সনদ হারানোর পর কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের স্মৃতি
ফ্ল্যাশব্যাক
কসবা থেকে বাসে করে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাউতলি বাস স্ট্যান্ডে নামলাম। রিকশায় করে রেল স্টেশানে যাচ্ছি। হাতের ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে আরাম করে বসেছি।মেজাজ ফুরফুরে। বাতাসে লম্বা চুল উড়ছে। গুনগুন গান গাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাচ্ছি- সে আনন্দে তা না না না মুডে ছিলাম। মহানগর চলে এসছে বিধায় দ্রুত রিকশা ভাড়া দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ধাক্কাধাক্কির ফলে ভাঁজ খাওয়া শার্টের কলার ও চুলের ভাজ ঠিক করে নিলাম। থিতু হয়ে দাঁড়াতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন ছাড়া মাত্র মনে পড়লো সার্টিফিকেটের ব্যাগটা রিকশায় ফেলে এসছি। কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। শরীর ঘেমে গেছে। ট্রেনের গতি উচুঁতে। নিজের চুল নিজে ছেড়া ছাড়া কোন উপায় দেখি না। চারদিন পরে ভাইভা যেখানে আমার মূল সনদ দেখাতে হবে।কিংকর্তব্যবিমূঢ অবস্থায় ত্রিশ মিনিট গেলো। মনে হলো ত্রিশ দিন পার হয়েছে।চেইন টানার বুদ্ধি মাথায় আসেনি বা কেউ বলেনি। পরে ভৈরবে নেমে গেলাম। সেখান থেকে বাসে করে আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরলাম। স্টেশনে দৌড়াদৌড়ি করে রিকশাওয়ালাকে খুঁজে তার টিকিটিও মিললো না। রেল স্টেশন থেকে কাউতলী এবং টিএ রোডসহ পুরো শহর রিকশা দিয়ে কয়েকবার ঘুরলাম। সেই রিকশাওয়ালাকে পেলাম না। একজন পরামর্শ দিলো মাইকিং করাতে। মাইকিং করালাম। কোন কাজ হলো না। বেজে গেলো বেলা তিনটা। পরে অন্যজন বললো কুমিল্লা বোর্ডে গেলে আবার সাময়িক সনদ তোলা যায়। তবে তার জন্য থানায় জিডি করতে হবে; পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে; আবেদন ফরমে স্কুল কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষের সুপারিশ নিয়ে বোর্ডে জমা দিতে হবে। গেলাম থানায়।মুন্সী বললো দরখাস্ত লিখে নিয়ে আসুন। দরখাস্ত লিখে নিয়ে গেলাম। মুন্সী ওসী সাহেবের রুমে নিয়ে গেলেন। ওসী সাহেব দরখাস্ত পড়ে বললেন, লিখছতো ভালোই। কিন্তু স্কুল কলেজের আবেদনপত্র হয়ে গেছে। থানার জিডির আবেদন এভাবে হবে না।কোথায় হারালো কেন হারালো ইত্যাকার নানা প্রশ্ন করে দরখাস্তটা ফেরত দিলেন। মুন্সীর সাথে মন খারাপ করে ফিরছি।পাশের রুমে যাওয়ার পর মুন্সী বললো হাতখরচ দেন। এ দরখাস্তেই হবে। জিডি হয়ে গেলো।তবে জিডির আবেদন লেখা শেখা হলো না।না শিখে পাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে কে শিখতে যায়? জিডির কপি নিয়ে গেলাম দৈনিক পত্রিকা অফিসে।হারানো বিজ্ঞপ্তি ছাপানোর ব্যবস্থা করে গ্রামে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা।
রাতেই হেড স্যাড়ের বাড়ি গিয়ে আবেদন সংগ্রহ ও পুরণ করে তাঁর স্বাক্ষর নিলাম। এর মধ্যে বাবা-মার টেনশান ও প্রধান শিক্ষকের বকা ও উপদেশের বন্যায় কান ঝালাপালা। নিজেরও মন-মেজাজ খারাপ। এইচএসসিতে ১১তম স্ট্যান্ড করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেজ অনুষদে ভর্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে সনদের অভাবে ভর্তি হতে পারবো না এ চিন্তায় আমার রাতের খুম হারাম। দিনের খাওয়া বন্ধ। পরদিন ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে কুমিল্লা রওয়ানা দিলাম। ”এ পথ যেন কভু শেষ না হয়” গানটি ”এ পথ কখন শেষ হবে” রূপে পরিবর্তন হয়ে মাথায় বাজছে। কুমিল্লায় পৌঁছে কলেজের অধ্যক্ষর বাসায় গেলাম রেসকোর্সে। স্যারের সুপারিশ নিয়ে বোর্ডে পৌঁছতে দুপুর দুটো। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছি। এক লোক আমাকে থামালো। বললো কী কাজে আসছো ভাই? তাকালাম। খুব সুন্দর চেহারা। লম্বা, ফর্সা ও কোর্ট-টাই পরা। হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি আমার সমস্যা ও প্রয়োজন বললাম। ওনি বললেন এটা কোন বিষয় না। তোমার সনদের ফটোকপি ও আবেদনের ফটোকপি এক কপি করে দাও। দিলাম। বললেন পাঁচশত টাকা দাও। দিলাম। ওনি বললেন। তুমি এখানে থাকো। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে সব নিয়ে আসছি। বিশ্বাস করে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলাম। সেই যে গেলো আর এলো না। বুঝলাম ঠকে গেছি।কৈশোর পার হওয়া সাদা মনের মধ্যে বড় ধাক্কা লেগেছিল। ঠেকে শেখা বড় শেখা। দোতলায় সংশ্লিষ্ট শাখায় গেলাম। সেখানে অনেক চেষ্টার পরে একজন অফিসারের রুমে ঢুকতে পারলাম। অফিসারকে সব বলার পর। তিনি চা খেতে খেতে বললেন আজতো তিনটা বেজে গেছে। ঠিক আছে কাল এসো। আমি বললাম আমি তো অনেক দূর থেকে এসছি আর আমার জরুরি দরকার। তিনি পিয়নকে ডেকে আমাকে বোঝাতে বললেন। পিয়ন ওনার সামনে থেকে আমাকে সুন্দর করে আনলেও বাইরে এনে এমন এক ধমক দিলেন যে আমার চোখ ভিজে উঠেছিল। অসহায়ের মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম।তখনো জানতাম না সূর্যের চাইতে বালি গরম। বুঝলাম। বিপদ একা আসে না। একটার পর একটা ভেড়ার পালের মতো আসে।সুতরাং উপায় নাই। যাক পরের সব কথা আর না বলি। ঝর্ণা বা নদী থেমে থাকে না। গন্তব্যে পৌঁছেই।
সেই থেকে দুটি নিয়ম আমি মেনে চলি ।১. আমার কাছে কেউ কোন সেবার জন্য এলে সরাসরি নিজে শুনে দ্রুত সিদ্ধান্ত ও সেবা দিতে চেষ্টা করেছি। কেবলি সে দৃশ্য চোখে ভাসে। কতদূর থেকে জানি মানুষটি সেবা নিতে এসছে। ২. কোন কাজে কোন অফিসে গেলে যা বলার সরাসরি অফিসের মূল বস বা দায়িত্ববান কর্মকর্তার সাথে কথা বলি। দালাল বা ছোট কর্মচারীদের কাছে যাই না (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )