পাঁচটি শৈশবস্মৃতি
শৈশবস্মৃতিতে কাতর
ড. সফিকুল ইসলাম
১।
যেসব খাবার আমার নানী বানাইতো, তখন খেতে চাইতামনা আর এখন বড় হয়ে জানি সেগুলোই উত্তম সুষম খাদ্য। উন্নত বিশ্বে এসে দেখি খুবই সত্য।
১। সীমের বিচি, মশুরির ডাল, মাসকলাইর ডাল, ইত্যাদি হালকা টেলে পরে লবন ও সামান্য চাল দিয়ে সিদ্ধ করতো। বলতো হিজনা। বড় অমৃত।
২। মিষ্টি কুমড়ার বিচি, সীমের বিচি, কাঠালের বিচি ভাজা।
৩। কৃমি দূর করার জন্য কাঁচা হলুদের রস, বাইট পাতার রাস, বাসক পাতার রাস, চুনের পানি, আরও কত কত পাতার রস।
সব নানী নিয়মিত করতো, সুযোগ পেলেই করতো। আহা! আবার যদি সেদিন আসতো, আবার যদি খেতে পারতাম। ফিরিয়ে দাও সেসব খাবার, ফিরিয়ে নাও তোমাদের আধুনিক খাবার আর এলোপ্যাথিক ট্যাবলেট।
২।
একদিন নানা তাঁর পুকুরে জাল ফেলার ব্যবস্থা করলো। গাবর ব্যাটা (জেলে) বড় বড় কাতলা রুই মাছ ধরে এনে উঠানে রাখলো। একেকটা ৪-৬ কেজি সাইজ। নানু, বাড়ির কাজের মহিলা আর পাশের প্রতিবেশী একজন চৌকিতে বসে মাছ কাটতেছে আার আমি দেখতেছি। মাছের আঁশটেগুলো অনেক বড় বড়। সোনালী সাদাটে চকচকে আঁশটেগুলো আমি হাতে নিয়ে খেলছি। নানু গল্প করছে আর আমাকে বলছে-
জানিস, এ বড় আঁশটেগুলো যদি তুই আজকে মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখিস, তাহলে কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবি সবগুলো আঁশটে পয়সা হয়ে গেছে। বড় আঁশটেগুলো এক টাকার কয়েন, আর ছোট আঁশটে গুলো ৫০ পয়সার কয়েন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম সত্যি? নানু মাথা নাড়লো। সাথে আরো যারা ছিল তারাও সত্যের পক্ষে জয়গান গাইলো। আমি যেন কল্পনায় হারিয়ে গেলাম। কাল সকালেই অনেক পয়সার মালিক হবো আমি। সত্যি সত্যি সবাইকে না দেখিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকগুলো মাছের আঁশটে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মাটির নিচে পুঁতে রাখলাম।
সারারাত আমার ঘুম হয়না ভাব। ঘুমালেও স্বপ্নে দেখেছি আমার হাতে শুধু পয়সা আর পয়সা। পয়সা দিয়ে শিশু বেলার যতকিছু কেনার কথা ভাবা যায়, সব কিনে ঘরে এনে সাজিয়ে রাখছি আর মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাচ্ছি, আর খেলার সাথীদের খেলনা দেখিয়ে বেড়াচ্ছি। সবই স্বপ্নে। যাই হোক, সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে দৌড়ে গেলাম চেক করতে। মাটি খুঁড়ে দেখি মাছের আঁশটে আঁশটেই রয়ে গেছে। মাথাটা খালি হয়ে গেলো, বুকটা শূণ্য হয়ে গেলো। স্বপ্ন ভঙ্গ হবার ধাক্কায় নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হয়েছিল। বড়রা কষ্ট পেয়ে যখন ‘ম্যারা জীবন কোরা কাগজ কোরাই রহে গয়া‘ গান গায়, তখন যেরকম লাগে সেরকম লেগেছিল আমার শিশুমনে।
এখব বড় হয়ে বুঝি জীবনের সকল পর্যায়েই আমরা আকাশে রাজবাড়ি বানাই, শূণ্যের উপর ঘর তুলি।
৩।
চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হতো কসবার মেহারী গ্রামে বটগাছের নিচে আর নবীনগরের কাইতলার ডাক্কাবুক্কার মেলা। তখনকার দিনে বিশ্বাস ছিল চৈত্র সংক্রান্তির আগের রাতে যদি গোসল করা হয় তাহলে আর সারাবছর শরীরে খুশপাচরা টাইপ চুলকানি হবেনা। উল্লেখ্য তখন শীতকালে অনেকেরই খুশপাচরা বা গোটা হতো। ফোড়া হতো।
তবে আর কি, নানু খুব ভোড়ে রাত তিনটায় তুলে দিতেন শীতের মধ্যে আমরা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গোসল করতাম। সাথে কুপি বাতি নিয়ে যেতাম। পুকুরের চতুর্পাশে কুপি বাতির আলোয় টিম টিম করছে চারপাশ। পুকুরে গোসলে শব্দ, সাঁতারের শব্দ। যদিও আমার কখনো খুশপাচরা হয়নি। তবে যাদের হতো তারা চৈত্রসংক্রান্তির রাতে গোসল করার ফলে চুলকানি বা খুশপাচড়া বন্ধ হযেছিল কিনা তা প্রমান করতে কোন জরীপ করিনি।
তবে রাত্রিটি আমাদের খুব ভালো যেতো। পরের দিন মেলায় যাবো, লাগাড় মুড়ি কিনবো, ডেড্রি কিনবো, বাঁশি বাজাবো, বেলুন উড়াবো, এ চিন্তায় শীতের রাতে এ কষ্টকে কোন কষ্টই মনে হতোনা।
৪।
তখন ক্লাস এইটে পড়ি। খুব ছোটই বলা যায়। তখনো হাফপ্যান্ট খুলে পুকুড় পাড়ে ঢিল মেরে ফেলে পানিতে ঝাঁপ দিই। তার মানে ছোটই।
কসবা উপজেলার ভল্লবপুর থেকে মেহারী বাজারে গেছি। পূর্বপাশে ব্রিজের আগে একটি আটার মিল ছিল। ওটার সামনে দুই লোক ঝগড়া লাগছে। একজনের নাম ফিরো আর এক জনের নাম জাহা (আসল নাম দিলামনা)। দুজনের বাড়িই বাজারের দুই পাশে। তবুও ফিরো একটু অবস্থাশালী বা প্রভাবশালী ছিল। (হয়তো, যদিও তখন এসব তেমন বুঝিনা।) ফিরো বেশি মারমুখী। জাহা ও ছাড়বার পাত্র না। পিছিয়ে যাচ্ছেনা। ফিরোর সাথে আরও দুএকজন ছিল। মারামারি তুঙ্গে। ফিরোদের হাতে নৌকার বৈঠা ছিল।
চারপাশে লোক জমে যাচ্ছে। সবাই দেখছে। কিন্তু কেউ ফিরাচ্ছেনা। আমি ছোট মানুষ তবু আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলাম। এদিকে ফিরাই, ওদিকে ফিরাই। এরা অন্যপাশ দিয়ে আক্রমণ করে। এরই মধ্যে বৈঠার একটি আঘাত আমার মাথায় লাগে। আমাকে আঘাত করেনি। ফিরো যখন জাহাকে আঘাত করতে যাবে, তখন বৈঠা ঘুরানোর সময় উল্টা বারিটা আমার মাথায় লাগে। আমার মনে হলো সামান্য আঘাত। আমি তাদের ফিরিয়েই যাচ্ছি। এরে ধরি একবার, ওরে ধরি আরেকবার। তখন একজন দৌঁড়ে এসে আমাকে ধরে বলে ‘এই, তোমার মাথায় দেখি রক্ত।
আমি অবাক হয়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখি, হ্যাঁ রক্ত। তখন সবে মারামারি রেখে তাড়াতাড়ি আমাকে নৌকায় নিয়ে মাথায় পানি দেয়। পানি লাল হয়ে যাচ্ছে। পরে দ্রুত বাজারে ফার্মেসীতে নিয়ে যায়। বাজারের ফার্মেসীর ডাক্তার প্যারামেডিক আমার মাথা দেখে। দেখেন ফেটে গেছে। তিনি ৬টি সেলাই দেন। ডাক্তারের নাম ডা: জামশেদ (চড়ু ডাক্তার নামে সবাই চিনে)
যাক পরে এ নিয়ে গ্রাম ভিত্তিক কিছু রাজনীতিও হবার চেষ্টা হয়। আমাকে বলা হয় যেন আমি বলি যে আমার মাথায় ইচেছ করে ফিরো আঘাত করেছে। নানা যেহেতু সর্বজন পরিচিত ও শ্রদ্ধেয়, রাতের বেলায় নানার কাছে কয়েকজন মাতব্বরও আসে। দুপক্ষ থেকে কয়েক দফায়। পরে আমার কাছে সব শুনে, নানা বলেন যে, যা সত্য তাই বলবি। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। পরে যখন সবার সামনে জিজ্ঞাসা করা হয়
আমি বললাম, যে না কিছু হয়নি। ওনাদের ঝগড়ার মাঝে আমি ছিলাম। হঠাত করে বৈঠা লেগেছে। কেউ ইচ্ছে করে আঘাত করেনি। কার আঘাত লেগেছে আমি দেখিনি। (যদিও জানতাম কারা আঘাত)। ওটা আমারই দোষ, আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল। পরে আর কোন সমস্যা হয়নি।
এখন মনে মনে ভাবি। কী সরলই না ছিলাম! কী পাগলই না ছিলাম! এখন কী পারবো ওরকম মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেতে?
কয়েকবছর আগেও পেরেছি। রাঙামাটি পাড়াড়ি বাংগালী দাংগার সময়, বিভিন্ন উপজেলায় ইলেকশন ডিউটি করার সময়, হরতাল ডিউটি করার সময়, গণ ধর্ষককে গ্রেফতার করায় একটি ছোট শহর অবরোধের সময়, এমনই নানান সময়ে নির্ভিক হয়ে শান্তি ও শৃংখলা রক্ষায় সবার আগেই ছিলাম, সামনেই ছিলাম। মারা যাবো -এ ভাবনা মাথায় আসেনি।
দিনগুলো মোর ……….যদি এমনি থাকতো সবসময়, এই সরলতা, এই সহজিয়া, এই নির্ভিকতা, এই সুক্ষ্মবোধ……………।
৫।
আম খাওয়ার পরে আমের #বড়া বা #বিচি কী করেন? শহরে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। কিন্তু গ্রামে বাড়ির পাশে ফেলে রাখা হয়। সীমানা ঘেঁষে । সারিবদ্ধ ভাবে। আমের চারা হয় এসব বড়া থেকে। তো আমরা শৈশবে সেসব বড়া থেকে প্রতিদিন বিকেলে দুতিনটা বড়া তুলে নিতাম। নিয়ে বড়া খেলা খেলতাম।
সে খেলার নিয়ম কী? একটি ছোট গোল ঘর আঁকা হয মাটিতে। ঘর থেকে ৫/১০ ফিট দূরে একটা দাগ দিতে হবে। সেই দাগ থেকে সেই গোল ঘরে বড়া ফেলতে হবে। যে ফেলতে পারবে ভিতরে সে খেলা শুরু করবে।
সে নিজের বড়াটি হাতে নিয়ে অন্যের বড়াটি আঘাত করে ছুঁড়ে মারবে। পরে দুটো বড়ার মাঝের স্থানকে পা দিয়ে মাপতে হবে।কত পা হলো গুনতে হবে। মাপা শেষে আবার নিজের বড়াটি যেখানে ছিল সেখান থেকে সেই গোল ঘরে ফেলতে হবে। এবং আবার নিজের বড়াটি হাতে নিয়ে অন্যের বড়াটিকে আঘাত করে ছুঁড়ে মারবে। পরে আবার দুটো বড়ার মাঝের স্থানকে পা দিয়ে মাপতে হবে। মাপা শেষে আবার নিজের বড়াটিকে সেই ঘরে ফেলতে হবে। এভাবে চলতে থাকবে।
যদি নিজের বড়া গোল ঘরে না ফেলতে পারে, কিংবা অন্যের বড়া টাচ করতে না পারে, কিংবা দুটো বড়ার মাঝখানে এক পা সমান জায়গা না হয় তবে অন্যজন আবার একই নিয়মে খেলবে।
এভাবে খেলতে খেলতে ১০০ পা বা পয়েন্ট যার আগে হবে তিনি জয়ী। এবার যিনি জয়ী তিনি কী করবেন? তিনি পরাজিতকে চড় দিবেন। পরাজিত দুহাত মাটিতে সোজা করে রাখবেন, আর বিজয়ী দু পাশ থেকে চড় দিবেন। তবে চড় দিবার সময় যদি পরাজিত ব্যক্তি হাত সরিয়ে নিতে পারে তবে বেঁচে যাবেন। ছোটবেলায় এ খেলায় জিতে অনেককে হাত চড়িয়ে লাল করেছি আর অনেকে জিতে আমার হাত চড়িয়ে কালো করেছে।
এখন আমের সিজন। করোনায় গৃহবন্দী আমার সন্তান শ্রেয়া স্পন্দনকে এ খেলা শিখিয়ে দিলাম। এরা ঘরে খেলে, হারে জিতে এবং ভাইবোন টম অ্যান্ড জেরির ন্যায় চড়াচড়ি করে। গ্রামীণ শৈশব এখন শহরের বাসায়।
শৈশবস্মৃতিতে কাতর আমি আজ!
………..
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )