Detail

Home - সমসাময়িক - প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ: সেকাল একাল

প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ: সেকাল একাল

অনেকেই বলে থাকেন যে, সাধারণ জ্ঞান এর কমন কিছু বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিসিএস এ প্রার্থী নির্বাচন সঠিকনা। মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে কি আর দেশ চলে? আসলেই কি তা হয় বাস্তবে? না, তা হয়না। তিনটি ধাপে পরীক্ষা হয়। প্রথম প্রিলিমিনারিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞানের বাংলাদেশ ও বিশ্ব অংশের সম্মিলনে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদেরকে আবার লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। ১০০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ভূগোল, আইসিটি ইত্যাদির মিশেল থাকে। পরে ভাইভাতেও প্রার্থীর যোগ্যতা ও প্রকাশভঙ্গী দেখা হয়। যার মাধ্যমে এক জন প্রার্থীর বেসিক ভিত্তি পরীক্ষা করা হয়। চাকুরির জন্য প্রতিটি ক্যাডারে ইন-সার্ভিস ও অফ-সার্ভিস ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। যাদের বেসিক ভিত্তি ভালো তাঁরা চাকুরি জীবনের সকল প্রশিক্ষণ ও কাজের মাধ্যমে বাকি সব রপ্ত করতে নিতে পারেন। এই যে রপ্ত করার ক্ষমতা আছে কিনা সেটাই বিসিএস এ লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় চেক করা হয়। যার বেসিক যত ভালো তার সকল ক্যাডারেই তত ভালো করার সুযোগ আছে। ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের জন্য কে বিজ্ঞানী, কে ডাক্তার, কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কে বড় গবেষক তা বিবেচনা করা হয়না। করার প্রয়োজনও নেই। এখানে দেখা হয় কার কতটুকু বেসিক ভিত্তি ভালো। সকল বিষয়ে যাদের মৌলিক জানা ভালো  তাদেরকেই নেওয়া হয়।

এখন প্রশ্ন হতে পারে এরকম বাছাই প্রক্রিয়া কি সারাবিশ্বেই হয়? উত্তর হ্যাঁ। সারাবিশ্বেই হয়।  এমন কি প্রাচীন আমল থেকেই এভাবে বেসিক ভিত্তি ধরেই   আমলাতন্ত্রে নিয়োগ হয়ে আসছে।

প্রাচীন আমলে সবচাইতে প্রখর আমলাতন্ত্র ছিল চীনে। আমরা যদি চীনের মেধা যাচাই প্রক্রিয়া দেখি তাহলে দেখবো তারা আমলাদের বাছাই করতে নিচের ৬টি বিষয়ের পরীক্ষা নিতেন।

১. গণিত শাস্ত্র

২. লেখা ও পড়া

৩. সঙ্গীত

৪. ব্যক্তিগত ও জনজীবনের নিয়ম আচার ও উতসব সংক্রান্ত জ্ঞান।

৫. তীর ধনুক চালানো

৬. অশ্বারোহন।

শেষোক্ত দুটো সামরিক আমলাদের জন্য অপরিহার্য ছিল, যা এখনো আছে বাংলাদেশের পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে। অন্যদের জন্য ৫ ও ৬ এর বদলে আইসিটি বা ইনফরমেশন টেকনোলোজির পরীক্ষা নেওয়া এখন জরুরি। কারণ আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে  আইসিটি নখর্দপনে রাখা জরুরি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রশ্নের বিষয় ও ধরণে পরিবর্তন এসেছে। গত ত্রিশ বছরেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

এমনকি আধুনিক ইংল্যান্ডেও সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের জন্য এরকম বেসিক বিষয়গুলোর উপরেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রথমে প্রাথমিক  স্ক্রিনিং (যেটা আমাদের প্রিলিমিনারির মতো), পরে লিখিত ও ভাইভা। সেখানেও মূলত দেখা হয় যে চাকুরিতে প্রবেশের জন্য প্রার্থীর প্রতিটি বিষয়ে বেসিক জ্ঞান উঁচু মানের কিনা।

অনেকে এও প্রশ্ন করেন যে চাকুরিতে নিয়োগের সময় বা প্রমোশনের সময় কে কোন পার্টির সমর্থক তা দেখা হয়। এটা কি সমীচীন? ঔচিত্য অর্থে এটা সমীচীন নয়। কিন্তু আমরা বাস্তবতা বিবর্জিত হলে হবেনা। সেই প্রাচীন আমল থেকে আজ অবধি ক্ষমতাসীন রাজত্ব নিজস্ব জাত, শ্রেণী, বিশ্বাসের লোকদেরকে প্রাধান্য দিয়েছে। হিন্দু রাজ্যে হিন্দুদের আধিপত্য, মুসলিম রাজ্যে মুসলিমদের আধিপত্য, ক্রিশ্চিয়ান রাজ্যে ক্রিশ্চিয়ানদের আধিপত্য, উপজাতিদের এলাকায়  তাঁদের নিজস্বদের আধিপত্য, বামদের দেশে বামপন্থীদের আদিপত্য, ডানপন্থী দেশে ডানপন্থীদের আধিপত্য এরকম আছে। আগেও ছিল, এখনো বিদ্যমান। ইউটোপিয়ান হয়ে পৃথিবী চলেনা। পৃথিবী চলে স্বার্থপরদের খেলায় এবং ক্ষমতাসীনরা নিজেদের মতো করে বেছে নিবে এটাই চলিত রেওয়াজ। প্রাচীন চিনেও আমলাদেরকে ৫টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

১. দেওয়ানী আইন

২. রাজস্ব ও কর

৩. সামরিক কৌশল

৪. কৃষি ও ভুগোল

৫. কনফুসিয়াস দর্শন।

তখন কনফুসিয়াসের প্রভাব ছিল, তাই কনফুসিয়াস পড়ানো হতো। এখন যাদের প্রভাব তাঁদের জীবনী, আদর্শ, চেতনা, শিক্ষা, দর্শন পড়ানো হয়, প্রশিক্ষণে শেখানো হয়, মাথায় মগজে ঢুকানো হয়। এটা হবেই, এটা হওয়ারই। যাদের যখন প্রভাব বা যারা যখন ক্ষমতায় তখন তাদের আইডিওলোজি প্রচার, প্রসার করবে এবং প্রতিটি আমলার হৃদয়ে খোদাই করবে। আমলাদের কাজ হলো ক্ষমতাসীনদের নির্দেশনা বা ম্যানিফেস্টো সুচারুরূপে বাস্তবায়ন। সেটা করতে পারলেই সরকারের সফলতা। এর মধ্যেই যতটা সম্ভব দেশের জন্য যতটা সুদূরপ্রাসারি ভূমিকা রাখা যায়, নাগরিকদের সুখের জন্য যতটা কাজ করা যায় তা আমলারা করে যাবে, ভূমিকা রেখে যাবে। সীমানা ডিঙ্গানো যায়না, ডিঙ্গিয়ে লাভও হয়না।

আমি মনে করি নিজস্ব চেতনা বা বিশ্বাসের লোক নিয়োগ দেওয়া বা প্রমোশন দেওয়া রাষ্ট্রের জন্য মন্দ না। যদি বাছাই করে মেধাবী ও যোগ্য লোককে দেওয়া হয়। ক্ষমতাসীনদের নিজেদের বিশ্বাসের লোকদের মধ্যেও অনেক যোগ্য মেধাবী আমলা রয়েছে। দেশের জন্য ক্ষতি হয়ে যায় যখন বিশ্বাস আর রাজনৈতিক পরিচয়ের নাম ব্যবহার করে স্বজনপ্রীতি করে বা দুর্নীতি করে অযোগ্য প্রার্থীদের অমেধাবীদের নিয়োগ ও প্রমোশন দেওয়া হয়। দলীয়করণ করেও যদি অধিকতর যোগ্য ও মেধাবীকে নিয়োগ ও প্রমোশন দেওয়া হয় সে ভালো করবে কারণ প্রথমত তার যোগ্যতা আছে, দ্বিতীয়ত তার বিশ্বাস ও প্রত্যয় ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। যার কারণে তার কাজ দেশের কাজকে েএগিয়ে নিয়ে যাবে।

তার মানে আমি বলছিনা যে, শুধু মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দল-মত-নির্বিশেষে নিয়োগ দিলে ভালো হবেনা। সেটা করতে পারলে সর্বোত্তম। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকরী করা দূরূহ। ক্ষমতাসীনরা তা হতে দিতে চায়না। সেই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান। তাই মন্দের ভালো হিসেবে এর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া যেতে পারে।

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart