সঙ্গবিহীন মৃত্যু কি অস্বাভাবিক?
সঙ্গবিহীন মৃত্যু কি অস্বাভাবিক?
সামাজিক জীব হিসেবে সাধারণত মানুষ সান্নিধ্য পছন্দ করে। সবারে নিয়ে থাকতে চায়। দীর্ঘ সান্নিধ্য আর হাজার ভীড়ে থেকে থেকে মানুষ আবার একাও হতে চায়। মানুষ সঙ্গ ছাড়াও বাঁচতে পারে না। আবার অতি সঙ্গতেও হাসফাঁস লাগে। একা একটু নিরিবিলি থাকতে চায়। সম্প্রতি তিনটি মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হচ্ছে ফেসবুকে ট্রল। ড. শামসুর রহমান, কবরি, মুগ্ধা হাসপাতালের সুইসাইড করা ব্যাক্তি। তাঁদের কে কেন কোন পরিস্থিতিতে একা ছিলেন বা মারা গেলেন – তা আমরা জানিনা। আদৌ তাঁরা সার্বিক অর্থে একা ছিলেন কিনা- তাও কি আমরা জানি না। অনেকের আক্ষেপ তাঁরা নাকি একা মরেছেন, একাকিত্বে ছিলেন।অনেকে আহা উহু করছেন। এসব ভাবনার বিপরীতে আমার ভাবনাটা বলতে চাই।
১। যে মরে গেলো, সে মরেই গেলো। সে একা মরলো নাকি হাজার লোকের সামনে মরলো সেটা তার কাছে কোনো বিষয় না। সবার সামনে মরলে কী হতো? হাজারো সঙ্গ নিয়ে মরলে কি হতো? কিছুই হতো না। ওই একাই যাওয়া লাগতো। একা যে যেতে হবে সবাইকে- এটাই অমোঘ বাস্তবতা।
২। যারা হাজার সঙ্গ নিয়ে আছি তারা যে ‘একা‘ নই তার নিশ্চায়তা কি? লক্ষ সঙ্গর মধ্যে থেকেও যারা একা তাদের নিয়ে কী বলবো? পানি খেলে পিপাসা দূর হয়, কিন্তু পানি পেলে যদি পিপাসা পায়, সেই পিপাসা দূর করা যায় না। সঙ্গ নিয়ে থাকলে যদি একা লাগে, সেই একাকিত্ব দূর করবো কি দিয়ে?
৩। অনেকে হয়তো বলবেন ‘সন্তান দেশে থাকলে ভালো হতো‘, ‘সংসার আগে থেকে গুছিয়ে মনোযোগ দিয়ে করলে ভালো হতো‘, ‘ক্যারিয়ারিস্ট না হলে ভালো হতো‘ ‘আত্মীয় পরিজনদের সাথে সবসময় মিলে চললে ভালো হতো‘, ‘বন্ধু-বান্ধবে আরো ঘেরা হলে ভালো হতো‘। সেগুলো করলে ভালো, এবং এগুলো আমরা অনেকেই করি। কিন্তু এসব করলেও কোনো গ্যারান্টি নেই যে মানুষ ‘একা‘ হবে না। একা হওয়া, একা মরা, একা যাওয়া- মানুষের ভবিতব্য। মানুষ মূলত একা- এ এক গভীর দার্শনিকতা।
৪। বরং একা হোক বা ‘দু‘কা হোক আর হাজারের মধ্যমণি হোক, একা একা বাঁচতে শেখা ও মরতে শেখা জরুরি। ‘একা‘ অবস্থাকে আলিঙ্গনের মাঝেই অপার আনন্দ নিহিত। যে সঙ্গ নিয়ে পরিপূর্ণ আবার একা একাও পরিপূর্ণ সে সঙ্গ নিয়ে থাকা বা না থাকা নিয়ে বিচলিত হয় না।
৫। মানে আমরা সবার সাথে মিশবো, সবার সাথে থাকবো, কিন্তু নিজের একটা নিজস্ব জগত রাখবো- যেখানে কেউ ঢুকতে পারবে না। যখন কেউ থাকবে না, তখন সেই নিজস্ব জগত দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ রাখবো।
৬। নিজেকে যখন একায় পাবো, আপন বাহুয় ধরতে পারবো, ‘নিজেকে জানো‘ বুঝতে পারবো, তখনই জীবনের আসল মাজেজা ঘটে। সবার সামনে মরতে পারে অনেকেই, নিজের সামনে মরতে পারে কয়জনে?
৭। সৃষ্টির মাঝে একা হয়ে, থাকবো মোরা নির্ভয়ে, সবার হৃদয়ে থেকেও মোরা থাকবো আপন হৃদয়কোণে, অসীমের মাঝে সীমা হয়ে, নিজেকে পাবো যথাভাবে- এমনটা হতে পারলেই সার্থকতা। সবার সাথে থেকে মরতে পারা যেমন অনেকের স্বপ্ন, একা একা মরতে পারাও হতে পারে অনেকের আরাধ্য।
৮। আমরা কেউ জানিনা কোন কারণে, কোথায় একা হয়ে যাই অকারণে, কোন পথের কোন বাঁকে রেখে আসি হৃদয়াংশ যতন করে। তাই কে ‘একা‘ মরলো আর কে ‘সবারে নিয়ে মরলো‘- সে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।
৯। কেউ কেউ বলবেন ‘‘তাই বলে শেষ মুহুর্তে হাত ধরার লোক থাকবে না, অশ্রু ফেলার লোক থাকবে না?‘‘। বাস্তবে হাত ধরলেই যে সে হাত মনের নাগাল পেয়েছে তা আমরা জানি না। সুতরাং হাতের ছোঁয়া বা চোখের জল দিয়ে বিষয়টার শক্ত উপসংহার টানা যাবে না। তাছাড়া যে চোখের জল ফেলবার দূরে থেকেও ফেলবে, যার হৃদয় জ্বলবার দূরে থেকেও জ্বলবে। পরিবার আত্মীয় পরিবেষ্টিত থাকা লোকও একা মরতে পারে রাস্তায় কিংবা আইসিউতে। মৃত্যু কোথায় হবে আমরা জানিনা।
১০। একা এসেছো একাই যাবে এটাই শেষ কথা।জীবন একটা রঙ্গমঞ্চের নাটক মাত্র। এ নাটকের পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের চরিত্রে অভিনয় করে মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কেউ কারো নয়। মানুষ নিজকে যতই সক্ষম করতে পারবে তাতেই তার মঙ্গল। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন ‘‘যখন তুমি সমস্ত সাহায্য প্রত্যাখ্যান করবে,তখন তুমি মুক্ত।‘‘
১১। ‘‘আমি একা, বড় একা, আমার আপন কেউ নেই‘‘ বা ‘‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা‘‘ বা ‘‘পথহারা পথটাকেই ভালোবেসেছি, গোলকধাঁধার চত্ত্বরে…….‘‘- গানগুলো কার না প্রিয়? মানুষ ভেতরে ভেতরে একা অনুভব করে বলেই এসব গান খুব পছন্দ করে এবং গুণ গুণ করে গেয়ে উঠে।
.
মোদ্দা কথা, পুনরুক্তি করছি ‘সবার সামনে মরতে পারে অনেকেই, নিজের সামনে মরতে পারে কয়জনে?‘ ‘সবার সাথে থেকে মরতে পারা যেমন অনেকের স্বপ্ন, একা একা মরতে পারাও হতে পারে অনেকের আরাধ্য।‘ পেশাগত কারণে মানুষ দূরে যাবে, একা থাকবে -এটাই স্বাভাবিক। নবী করিম(স:)ও ব্যবসায়িক কারণে অনেক দূরে গিয়েছেন, ধ্যান করতে গুহায় বসেছেন। সুফি, সাধক, ব্যবসায়ী, গবেষক কে একা থাকেননি? কে কোথায় কীভাবে কখন মারা যাবো জানিনা। তাই সঙ্গ সহ বা সঙ্গ ছাড়া যে কোনো অবস্থায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে শেখা জরুরি। এবং তা হওয়া উচিত আনন্দের সাথে। চলুন প্রস্তুত থাকি।
……..
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )