মিলাদ ও উলুধ্বনি
দেখা যায়, কোন কোন মাহফিলে ছন্দে ছন্দে জিকির, কোথাও কোথাও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, কোথাও আবার মহিলারা নেচে নেচে জিকির করছে। এসব আবার ফেসবুকে গণহারে শেয়ার হচ্ছে। কমেন্টে ও পোস্টে সবাই গণহারে ফতোয়া দিচ্ছে। আহা যেন সবাই আল্লামা কিংবা মুফতি। দুভাগে বিভক্ত সব আলোর দাবিদার অন্ধ ভক্ত।
কেউ কোরআন হাদীস পুঙ্খানুপুঙ্খ হুবহু মানতে চান, কেউ আবার ইজমা কিয়াস বা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতি ও বর্তমান কালের সাথে মিল করে চলতে চান। ইসলামের মূল বিষয়ের ব্যত্যয় না করে। দু‘দলই অন্যদলকে বাতিল মনে করে। ইসলামতো একটা! দুটোও না চারটাও না! ইসলাম এক হলেও ধার্মিক দাবিদার হাজার হাজার। হাজার জন হাজার মত। অবশ্য সবাই দাবি করে আল্লাহ পাকের পথে আছে, রাসুল (স:) এর পথে আছে।
ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে দেখা যায় যে সুফিজম ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সুফিজমের একদিকে আছে ধ্যান, ও প্রেম, অন্যদিকে আছে গান, কবিতা, শায়েরের ব্যবহার ও মরমী উপলব্ধি। এসব সুফিজমের ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে। যারা নাচ গানের জিকির পছন্দ করেনা তারা গান ও কবিতাকে নিষিদ্ধ মনে করে। মজার বিষয় হলো তারা আবার খুব পছন্দ করে মাওলানা রুমিকে, আল্লামা ইকবালকে। তাঁদের লেখা প্রায়ই আওড়ান মাহফিলে মাহফিলে। মাওলানা রুমি ও আল্লামা ইকবাল সুফিজমে ছিলেন, তাঁদের লেখা/কবিতা/শায়েরে প্রচুর মানুষ আসক্ত হয়েছে। যেমন এদের দ্বারা পাকিস্তান, তুরস্ক, ভারতসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশের মানুষ প্রভাবিত হয়েছে।
স্থানীয় সংস্কৃতি ইসলামের সাথে মিশে গিয়েছে। তাই আমরা দেখি জিকির মিলাদের ভিন্ন ভিন্ন ধরণ। লায়ন অব ডেজার্ট মুভিতে দেখা যায় উমর মুখতার ছিল লিবিয়ার মুসলমানদের লিডার। যিনি মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় ইতালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যান দীর্ঘদিন। শেষে তার ফাঁসি হয়। ফাঁসি কার্যকরের সময় মুসলিমরা লা ইলাহা ইল্লা্ল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স:) বলে। সাথে মহিলারা উলুধ্বনি দেয়। এ উলুধ্বনি মিলাদের সময়ও ওরা দিয়েছে। নিশ্চয়ই ওলুধ্বনিটি স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ। ইরাকে নাকি এখনো মিলাদের সময় উলুধ্বনি দেওয়া হয়। (বাংলাদেশে যদি মিলাদ-জিকিরে কেউ উলুধ্বনি দেয়, তবে খবর আছে!)।
তুরস্কে সুফিজম ও গান খুব জনপ্রিয় ছিল। কামাল আতাতুর্ক এসে তা নিষিদ্ধ করেন। এখনো সেখানে আল্লামা ইকবাল বা রুমির গান কবিতার সাথে ছন্দ মিলিয়ে মিউজিকের তালে তালে জিকির করে। আসলে ধর্ম যেখানে গিয়েছে, সেখানকার সবকিছু পরিবর্তন করেছে আবার সে স্থান ও কালের সংস্কৃতির সাথে মিলে মিশেই একাকার হয়েই গিয়েছে। তাই আফ্রিকার মুসলিমদের আচরণ আর অস্ট্রেলিয়ান কালো আদিবাসী মুসলিমদের আচরন এক নয়। মিলেনা ভারত ও ইউরোপের মুসলমানদের আচরণও।
কিন্তু বাংলাদেশে যেসব গ্রুপ আছে সেসব গ্রুপের অনুসারীদের অনেকেরই ইসলামের ইতিহাসের ১৪০০ বছরের প্রতিবছরের ইতিহাসের জ্ঞান নেই, নেই স্থান কালের বিবেচনাও।, সেই সাথে ইসলাম প্রচারের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা বিষয়েও জ্ঞান নেই। (অনেকের কথা বলছি, সবাই না) (আমি কি জানি? না, জানিনা)
‘ইশক আওয়াল, ইশক আখের, ইশক কুল,/ইশক শাক, ইশক নাখল, ইশক গুল।’ ‘প্রেম আদি, প্রেম অন্ত, প্রেমই হয় মূল,/প্রেম ডাল, প্রেম বৃক্ষ, প্রেমই হয় ফুল।’ অর্থাৎ স্রষ্টার সৃষ্টির সর্বত্রই প্রেম। সৃষ্টির আদিতে প্রেম, সৃষ্টির অস্তিত্বেও প্রেম। – রুমি।
বাই দ্যা ওয়ে, আমি কে সঠিক বা কে বেঠিক সেটা বলছিনা। সেটা আল্লাহপাক জানেন। সামিউম বাছির লাতিফুল খাবীর তিনি। আমি শুধু ঘটনার বর্ণনা করলাম। কে জানে কে কখন কোথায় কীভাবে সঠিক! কেউ চাকু দিয়ে ফল কাটে , কেউ মানুষ কাটে। তাতে চাকুর দোষ না। দোষ হলো যে কাটে তার। কেউ ধর্ম বেচে খায়, কেউ ধর্মে মজে যায়। তাতে ধর্মের দোষ না।
সবকিছুর মূলে যেমন ধর্ম, তেমনি ধর্মের মূলেও সবকিছু।
সৃষ্টিকর্তা সকলকে সঠিকপথে রাখুক। আমীন। ( বাস্তবতা হলো সকলে সঠিকপথে থাকবেনা। থাকলে ধর্মের কাজ কী! জান্নাত ও জাহান্নাম ভাগ কেন? কিছু লোক বিপথে যাবে বলেই জাহান্নামের সৃষ্টি। তাই ধর্ম থাকবে। ধর্ম থাকবে সকলকে সঠিকপথে আনার জন্য; ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও থাকবে যুগে যুগে কালে কালে।
-সফিকুল ইসলাম, ৩০ অক্টোবর রাত্রিবেলা।