষের মৃত্যুর পর তার কফিনে দামি অলঙ্কার দিয়ে দেওয়া হতো। কেন দেওয়া হতো তা এখনো অপার রহস্য। মৃত্যুকে মেনেই বেঁচে থাকলে সমস্যা কমে যায়। লড়াই থাকে না। যুদ্ধ থাকে না।
আজিকে হয়েছে শান্তি, জীবনের ভুল ভ্রান্তি, সব গেছে চুকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘যায় যদি তবে যাক/ এল যদি শেষ ডাকÑ/ অসীম জীবনে এ ক্ষীণ জীবন/ শেষ রেখা এঁকে যাক/ মৃত্যুতে ঠেকে যাক/ নিয়ে, যাহা টুটে যায়, যাহা/ ছুটে যায়, যাহা/ ধূলি হয়ে লুটে ধূলি প’রে চোরা/ মৃত্যুই যার অন্তরে, যাহা/ রেখে যায় শুধু ফাঁক/ যাক নিয়ে তাহা, যাক এ জীবন যাক’। রবি
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
কাছের মানুষকে হারানোর মতো কষ্টকর ব্যথা আর হয়না। মৃত্যু মানুষের জীবনের চরম নির্মম সত্য।
………………
৩। শশুর-আব্বার মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণ
আমরা সকলেই আশেপাশের সবকিছুতেই জড়িয়ে যাই। আপনি ছিলেন আমার দেখা ব্যতিক্রম। সবার সাথে ছিলেন। তবে কোনকিছুতেই ছিলেননা। পরিবারে ছিলেন, পরিবারে ছিলেননা; পাড়ায় ছিলেন, পাড়ায় ছিলেননা; গ্রামে ছিলেন, গ্রামে ছিলেননা। থেকে না থাকার এ শক্ত আবরণ তৈরি করা এবং তা ধরে রাখা সংসারে খুব কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটি আপনি খুব সহজ করেই জীবনে প্রতিপালন করেছেন। ঘরের বাজার সদাই, সংসারের লেনদেন, আত্মীয়-স্বজনের দেয়ানেয়া, সন্তান-সন্ততির দৈনন্দিন সমস্যা কোনকিছুতেই আপনার বিন্দৃমাত্র টেনশান ছিলনা। হয়তো কখনো কখনো শুনতেন বা দেখতেন। কিন্তু এমনভাবে নিতেন যে পরিবারে, সমাজে এসব ঘটতেই পারে বা ঘটবে- এতে জড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই। বিশ্বলয় নিয়ে যিনি খেলছেন এটা যেন তারই একার কাজ। তাই সমাজের বিষয়াদি, রাষ্ট্রের কার্যকলাপ কোনকিছু নিয়ে আপনাকে বিন্দুমাত্র ভাবতে দেখিনি। এরকম নির্মোহ, নির্লিপ্ত, নির্বিকার জীবন কজনের হয় আমি জানিনা। সবার সাথে থেকে, বাস করে কোন কিছুতেই নিজেকে না জড়ানোর যে শক্ত ব্যক্তিত্ব আপনার ছিল তা সত্যিই দুর্লভ।
আমি আপনাকে চিনি ১২ বছর ধরে। আপনাকে আমি এভাবেই পেয়েছি। কিন্তু আপনি নাকি এরকম ছিলেননা।পরিবার ও সমাজ নিয়ে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত ছিলেন।ছিলেন দায়িত্বশীল বাবা, ছিলেন সহানূভূতিশীল প্রতিবেশী। সকল সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দান করেছেন। শিক্ষা আর ক্রীড়ায় আপনার অনুরাগ ছিল অনুকরণীয়। মানুষকে আপ্যায়ন করে আপনি খুব তৃপ্তি পেতেন। সংসারের এরকম ব্যস্ততা থেকে হঠাৎ করেই আপনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।দুসন্তানকে হারিয়েছেন অল্প বয়সে। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছিল।সংসার, ধর্ম, দর্শন ও বাস্তবতা সব মিলিয়েই হয়তো আপনি বুঝে নিয়েছিলেন যে ধরার এসব ক্ষুদ্র বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার কিছু নেই।সত্যকে সহজ করেই আপনি নিয়েছিলেন।
আপনি সামনে যা পেতেন তাই পড়তেন। বই, পত্রিকা, কাগজের ঠোঙা সব। এর বাইরে আপনার ঝোঁক ছিল বাচ্চাদের নিয়ে ভাবা। বাচ্চাদের নিয়ে থাকা। পাড়ার সব বাচ্চাকে এটা ওটা দিয়ে খুশি করা ছিল আপনার চিত্ত বিনোদন। সব্জি গাছরোপন ও যত্ন নেওয়াও আপনার একটি শখ ছিল। ঘরের প্রয়োজনে এটি করতেন তা মোটেও নয়। বরং সব্জিবাগান বা ফুলের বাগান করা ছিল আপনার সহজাত প্রবৃত্তি।
মৃত্যুকে আপনি মেনে নিয়েছিলেন অনেক আগেই। তাইতো নিয়মিত কাফনের কাপড় ধোতেন এবং রোদে দিয়ে শুকাতেন। এরকম নির্বিকার নিস্প্রভ প্রস্তুতি মৃত্যুর জন্য কয়জনে নিতে পারে আর কয়জনেইবা সাহস করে।
পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি জীবন ছিল আপনার। সহজ-সরলতায় ভরপুর ছিল সব। সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রতি তাহাজ্জুদে সাক্ষাৎ আর পাঁচওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া এ ছিল আপনার নিত্যদিনের কর্ম। শারীরিক অসুস্থতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনটিই আপনাকে এ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সংসারের ছোটবড় কোন সমস্যাতো নয়ই। পরকাল নিয়ে আপনার ভাবনা আপনাকে সবসময় দুনিয়া থেকে দূরে রেখেছে।
আমার সাথে আপনার খুব একটা কথা হতোনা। যেটুকুই হতো তাতে আপনার আন্তিরকতা, মনোযোগ ও ভালোবাসা উপচে পড়তো। হঠাৎ একদিন কথা নেই বার্তা নেই আপনি আপনার সমস্ত সঞ্চয় হাতে নগদ আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এটা রাখুন”। আমি বললাম, “আমার কাছে কেন”। আমি বিব্রত বোধ করছিলাম। আপনার আশেপাশে এত লোক থাকতে আমাকেই কেন রাখতে হবে। আপনি আপনার কাছে রাখুন। বা ঘরের আর যারা আছেন তাদেঁর কাছে রাখুন। কিন্তু না আমার কাছেই রাখলেন এবং বললেন “আপনার কাছেই রাখেন।“। পরিস্থিতি আমাকে আর কিছুই বলতে দেয়নি।
এখন আপনি সব ফেলে চলে গেলেন। চলে গেলেন বলা যায়না বরং মৃত্যুর জন্য আপনার যে প্রস্তুতি তাতে বলা যায়, আপনি আপনার বহু প্রতিক্ষিত জায়গায় ফিরলেন।
নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক আপনার কবরকে শান্তিময় করেছেন এবং জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করবেন।প্রাণভরা দোয়া রইলো আপনার জন্য।
………….
৪। শাশুড়ি-আম্মার মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণ
- সন্তানহারা মা যাকে পায় তাকেই নিজের সন্তান মনে করে। আগলে রাখতে চায়, খেয়াল করে, অপেক্ষা করে, কাছে পেতে চায়। নতুন যেই আসুক তার মুখের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সন্তানরে দেখতে পায়, কথার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে শুনতে পায়, হাসির মধ্যে অভিব্যাক্তির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজে পায়, চলাচল আর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের নানান উপকরণের সাদৃশ্য পায়। আপনিও তেমনি ছিলেন। এমএ পাশ করা দুই সন্তানকে হারিয়ে আপনি তেমন হয়ে গিয়েছিলেন। তিন মেয়ের জামাইকে সন্তানই ভাবতেন। এমনকি জামাইদের বন্ধুবান্ধবরা আসলে, সন্তানদের ক্লাসমেটরা আসলেও আপনি ভাবতেন সন্তান এসছে। তাঁদের খাওয়ানোর জন্য, বসানোর জন্য, আপ্যায়নের জন্য আপনার আগ্রহের সীমা পরিসীমা ছিল না।
- নাতি নাতনীদের আপনি ভালোবাসতেন খুব বেশি। মেয়ের ঘরের হোক আর ছেলের ঘরের হোক, শহরের হোক আর গ্রামে থাকুক। আপনি তাদের নিয়ে সারাক্ষণ টেনশন করতেন। যারা কাছে আছে তারা খেলো কিনা, ঘুমালো কিনা, হারিয়ে গেলো কিনা, পড়ে গেলো কিনা, কান্না করে কিনা, গরমে আছে কিনা, ঠান্ডায় আছে কিনা, সমস্যায় আছে কিনা, এটা লাগবে কিনা সেটা লাগবে কিনা – ইত্যাকার নানান চিন্তায় আপনার কোনো ঘুম নেই। যারা দুরে থাকে তারা সুস্থ কিনা, খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করে কিনা, ভ্রমনের ঝুঁকিতে আছে কিনা, কোনো সমস্যায় আছে কিনা, কাপড় লাগবে কিনা, ওষুধ লাগবে কিনা, গিফট লাগবে কিনা -ইত্যাদি নানান ভাবনায় আপনার কাটে বিনিদ্র জীবন। এ নিয়ে আমরা বা আপনার সন্তানরা যতই বকাবকি করুক আপনাকে , আপনার সহজাত এ বৈশিষ্ট্য বহমান ছিল, চলমান ছিল। যেন এসব চিন্তা ছাড়া আপনার আর কোনো কাজ নাই।
- অথচ আজ আমরা আপনাকে একা সাড়ে তিন হাত কবরে ফেলে রেখে চলে এসেছি। ৫ দিন পেরিয়ে, ৭ দিন পেরিয়ে, ৪০ দিন পেরিয়ে দুমাস হতে চললা। আপনার গরম লাগবে কিনা, আলো লাগবে কিনা, পিপড়ায় কামড়ায় কিনা, ওষুধ লাগবে কিনা, আরাম লাগবে কিনা, এটা লাগবে কিনা সেটা লাগবে কিনা -এরকম কোনো প্রশ্ন করছি না। আমরা কিছুই করছি না। বহাল তবিয়তে নিজেদের সংসার জগত আর জীবন যাত্রা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি। কিভাবে তা পারছি, কিভাবে বিধাতা আমাদেরকে সইয়ে দিয়ে সব কাজ করাচ্ছেন- তা ভাবতেও বুক হাহাকার করছে।
- মানুষকে দুহাত ভরে দেওয়া ছিল আপনার স্বহজাত স্বভাব, আর মানুষকে পেট ভরিয়ে খাওয়ানো ছিল আপনার সবসময়ের অভ্যাস। আত্মীয় হোক আর প্রতিবেশী হোক, ফকির হোক আর মিসকিন হোক, ধনী হোক আর গরীব হোক, একদিনের জন্য আসুক আর ২০ দিনের জন্য আসুক – আপনি তারে খাওয়ানোর জন্য পাগলপাড়া হয়ে যেতেন। কয়েক পদের খাবার না দিলে আপনার তৃপ্তি হতো না। কোনো আত্মীয় কোনো মিষ্টি বা ফল আনলে সেটা সব প্রতিবেশির বাড়ি বাড়ি পাঠাতেন। নিজের জন্য রাখতেন না। নিজে যা খেতেন ফকিরকে তার থেকে বেশিটা দিতেন, ভালোটা দিতেন। আত্মীযরা হলেতো আইটেমের যেন শেষ নেই। দশ বারো পদ করার পরেও আপনার মনে হতো, এটা করা হয়নি ওটা করা হয়নি। এখনো কত মানুষ আপনার দেওয়ার কীর্তন করছে, আপনার খাওয়ানোর গুণ গাইছে। আপনার হাত থেকে নিয়ে , আপনার হাতে খেয়ে যত আত্মা শান্তি পেয়েছে, তৃপ্তি পেয়েছে, তাদের সবার দোয়ায় নিশ্চয়ই আপনি ভালো থাকবেন। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আপনাকে ভালো রেখেছে। আমরা আপনাকে মিস করি খুব, মিস করবো প্রতিটি খাবার আয়োজনে, প্রতিটি বিতরণে, প্রতিটি পারিবারিক সম্মিলনে।
- আমাদের বাসায় ছিলেন অল্প সময়ই। যে কয়দিনই ছিলেন এখন আমরা সে রুমটাতে যেতে পারি না। এখনো আপনার গন্ধ পাই, এখনো আপনার ছায়া দেখতে পাই, এখনো আপনার হাঁটার আওয়াজ পাই। এখনো আপনার কাঁশির শব্দ শুনি। এখনো হঠাত চোখে পড়ে আপনি হাত দেয়ালে ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিছু বলবেন বলে। সেই রুমটি ক্রস করার সময় আমরা ভুল করে আপনাকে দেখবো বলে তাকাই। পরে ভুল ভাঙ্গে, মনে পড়ে আপনি নেই। আপনি শরীরটি নেই। কিন্তু আমরা ঠিক আপনার অস্তিত্ব টের পাই, আপনাকে অনুভব করি, আপনারে কল্পনায় পাই, ভাবনাতে রাখি। আপনার মেয়েতো সারাক্ষণ আপনাকে নিয়েই আছে। এমনকি শ্রেয়া স্পন্দনও আপনাকে মিস করে নানান কথায় ওরা আপনাকে স্মরণ করে।
- সংসারের কত টাকা আয় বা কত ব্যয় বা কত সঞ্চয় এ নিয়ে আপনি ভাবতেন না। মানুষকে দেওয়া আর মানুষকে খাওয়ানো ছাড়া আপনার আর কোনো চিন্তা করতে আমি দেখিনি। যখন যেখান থেকে যত আসুক, আপনার সন্তানরা যা পাঠাতো তা দিয়ে আপনি শুধু মানুষকে দিতেন আর মানুষকে খাওয়াতেন। সঞ্চয় করার ভাবনা আপনার মোটেও ছিল না। এমনকি আপনার হাত খরচ হিসেবে যেসব গিফট আপনি পেতেন তা আপনি নাতি নাতনী বা অন্য কাজের লোকদের দিয়ে দিতেন। আপনাকে আমরা অনেক সময বলেছি, সঞ্চয় করার জন্য খরচ কম করার জন্য। তখন আমরা ভাবতাম আপনি ভুল করছেন। কিন্তু আমরা ভেবে দেখছি, আপনিই ঠিক ছিলেন। সঞ্চয় করে কি হবে? যেতে হবে খালি হাতে, তবে কার জন্য এ সঞ্চয় করবো। আপনি খালি হাতে গিয়েছেন। কিন্তু দুহাত ভরে মানুষকে দেওয়ার দ্বারা খাওয়ানোর দ্বারা হাজারো মানুষের মনে আপনি সুখস্মৃতি রেখে গিয়েছেন, হাজারো আত্মাকে আপনি তৃপ্ত করে গিয়েছেন। আপনি সৃষ্টি হিসেবে সেরা কাজটিই করে গিয়েছেন। নিশ্চয়ই আপনাকে সৃষ্টিকর্তা শান্তির পরশে রাখবেন।
- আপনার হাতের রান্না ছিল খুবই মজার। বিশেষ করে মাছের মাথা দিয়ে পোলাও চাল সহযোগে মুড়িঘন্টটা যেন অমৃত। অনেকবার করে খাইয়েছেন। তেমনি লাউ চিংড়ি বা পোলাও কোর্মা থেকে শুরু সব আইটেমই আপনি ভালো রাঁধতেন। আপনার কাছ থেকে ফোন করে করে সুজন রান্না শিখে ফেলে। এখনো সে ভালো রান্নার কথা বলতে গেলে আপনার কথাই বলে।
- কেউ ঢাকা থেকে আসবে, কেউ চট্টগ্রাম বা কসবা থেকে আসবে, কেউ বিবাড়িয়া থেকে আসবে, কেউ বাজার থেকে আসবে, আপনি অধীর আগ্রহ নিয়ে পথে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সবাইকে রিসিভ করতেন। যেতে দেরি হলে ফোন করে খবর নিতেন। আসছেনা কেন, দেরি কেন। আপনাকে পেয়ে আমরা সকলে মিলে যেন চাঁদের হাট বসতো বাড়িতে। আবার চলে আসার সময় সবাইকে বাড়ি ঘাটা পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে দিতে আসতেন। এখন আমাদের যাওয়া আসায় কেউ এরকম রিসিভ করবে বা বিদায় দিবে? কে করবে আদর সোহাগের আলাপবিলাপ? সবই আজ শূন্য মনে হচ্ছে। ঘুমিয়ে আছেন পুকুরের ওই পাড়ে। আমরা যাবো, আমাদের হয়তো আপনি দেখবেন, আমরা আপনাকে আর দেখবো না। এ কষ্ট নিয়েই আমাদের কাটবে সারাজীবন।
- জীবনের শেষ কয়েক বছর আপনি শিশু হয়ে গিয়েছিলেন। বাচ্চারা যেমন নিয়ম কানুন মানে না কথা শুনে না। আপনিও ডাক্তারের নিযম কানুন মানতে চাইতেন না। বাচ্চারা যেমন এখনকার কথা একটু পরে ভুলে যায়, আপনারও তেমন হয়েছিল। আপনি আসলে শিশুই ছিলেন। তাইতো আমি আপনার কথায় হাসতাম, আর স্পন্দন আপনাকে খুব খেপাতো। স্পন্দন শ্রেয়াকেও খেপায়, আর আপনাকে খেপাতো। নানী নাতির এ মুখের যুদ্ধ আমি উপভোগ করতাম। আপনিও হাসতেন। আবার ভুলে যেতেন। চলে যাওয়ার আগে এই যে শিশু হয়ে যাওয়া এটাকেও আমি এখন ভালো হিসেবে দেখছি। শিশু মানেই নিষ্পাপ। শিশু মানেই সহজ সরল। আপনি আসলে তাই ছিলেন। শেষের দিকে একটু বেশিই ছিলেন। নিষ্পাপ শিশুর মতোই সৃষ্টিকর্তার নিকট ফিরে গেছেন।
- আপনার সামনে বাচ্চাদেরকে কেউ মারতে পারতো না। চিল থেকে বাঁচানোর জন্য যেমন মুরগী পাখনা দিয়ে আগলে রাখে সন্তানদের। আপনিও নাতি নাতনীদের সেভাবেই রাখতেন। ঋদ্ধি, রাম্মী-তাফসীর, উদয়-অশ্রু, শ্রেয়া-স্পন্দন, প্রিয়া-পিয়াল-প্রীতি, ছোঁয়া, তোয়া, হিয়া, বা পদ্ম-খালিদ-তাসফিয়া সবার ক্ষেত্রেই আপনার এ বিষয়টি ছিল। আপনার সামনে আপনার নাতি-নাতনীকে শাসন করা বা মারা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। স্পন্দনকে একটু শক্ত শাসন করায় আপনি আমাকে অনেক বার বকা দিয়েছেন। স্পন্দন আপনার আদর পেয়ে যেন তার কান্নার ঢেউ আরও বেড়ে যেতো। আপনি আমাকে চিতকার করে প্রশ্ন করতেন ‘আবুইদ্যারে এমন করে মানুষ মারে?‘‘ আমি আমতা আমতা করে জবাব দিতাম। তবে মনে মনে নাতির প্রতি আপনার আদর সোহাগ দেখে আমার ভালো লাগতো। সেই শ্রেয়া স্পন্দন, রাম্মি তাফসীর…… সেই আশ্রয়স্থল আর পাবে না। এত বড় শূন্যতা কিছুতেই আর পূরণ হবার নয়।
- সুজনের সাথে বিভিন্ন সময় খুনসুটি করার সময় আমি আপনার বিচার মানলে আপনি আমার পক্ষ নিতেন। মাঝে মাঝেই আমি ফান করে বলতাম ‘‘সুজন কি জিনিস, সেটা সুজনের আম্মা জানে আর আমি জানি। সুজন ছোটবেলায় আম্মারে জালাইছে, আর এখন আমারে জালাচ্ছে।‘‘ আমার এ কথা শুনে আপনি অপার্থিব হাসি হাসতেন। হাসির মানে হলো আপনি আমার সাথে একমত হয়ে আমার পক্ষ নিতেন। সুজন কপট রাগ দেখিয়ে আপনার দিকে তাকাতো। এভাবেই আমাদের খুনসুটির ঝগড়া শেষ হতো। সুজন ছোট বেলায় আপনাকে যতই জ্বালাক, সুজন আপনাকে খুব ভালোবাসতো, আপনার জন্য সারাক্ষণ তার মন ছটফট করতো, প্রকাশ করতো না। এমনকি অস্ট্রেলিয়া জাপানে গিয়েও সে আপনাকে এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারেনি। যদিও কথায় বুঝতে দিতো না। কিন্তু তার ভাবনা জগতের প্রায় সবটা জুড়ে আপনি ছিলেন- সেটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। সুজনকেও আপনি ভালোবাসতেন, সুজনকে আপনি ক্ষমা করে দিয়েন।
আমাদের সকলের সকল পূণ্যের বিনিময়ে আপনি ভালো থাকুন পরকালে এই দোয়া রইলো।
…………………………………
৫। মৃত্যু কি ভয়ের?
মৃত্যু নিয়তি। এড়ানো যায়না। অনেক বড় ক্ষতি।
এতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
তবে জীবিত অবস্থায়ই অনেকের ভিতরের অনেককিছু মরে যায়।
আগ্রহ মরে যায়, কর্মস্পৃহা মরে যায়
ভালো চিন্তা মরে যায়, স্বপ্ন ইচ্ছে মরে যায়
অবাক হওয়ার ক্ষমতা মরে যায়,
ভালোবাসা মরে যায়, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা মরে যায়
হাসার স্নায়ু মরে যায়, মনের মর্মবোধ মরে যায়
বিবেকের সলিল সমাধি হয়।
এগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা জরুরি।
মৃত্যুতো হবেই। ভয় পেয়ে লাভ নেই।
ভয় পাওয়া উচিত তাদের যারা এখনো
জীবিত অবস্থায় বাঁচতে শিখিনি।
প্রতিনিয়ত নিজের কাছে নিজে মরা
এ মরা বড় আজব-ক্ষতির মরা
……………….
৬।
বাঁচতে শেখার চিন্তা করতে থাকাই মরতে শেখা
মরতে শেখার চিন্তা করতে থাকাই বাঁচতে শেখা।
…………………………………………..
৭
কেউ মরে গেলে আমরা তাঁর নিথর দেহ দেখে, নির্বাক মুখ দেখে খুব আফসোস করি। আহারে কেমন অপলক চেয়ে আছে, নড়েনা, কথা বলেনা। সেক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার নেই। কিন্তু আমাদের চারপাশে অনেকেই আছেন নিশ্চুপ আর নির্বাক হয়ে আছেন। পারিপার্শ্বিক আচরণ আর কষ্টকর অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতিতে। আমরা কি কখনো এসব অভিমানি দুঃখী ভাইবোনটিকে জিজ্ঞেস করেছি কেন হঠাৎ নিশ্চুপ, নির্বাক হয়ে আছে।মরার পরে ফুল নিয়ে যাই, শুভেচ্ছা নিয়ে যাই, দোয়া নিয়ে যাই, সময় নিয়ে যাই। ফুল আর শুভেচ্ছা নিয়ে জীবিত থাকতে যাইনা কেন? সময় দেইনা কেন?
……………….
৮।
জগতের নতুন বাড়ি করতে না করতে ও পাড়ের নতুন মাটির বাড়ি ডেকে নিয়ে যায়। কী নির্মম সত্য, তাই না?
মধ্যবয়স্ক অনেককে দেখেছি যারা শখের নতুন বাড়ি বা ঘর নির্মান করার পরপরই বা নির্মানকালেই মারা গেছেন।
…..
৯। ভাইসচেয়ারম্যানের মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণ
মতলব উপজেলা পরিষদের সম্মানীত ভাইস চেয়ারম্যান লক্ষী রাণী দাস তারা আর নেই। মতলবের দু‘বারের ভাইস চেয়ারম্যান। মতলবের গণমানুষের আপনজন আর নেই।
শোকের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কী বলবো আজ তার স্বরণে! একজন ভালো মানুষ, শুদ্ধ রাজনীতিবিদ, জনদরদী-জনপ্রতিনিধি ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের আদর্শে বিশ্বাস করতেন দৃঢ়ভাবে। মনেপ্রাণে ধারণ করতেন বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর আদর্শকে। শুধু কথায় নয়, কাজেও।
মতলব উপজেলায় কাজ করাকালে কোনদিন নিজের জন্য কোন তদবির নিয়ে আসেননি। গরীব অসহায় জনতার যে কোন বিষয় নিয়ে অনেকবার এসেছেন। বলার ভঙ্গী ও আন্তরিকতা দেখলে সে সেবা না দিবার কারণ নেই। জেনুইন সেবাপ্রার্থীর বিষয়ে বৈধ সব চাওয়া ছিল তাঁর । কারো জমির সমস্যা, কারো নারী ও শিশু বিষয়ক সমস্যা, কারো রাস্তাঘাট বিষয়ক সমস্যা। সব সাধারণ মানুষের চাওয়া নিয়ে কথা বলতেন। আগাগোড়া ভালো মানুষ ছিলেন তিনি।
সভা সেমিনারে যে বক্তব্য দিতেন তা হতো প্রান্জল, মিষ্টি, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। প্রতিবাদের ভাষা হতো সমুচিত কিন্তু পরিশীলিত। যেমনটা জাপান বা ইউরোপের উন্নত দেশে দেখি সেরকম।
ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে একাই নিজেকে সামলেছেন। ভাই বোনকে মানুষ করেছেন। নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত পাননি। সংস্কৃতিমনা ছিলেন। সুন্দর গান করতেন। গানও লিখতেন । বই লিখেছেন। রুচিশীল ও সুক্ষ রসবোধ সম্পন্ন এমন জনবান্ধব নেত্রী এখন বিরল।
দুবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। আবার দাঁড়ালেও বিপুল ভোটে পাশ করতেন। এমনকি রাজনৈতিক বিরোধীতার কারণে যারা ভোট দিবেননা তারাও তাঁর প্রশংসা করবেন- বলে আমার বিশ্বাস।
স্বল্পভাষী, মিষ্টভাষী, সততার প্রতিক ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন তিনি।সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতেন। সুবিবেচনাবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সেন্স অব প্রপোরশন ছিল তাঁর। রাজনীতি করলেই মাত্রাজ্ঞানহীন ও বেপরোয়া হওয়া লাগবে এমনটা যেমন দেখি সচরাচর তাঁর ঠিক বিপরীত ছিলেন লক্ষী রাণী দাস। মাত্রাজ্ঞান ছিল তাঁর, ছিলো আচরণ, প্রকাশ ও চাওয়ায় পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
সাধারণ মানুষ ও খাঁটি মানুষদের প্রিয় মানুষ ও ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তিনি। ‘এমন চরিত্র তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। ‘ কবিতার মতোই ছিল তাঁর জীবন।
তাঁর আত্মার জন্য প্রার্থনা। শান্ত, স্নিগ্ধ ও শান্তিপ্রিয় এ মানুষটি ওপারে শান্তিতে থাকবেন।
( একজন প্রশাসক হিসেবে মানুষের খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ ঘটেনা, সেটা সম্ভবও নয়। প্রশাসনিক কারণেই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। তবু দূর থেকে যতটুকু দেখেছি, কাজকর্ম যা পেয়েছি আর মানুষের মুখে মুখে আড়ালে আবডালে যা শুনেছি তার থেকেই আমার এ স্মৃতিচারণ। )
…………….
১০।
যাদের ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষ প্রাণের মানুষ পৃথিবীতে নেই; ওপারে চলে গেছেন; অথচ এ ভালোবাসা দিবসে খুব মনে পড়ছে, তারা নিচের দোয়াটা পড়তে পারেন। ভাবতে পারেন, কাঁদতে পারেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।
“হে আল্লাহ্, তাকে ক্ষমা করুণ এবং তাকে দয়া করুণ, শান্তিতে রাখুন, তার থাকার স্থানটিকে মর্যাদাশীল করুণ, তার কবরকে প্রশস্থ করে দিন। বরফ ও তুষারের শুভ্রতা দিয়ে, তাকে গুনাহ থেকে এমন ভাবে পরিস্কার করে দিন যেমন সাদা কাপড় পরিস্কার হয় ময়লা থেকে, তাকে দুনিয়ার বাসস্থানের চেয়ে উত্তম বাসস্থান দিন।, পরিবার ও সঙ্গী দান করুন, হে মাবুদ, তাকে জান্নাতে দাখিল করুন, তাকে কবর আর দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুণ। আমীন।
(আল্লাহহু ম্মাগ ফিরলাহু ওয়ারহামহু, ওয়া আফিহি, ওয়া ফু আনহু, ওয়া আকরিম নুযুলাহু, ওয়া ওয়াসসি মাদখালাহু, ওয়াগসিলহু বিল মায়ি ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদি, ওয়া নাককিহি মিনাল খাতা ইয়া কামা ইউননাককাস সাওবুল আব ইয়াযু মিনাদদানাসি, ওয়াবদিলহু দারান খয়রন মিন দারিহি, ওয়া আহলান খাইরান মিন আহলিহি, ওয়া যাওজান খাইরান মিন যাওজিহি। ওয়া আদখিলহুল জান্নাতা, ওয়া আইজহু মিন আযাবিল কাবরি ওয়ামিন আযাবিন নার। (মুসলিম ২/৬৩৪)
…………………….
১১।
বিয়ের পরই তাঁর কথা শুনি।কাইয়ুম ভাই। জীবনের ব্যস্ততায় গত ১৫ বছরে আমাদের দেখা হয় না। দেখা হলো গত দুমাস আগে। এক আত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদে আমরা সেখানে যাই। গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলি দু‘জনে। প্রায় দেড় ঘন্টা বা তারও বেশি। নানান বিষয়ে আলাপ হয়।জীবনযাত্রা, সুখ-দু:খ, এটা-সেটা। শুঁটকি ও চিকন চালের ভাত তাঁর খুব ফেবারিট- সেটাও জানালেন। আমাকে বাসায় দাওয়াত দিলেন। আমিও দাওয়াত দিলাম। দুজনই কথায় কথায় আন্তরিকতা ও ঋদ্ধতায় হারালাম। খুব শীঘ্রই দেখা হবে-এমনভাবেই বিদায় নিলাম।
জীবনের ব্যস্ততায় আর কথা হয়নি, দেখাও হয়নি। আজ শুনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। আজিমপুরে গিয়ে শেষ বিদায় দিয়ে আসলাম।
জীবন খুবই ছোট! কখন কে চলে যাই-তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই।
যখনই যার সাথে দেখা হচ্ছে তাঁর সাথে যেন বেস্ট সাক্ষাতটা হয়-সেভাবেই যেন আমরা চলি।
এই কয়েকমাস ধরেও তিনি পিতার সম্পদের ভাগ নিয়ে বোনদের সাথে নানান ফেকড়াতে লিপ্ত ছিলেন। কে কতদূর সম্পদ বেশি নিয়ে গেলো এ নিয়ে নানান ধরণের ফ্যাসাদ লেগেইছিল। হয়তো তিনি কম পেয়েছেন বা পাননি। সবই আপন ভাইবোনের বিষয়। অথচ আজ তিনি নিজেই নেই। তাঁর বাবা কবি আব্দুর রশিদ মাস্টার অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন। সেই সম্পদ রেখে চলে গেছেন। গত বছর গেলেন তার মা। এখন গেলেন তিনি। রয়ে গেলো সব সম্পদ। তিনি ছিলেন একমাত্র পুত্র। আর তার নিজেরও পুত্র একটি। থাকে কানাডায়। মৃত্যুর সময় দেখতে পরেনি। আসলে গত ১৩ বছর ধরেই দেখতে আসেনি।
………….
১২। সম্প্রতি তিনটি মৃত্যুতে মৃত্যুচিন্তা
সামাজিক জীব হিসেবে সাধারণত মানুষ সান্নিধ্য পছন্দ করে। সবারে নিয়ে থাকতে চায়। দীর্ঘ সান্নিধ্য আর হাজার ভীড়ে থেকে থেকে মানুষ আবার একাও হতে চায়। মানুষ সঙ্গ ছাড়াও বাঁচতে পারে না। আবার অতি সঙ্গতেও হাসফাঁস লাগে। একা একটু নিরিবিলি থাকতে চায়। সম্প্রতি তিনটি মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হচ্ছে ফেসবুকে ট্রল। ড. শামসুর রহমান, কবরি, মুগ্ধা হাসপাতালের সুইসাইড করা ব্যাক্তি। তাঁদের কে কেন কোন পরিস্থিতিতে একা মারা গেলেন – তা আমরা জানিনা। আদৌ তাঁরা সার্বিক অর্থে একা ছিলেন কিনা- তাও কি আমরা জানি। অনেকের আক্ষেপ তাঁরা নাকি একা মরেছেন, একাকিত্বে ছিলেন। আহা উহু করছেন। এসব ভাবনার বিপরীতে আমার ভাবনাটা বলতে চাই।
- যে মরে গেলো, সে মরেই গেলো। সে একা মরলো নাকি হাজার লোকের সামনে মরলো সেটা তার কাছে কোনো বিষয় না। সবার সামনে মরলে কী হতো? হাজারো সঙ্গ নিয়ে মরলে কি হতো? কিছুই হতো না। ওই একাই যাওয়া লাগতো। একা যে যেতে হবে সবাইকে- এটাই অমোঘ বাস্তবতা।
যারা হাজার সঙ্গ নিয়ে আছি তারা যে ‘একা‘ নই তার নিশ্চায়তা কি? লক্ষ সঙ্গর মধ্যে থেকেও যারা একা তাদের নিয়ে কী বলবো? পানি খেলে পিপাসা দূর হয়, কিন্তু পানি পেলে যদি পিপাসা পায় সেই পিপাসা দূর করা যায় না। সঙ্গ নিয়ে থাকলে যদি একা লাগে, সেই একাকিত্ব দূর করবো কি দিয়ে?
অনেকে হয়তো বলবেন ‘সন্তান দেশে থাকলে ভালো হতো‘, ‘সংসার আগে থেকে গুছিয়ে মনোযোগ দিয়ে করলে ভালো হতো‘, ‘আত্মীয় পরিজনদের সাথে সবসময় মিলে চললে ভালো হতো‘, ‘বন্ধু-বান্ধবে আরো ঘেরা হলে ভালো হতো‘। সেগুলো করলে ভালো, এবং এগুলো আমরা অনেকেই করি। কিন্তু এসব করলেও কোনো গ্যারান্টি নেই যে মানুষ ‘একা‘ হবে না। একা হওয়া, একা মরা, একা যাওয়া- মানুষের ভবিতব্য। মানুষ মূলত একা- এ এক গভীর দার্শনিকতা।
বরং একা হোক বা ‘দু‘কা হোক আর হাজারের মধ্যমণি হোক, একা একা বাঁচতে শেখা ও মরতে শেখা জরুরি। ‘একা‘ অবস্থাকে আলিঙ্গনের মাঝেই অপার আনন্দ নিহিত। যে সঙ্গ নিয়ে পরিপূর্ণ আবার একা একাও পরিপূর্ণ সে সঙ্গ নিয়ে থাকা বা না থাকা নিয়ে বিচলিত হয় না।
মানে সবার সাথে মিশবেন, সবার সাথে থাকবেন, কিন্তু নিজের একটা নিজস্ব জগত রাখবেন- যেখানে কেউ ঢুকতে পারবে না। যখন কেউ থাকবে না, তখন সেই নিজস্ব জগত দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ রাখবেন।
নিজেকে যখন একায় পাবো, আপন বাহুয় ধরতে পারবো, ‘নিজেকে জানো‘ বুঝতে পারবো, তখনই জীবনের আসল মাজেজা ঘটে। সবার সামনে মরতে পারে অনেকেই, নিজের সামনে মরতে পারে কয়জনে?
সৃষ্টির মাঝে একা হয়ে, থাকবো মোরা নির্ভয়ে, সবার হৃদয়ে থেকেও মোরা থাকবো আপন হৃদয়কোণে, অসীমের মাঝে সীমা হয়ে, নিজেকে পাবো যথাভাবে- এমনটা হতে পারলেই সারা। সবার সাথে থেকে মরতে পারা যেমন অনেকের স্বপ্ন, একা একা মরতে পারাও হতে পারে অনেকের আরাধ্য।
আমরা কেউ জানিনা কোন কারণে, কোথায় একা হয়ে যাই অকারণে, কোন পথের কোন বাঁকে রেখে আসি হৃদয়াংশ যতন করে। তাই কে ‘একা‘ মরলো আর কে ‘সবারে নিয়ে মরলো‘- সে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।
কেউ কেউ বলবেন ‘‘তাই বলে শেষ মুহুর্তে হাত ধরার লোক থাকবে না, অশ্রু ফেলার লোক থাকবে না?‘‘। বাস্তবে হাত ধরলেই যে সে হাত মনের নাগাল পেয়েছে তা আমরা জানি না। সুতরাং হাতের ছোঁয়া বা চোখের জল দিয়ে বিষয়টা শক্ত উপসংহার টানা যাবে না। তাছাড়াযে চোখের জল ফেলবার দূরে থেকেও ফেলবে, যার হৃদয় জ্বলবার দূরে থেকেও জ্বলবে। পরিবার আত্মীয় পরিবেষ্টিত থাকা লোকও একা মরতে পারে রাস্তায় কিংবা আইসিউতে। মৃত্যু কোথায় হবে আমরা জানিনা।
একা এসেছো একাই যাবে এটাই শেষ কথা।জীবন একটা রঙ্গমঞ্চের নাটক মাত্র। এ নাটকের পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের চরিত্রে অভিনয় করে মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কেউ কারো নয়। মানুষ নিজকে যতই সক্ষম করতে পারবে তাতেই তার মঙ্গল। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন ‘‘যখন তুমি সমস্ত সাহায্য প্রত্যাখ্যান করবে,তখন তুমি মুক্ত।‘‘
‘‘আমি একা, বড় একা, আমার আপন কেউ নেই‘‘ বা ‘‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা‘‘ বা ‘‘পথহারা পথটাকেই ভালোবেসেছি, গোলকধাঁধার চত্ত্বরে…….‘‘- গানগুলো কার না প্রিয়? মানুষ ভেতরে ভেতরে একা অনুভব করে বলেই এসব গান খুব পছন্দ করে এবং গুণ গুণ করে গেয়ে উঠে।
মোদ্দা কথা, পুনরুক্তি করছি ‘সবার সামনে মরতে পারে অনেকেই, নিজের সামনে মরতে পারে কয়জনে?‘ ‘সবার সাথে থেকে মরতে পারা যেমন অনেকের স্বপ্ন, একা একা মরতে পারাও হতে পারে অনেকের আরাধ্য।‘ পেশাগত কারণে মানুষ দূরে যাবে, একা থাকবে -এটাই স্বাভাবিক। নবী(স:) ও ব্যবসায়িক কারণে অনেক দূরে গিয়েছেন, ধ্যান করতে গুহায় বসেছেন। সুফি, সাধক, ব্যবসায়ী, গবেষক কে একা থাকে নি? কে কোথায় কীভাবে কখন মারা যাবো জানিনা। তাই সঙ্গ সহ বা সঙ্গ ছাড়া যে কোনো অবস্থায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে শেখা জরুরি। এবং আনন্দের সাথে
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )