কবি: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রিয় বই নিয়ে ভাবছিলাম মনে মনে চোখ বন্ধ করে। হারিয়ে গেলাম শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনের শুরুর দিকে, ইউনিভার্সিটির উত্তাল দিনে, চাকুরির শুরুর দিকে। ফ্ল্যাশের পর ফ্ল্যাশে চলে যাচ্ছে মুহুর্তগুলো। বইয়ের পর বইয়ের প্রচ্ছদ চোখের সামনে ভাসছে। চরিত্ররা হাঁটছে বা হাসছে বা কাঁদছে চোখের সামনে। কোনটি ছেড়ে কোনটিকে ধরি, প্রিয় বলি কোনটাকে? নানান কারণে নানান বই প্রিয়। সব সন্তানকেই মা ভালোবাসে। কেবল একটি সন্তান বেছে নিতে বললে মা আড়ষ্ট হয়। এমনকি বহুগামী প্রেমিককেও একজন প্রেমিকাকে খুঁজতে বললে কাকে ছেড়ে কাকে নিবে ঠাহর করতে পারে না। একে ধরলে অন্যজন যেন আড়ে আড়ে ডাকে। আমার হয়েছে সেই অবস্থা। তবুও কারণ অকারণের খেলায় না গিয়ে, কোনো ভিত্তি বা নির্ধারকের নিক্তি দিয়ে মাপতে গেলাম না। কেবল একটি প্রশ্ন করে প্রিয় একটি বই বাছাই করলাম। কোন বইটি পড়ার পরে আমি কয়েকদিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম? চট করে কয়েকটি বইয়ের মধ্যে একটি বই সবার আগে চোখের পলকে মগজের চোখে ঝলক দিল। বইটির নাম ‘কবি‘। হ্যাঁ তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘কবি‘।
অনেকদিন আগে পড়া। তাই বিস্তারিত মনে নেই। যা যা মনে আছে তাই ধরে প্রিয় বইটি নিয়ে লিখি। এ বইয়ে প্রধান চরিত্র ছিল নিতাই নামের একজন। তার পূর্বপুরুষ ছিল ডাকাতশ্রেণির। চোর-ডাকাত বংশের ছেলে, খুনির দৌহিত্র, ডাকাতের ভাগিনা, সিঁদেল চোরের পুত্র। ডাকাত বংশে জন্ম নিয়েও নিতাই হয়ে গেলো কবি, বোহেমিয়ান ও আবেগী এক অসাধারণ চরিত্র। নিতাইয়ের ছিল হাঁটার নেশা, ঘুরার নেশা, কবিগান শোনার নেশা, ঘরের পর ঘর ছাড়া, স্থানের পর স্থান ছাড়ার নেশা। নিতাই ভাবতো ইশ্বর তাকে কবি প্রতিভা দিয়েছে।স্বত:স্ফুর্ত, অলৌকিক প্রতিভা, কবিত্ব শক্তির নেশায় সে হতে চাইলো ব্যাতিক্রমধর্মী, বংশের অন্যদের মতো নয়। সেই প্রতিভা বিকাশে সে পিতৃভিটা ছেড়ে স্টেশনে চলে যায়। স্টেশনে ছিল রাজন নামের এক বন্ধু যে নিতাইকে ‘উস্তাদ‘ বলে ডাকতো। কবিগান শুনতে শুনতে নিতাই নিজেই কবিগান গায়। গাইতে গাইতে বিভিন্ন স্থানে যেতে যেতে কবি হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ‘গোবরে পদ্মফুল‘যেমন বাংলার প্রবাদ, তেমনি নিতাই যেন এর ভিন্ন নাটাই। সে নিজেকে ভিন্নরূপে ভিন্ন পরিচয়ে পায়। তাইতো স্টেশনে থাকার সময়ে সে তার নিজের পরিচয় দেয় এই বলে- ‘‘আজ্ঞে প্রভু, চুরি জীবনে আমি করি না, মিছে কথাও বলি না, নেশা পর্যন্ত করি না। একারণে জাত-জ্ঞাত, মা-ভাইয়ের সাথে বনে না আমার, ঘর তো ঘর, পাড়া পর্যন্ত ত্যাজ্য করেছি একরকম। আমি থাকি ইস্টিশানে রাজন পয়েন্সম্যানের কাছে। কুলিগিরি করে খাই‘‘। নিজেকে জগতে রেখেই ভিন্নজগতে নিয়ে যাওয়ার খেলা পেয়ে বসে নিতাইয়ের মাথায়। মনন ও মগজ তার নতুন আবেশে নিবদ্ধ।
এসবেরই ফাঁকে ভবলীলার অবশ্যাম্ভাবী লীলায় নিতাই জড়িয়ে যায়। রাজনের শালিকা ঠাকুরঝির সাথে পরিচয় ঘটে। যদিও সে অন্যের বধু তবু সে নিতাইয়ের মনে দাগ কাটে। নিতাইর গান শুনতে শুনতে ঠাকুরঝি নিতাইর প্রেমে পড়ে যায়। অন্যের বউয়ের সাথে প্রেম! এও কি সম্ভব? কিন্তু মনতো আর সয় না, বাধা মানে না। তাইতো নিতাই স্বগতোক্তি করেছে ‘‘অবাধ্য মন লজ্জা পায় না, দুঃখিত হয় না।” স্বভাবজাত অবাধ্য হয়ে নিতাই তাই অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে ঠাকুরঝির দিকে। ভাবনার গভীরে হারিয়ে যায়। মনে মনে গায় ‘‘“চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে ব’লে কে দেখে না চাঁদ? তার চেয়ে চোখ যাওয়াই ভাল, ঘুচুক আমার দেখার সাধ।” যদিও রাজন শালিকাকে নিতাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে উদ্যত হয়, নিতাই তা প্রত্যাখ্যান করে। সামাজিক বাধাকে সে আমলে নেয়, অন্যের সংসার ভাঙ্গাকে সে অন্যায় ভাবে। বুকের গহীনে প্রেম চাপা দিয়ে সে গানের দলে দূরের দেশে পাড়ি জমায়। ঠাকুরঝির প্রতি তার প্রেম প্রকাশ পায় এভাবে ।“ চাঁদ তুমি আকাশে থাকো, আমি তোমায় দেখবো খালি‘‘।
গানের দল তথা ঝুমুরদলের সঙ্গে নিতাই মিশে প্রধানত বসন্তের জন্য। সুন্দর হাসি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বসন্ত বশ করে নিতাইকে। নিতাই ঠাকুরঝিকে খুঁজে পায় বসন্তের মাঝে। বসরন্তের ডাকে সাড়া দিয়ে নিতাই ঝুমুর দলে অন্তর্ভূক্ত হয়। বসন্ত দেখতে সাধারণের চোখে কদাকার ছিল, তবু তার মাঝেই নিতাই হারিয়েছিল। স্তব করে লিখেছিল ‘‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেনে? কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে? ‘‘ গানবাজনা ও নৃত্য, আর কিছুটা অশ্লীলতা ছিল এই ঝুমুর দলের নিত্য বিষয়। আসলে ঝুমুরদলের সঙ্গীরা সবাই দেহাপজীবিনী। নিতাই তার মৌলিক কবিয়াল সত্তাকে চেপে রেখে দলের চাওয়া অনুসারে গান রচনা ও পরিবেশন করে চলে। ফলে জনপ্রিয় হয়ে যায় সবার কাছে। দেহব্যবসায় জড়িত ছিল বিধায় বসন্ত আক্রান্ত হয় মরণব্যাধীতে। বসন্ত মারা গেলে নিতাই ছেড়ে দেয় এই ঝুমুরদল। পরকিয়া বা দেহব্যবসাকে নিতাই ঘৃণা করতো কিন্তু বসন্তকে সে পবিত্রজ্ঞান করতো। ঝর্ণার ধাক্কা খেয়ে খেয়ে যেমন সবুজ ঘাস আরও সবুজ হয়ে উঠে, তেমনি নিতাইর কাছে বসন্ত যেন এসবের মাঝেও ভিন্ন এক সজিব সত্তা ছিল। কিন্তু বিধির লীলায় নিতাই বসন্তকেও হারায়।
এভাবেই দুনিয়া তার কাছে তুচ্ছ হয়ে উঠে কিংবা ভালোবাসা তার কাছে পরম আরাধ্য হয়ে ওঠে। মনের গভীর থেকে সে গেয়ে ওঠে-
“এই খেদ মোর মনে মনে,
ভালবেসে মিটল না আশ, কুলাল না এ জীবনে।
হায়! জীবন এত ছোট কেনে!
এ ভুবনে?”
এই লাইনটি এখনো ভুলিনি। এখনো মনে দাগ কেটে আছে। জীবনে কতখানে কত পরিস্থিতিতে এ লাইনটি বিড়বিড় করে আওড়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। জীবনঘনিষ্ঠ আখ্যানের মাধ্যমে লেখক নিতাইয়ের মুখ দিয়ে যে দার্শনিক বক্তব্যগুলো উপস্থাপন করেন, তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। এমনি প্রতিটি পাঠাকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় এবং আত্মজিজ্ঞাসায় তাড়িত করে। কবি পড়তে পড়তে আমরা নিজেদের জীবন ও স্বজন-পরিচিতদের চলে যাওয়া জীবনের দিকে তাকাই। জীবনের পরতে পরতে থাকা সকল অনুঘটনার হিসেব মেলাই।
প্রেমপিয়াসী নিতাইর মন অস্থির হয়ে ওঠে। শান্তির জন্য সে কাশী যাত্রা করে। কিন্তু সেখানেও তার পরিবেশ সুবিধাজনক ছিল না। ভেবেছিল গান গেয়ে বাকি জীবন কাশীতে কাটিয়ে দিবে। কিন্তু নিতাইয়ের কবিয়ালী গান কাশীর লোকেদের পছন্দ হয় নি। দিনের পর দিন সহ্য করতে করতে তার মন আবার অশান্ত হয়ে উঠে। মনে পড়ে কেবল রেল স্টেশন, রাজন, ঠাকুরঝি, নিজের গ্রাম। শেকড়ের টানে আবার পিছু টানে ফিরে। লিখে-
‘‘তোর সাড়া না পেলে পরে মা, কিছুতেই যে মন ভরে না
চোখের পাতায় ঘুম ধরে না, বয়ে যায় মা জলের ধারা‘‘
চারপাশে যার আনন্দ বেশি তার ভেতরে যেন অপার বেদনা। নিতাইর হয়েছিল সেইরকম অবস্থা। নিতাইয়ের গভীর প্রজ্ঞা নিয়ে বড় কবি হওয়ার উচ্চাশা ছিল, কিন্তু স্বভাবসুলভতা, পারিপার্শ্বিকতা ও সমাজ তার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়েছিল। চরম হতাশা থেকে নিতাই গায়
‘‘জীবনে যা মিটলো না কো
মিটবে কি তাই মরণে?‘‘
উপন্যাসটি কেন ভালো লাগলো আমার? আসলে এটি পড়ে পড়ে আমি নিজেই নিতাই হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো আমিই নিতাই কিংবা নিতাই-ই আমি। তার সব কথা, কল্পনা, চলাফেরা ও স্বভাবদোষে আমার অন্তর্ভেদী মন এমন আবেশিত হয়েছিল যে বইটি পড়ার পরে নিতাইয়ের জীবনসায়াহ্নে যেরকম লাগছিল, আমারও তেমন লাগছিল। অশ্রুসজল চোখ আর ভেজা মন তখন ভাবছিল ‘তুচ্ছ এ জীবন‘। ভেবেছিলাম আমি নিতাই হতে চাই, কিংবা আমি নিতাই হয়েই জন্মেছি।
উপন্যাসটিতে মানুষের উথ্থান-পতন, জয়-পরাজয়, আর প্রত্যাশা-প্রাপ্তির আড়ালে লেখক বিচিত্র অবসরে পাঠককে জানিয়েছেন মানবজীবনের অনেক গূঢ় বার্তা। যেকথাগুলো এমনিতে বললে খটখটা লাগবে, আজাইরা প্যানপ্যানানি মনে হবে, সেই কথাগুলোাই তারাশঙ্কর গল্পের ছলে সুনিপূণ ভাষায় কবিয়াল অনুভবে লেখার মুন্সিয়ানায় নিতাইয়ের জীবনের প্রকাশে তুলে ধরেছেন অন্যরকমভাবে। পৃথিবীতে প্রতিদিনের আচরণে যেসব ঘটনা ঘটে, যেসব নিরীক্ষা ও দর্শন প্রকাশ পায় সেসবের নানান চিত্র ফুটে উঠেছে বইটিতে। এত ছোট পরিসরের এ বইয়ে কত গভীর ভাবনা, কত দার্শনিকতা, কত জীবনের আঁক ও বাঁক প্রকাশ পেয়েছে তা না পড়লে বোঝা যাবে না। শুধু পড়লেই হবে না, থাকতে হবে সেরকম মন ও বোধ।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )