Detail

Home - ভ্রমণ কাহিনী - বার্ন ও জুরিখ

বার্ন ও জুরিখ

বার্ন

জেনেভাতে বন্ধু আলমগীরের বাসাতে সকালে নাস্তা খেয়ে বের হয়ে পড়ি। বার্ন যাবো বলে এ যাত্রা। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে কোনটি আমার লাইন? তা বুঝতে সময় লাগে। ঘুরাঘুরি করে রেলের লোকদের জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হই। পরে ট্রেনে উঠে পড়ি। জেনেভা লেকের পাশ দিয়ে ট্রেন ছুটতে থাকে। আগের দিন দুপুরে দেখেছিলাম এ লেকের সৌন্দর্য, আর আজ ভোরে যেন লেক আর প্রকৃতি অন্যরকম সৌন্দর্য ঢেলে দিলো। বেলায় বেলায় প্রকৃতি পরিবর্তন হয় কিন্তু প্রতিবেলাতেই এত মুগ্ধতা রেখে দিতে পারে তা কেবল জেনেভা লেকের পক্ষেই সম্ভব। যাই হোক, ট্রেন ছুটতে থাকে, সকাল ছয়টায় রওয়ানা দিয়ে নয়টায় পৌঁছলাম।

ট্রেন থেকে নেমে ব্যাগ ও ব্রিফকেস স্টেশনের সিকিউরিটি বক্সে রাখলাম। বার্ন থেকে পরে জুরিখ যাবো সেই টিকিট কাটলাম। পরের ট্রেন ১২ টায়।
তারপর ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারে গিয়ে বললাম ‘আমার হাতে তিন ঘন্টা সময় আছে, বার্ন সিটি দেখতে চাই। ভদ্রমহিলা হাসি দিয়ে বললো বার্ন খুব ছোট, তুমি অনেক কিছু দেখতে পারবা। মানচিত্র ধরিয়ে দিল, কলম দিয়ে দাগিয়ে দেখিয়ে দিল। ওল্ড বার্ন দেখতে বেরিয়ে গেলাম। টানা তিনঘন্টা হাঁটলাম। অলিগলি চষে বেড়ালাম। প্রাচীনতম চার্চ, ঘড়িটাওয়ার, নদীর ধার, ইউনিভার্সিটি, রিভারভিও, আইনস্টাইন মিউজিয়াম, আল্পস মিউজিয়ামসহ নানান জায়গা।বার্ন হিস্টরিক মিউজিয়াম বন্ধ ছিল আজ তাই দেখতে পেলামনা। বাজার বা মার্কেটের অলিগলি, পুরাতন ভবন, স্থাপনা, পার্ক কী নয়!?

অন্যান্য দেশের রাজধানী শহরগুলির থেকে আলাদা এই শহর। রূপকথার মতো সুন্দর শহরটির ওল্ড টাউনটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্লড হেরিটেজ টাউন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পরিবার নিয়ে জীবনের কয়েকটি বছর এ শহরেই কাটিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন। সেই বাড়িটি এখন মিউজিয়াম।

বার্ন শহরটি ঢাকার কোনো ছোটো অংশের সমান। কিন্তু পুরাতন সব ভবন, পুরণো রাস্তার ধরণ, ভবনগুলোর রঙ ও রূপ এমন করে রাখা

জুরিখ

এসএসসি পরীক্ষার আগে তিনমাস কালসার গ্রামে ছিলাম। আমার ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল শিল্পীর বড় ভাই, আলম ভাইকে দূর থেকে দেখতাম। সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে এসেছেন। ইউরোপ ফেরত, দেখতেও সেরকম স্মার্ট ও সুন্দর। ভাবসাবও আলাদা। আমরা স্বপ্ন দেখতাম, একদিন ইউরোপ যাবো, সুইজারল্যান্ড যাবো।
সেই আলম ভাইয়ের সাথে দেখা অনেক বছর পর। আমি সুইজারল্যান্ড যাবো শুনে তিনি নক করেছেন পরশুদিন। এবং ওনার জুরিখে যেতে বলেছেন।
যথারীতি আমি পৌঁছার আগেই তিনি স্টেশনে পৌঁছে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘুরাঘুরির সব আয়োজন ও টিকেট কেটে রেখেছেন।
আমাকে রিসিভ করে ট্রামলাইনে চড়িয়ে বাসায় নিলেন, দুপুরে খাওয়ালেন। এরপরে বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড় ঘেঁরা ছোট্ট সাজানো শহর

পরে রাইন ফল দেখার জন্য নিয়ে গেলেন । ট্রেনে করে জুরিখ থেকে ৪৫ মিনিটের পথ। স্টেশনে নেমে কিছুটা পায়ে হেঁটে গেলাম রাইন জলপ্রপাতের কাছে। অবাক করে দেয় এর ব্যাপ্তি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। চারপাশের নানান বাহারি সবুজ গাছগাছালি,বাহারি রঙের ফুলের সমাহার  আর আকাশে মেঘেদের খেলা সৌন্দর্যকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। স্রোতের আওয়াজে বুকের ভেতরে কেমন যেন হো হো করে ওঠে। জলের উপরে জলের ধারা পড়ে পড়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। আরও হাজারও জলরাশি কোথা থেকে আসছে – এসব ভেবে আমি কুল কিনারা পাইনা। সৌন্দর্যকাতর হয়ে, প্রকৃতির গভীরতা ভেবে আমি বিহবল হয়ে পড়ি।

আবার জুরিখ সিটিতে নিয়ে আসলেন। আমি বললাম ‘‘শুনেছি জুরিখ সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর। যা সুইজারল্যান্ডের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। পর্যটকদের জন্য জুরিখ আকর্ষণীয় জায়গা। চলেন কী কী দেখাবেন দেখি।‘‘ আমরা ট্রামে উঠলাম। একটু পরপর থামছে। তেমন ভীড় নেই। শান্ত শহর। মানুষজন নিরিবিলি। কারো কোনো তাড়াহুড়া নেই। আমি আর আলম ভাই ট্রামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করি। কোনো সুন্দর স্থাপনা বা বিষয় দেখলে প্রশ্ন করি। আলম ভাই উত্তর দেয়। আমি জুরিখকে বোঝার চেষ্টা করি।   ট্রামে করে পুরো শহর দেখলাম।

এরপরে গেলাম লেক জুরিখে। পরিস্কার এ হ্রদটি Bellevue এলাকা থেকে tiefenbrunnen পর্যন্ত তিন কিলোমিটার বিস্তৃত। রৌদ্রজ্জল দিনে সময় কাটানো এ লেক আদর্শ জায়গা। লেক জুরিখের জলে সাঁতার কাটা কিংবা নৌকা ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। আমি নৌকায় চড়লামনা, তবে হাঁসেদের সাঁতার কাটা দেখলাম। সুইস ব্যাংকে যাবো বলে

আমার প্যারিসে যাবার টিকেট কাটলেন, আমাকে বেলবি লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখালেন। তুলে দিলেন শত শত ছবি। রাতে গোসল, খাওয়ানো, ইত্যাকার সব দেখভালো করলেন। সারাটা দিন সময় দিলেন। আমারে সময় দিবেন বলে অফিসে আবেদন করে ছুটি নিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা পানি করিয়ে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে গেলেন। পথে কী কী খাবো তাও প্যাকেট করে দিয়ে দিলেন। ফল ও কোমল পানীয়।
সারাটাদিন আমার চেয়ে আমার জন্য তিনি বেশি ব্যস্ত ছিলেন, কোথায় কী লাগবে, কী কী দেখবো, কীসে আমার ভ্রমন সুন্দর হবে সব বিষয়ে শার্প নজর ছিল। আমার চেয়ে বেশি জোরে হেঁটেছেন, আমার চেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন।

ওনার অফিস আজ, অফিসে গিয়েছেন এখন বোধ হয়।
তিনি যা করেছেন তা আপন ভাইয়ের জন্যও মানুষ করেনা। সেদিকে যাচ্ছিনা।

যেটা েআমার ভালো লেগেছে সেটা হলো আলম ভাইয়ের সপ্রতিভ সক্রিয়তা, কর্মচাঞ্চল্য, বিনয়, সবদিক খেয়াল রাখার সার্বক্ষণিক দৃষ্টি আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা। আজকালকার পোলাপানের মধ্যে এসব দেখা যায়না। খালি শটকাটে বড়লোক হতে চায়।
এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের বড় সন্তান তিনি। ৯০ এর দশক থেকে আলমভাই ইউরোপে ছিলেন, পরে দেশে গিয়ে ব্যবসা করেছেন কিছুদিন, পরে আবার ইতালিতে ব্যবসা করেছেন, এখন জুরিখে জব করছেন। সব ভাই বোনকে পড়াশোনা করানো, বিয়েশাদী করানো ও সেটল করায় ভূমিকা রেখেছেন। এখনো অফিস করে যাচ্ছেন। দুই মেধাবী মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও এক ছেলে স্কুলে বাংলাদেশে পড়ছে ।
..
নতুন প্রজন্মকে আমি শুধু এটাই বলবো যে আলম ভাইয়ের যে সপ্রতিভ সক্রিয়তা, কর্মচাঞ্চল্য, সারল্য, সহজ মনোভাব, সবদিক খেয়াল রাখার সার্বক্ষণিক দৃষ্টি আর পরিশ্রম করার চর্চা দেখেছি তা যদি তোমরা করো তবে তোমরা অনেক দূর যাবে। দেশকেও এগিয়ে নিতে পারবে।
একটিভ না হলে, পরিশ্রমী না হলে, চারপাশকে বুঝতে না পারলে, কোথাও কিছু হবেনা। নিজেও বোঝা হবা, দেশকেও বোঝা বানাবা।

খালি সেলফি তুলে মার্কেট পাওন যাইবো?

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart