খোলাবদন বনাম ঢাকাবদন নিয়ে কুতর্ক এবং বিবেকের দায়।
১।
আমি যখন খুব ছোট, তখন মা নানু দাদী ও চাচীদেরকে কেবল শাড়ি পরতে দেখতাম। আমরা যখন বেড়ে উঠি তখন কিশোরী খালা বা বোন বা ক্লাসমেটদের দেখতাম সালোয়ার কামিজ পরতে। কিন্তু মা নানী দাদীদেরকে সালোয়ার কামিজ পরতে দেখিনি। ঢাকাতে এসে দেখলাম মা নানী বয়সীদের অনেকেই সালোয়ার কামিজ পরে। সেটা প্রথমে আমার চোখে খটকা লাগলেও পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ইদানিং দেখা যায় গ্রামে শাড়ি পরে এমন মানুষ কম। বেশিরভাগ সালোয়ার কামিজ পরে। এ পরিবর্তনও আমার চোখে লাগে।
আবার, নানা ও বাবাকে লুঙ্গী-পাঞ্জাবি পড়তে দেখেছি। কৃষকদের লুঙ্গি কাছা দেওয়া বা ন্যাঙটিতে দেখেছি, স্কুল শিক্ষকদের পাঞ্জাবি -পাজামাতে দেখেছি। আবার কেউ কেউ প্যান্ট শার্ট পরে ফুলবাবু হয়েও থাকতেন। ঢাকায় গিয়ে ভিন্ন চিত্র দেখি। বেশিরভাগই প্যান্ট শার্ট পরে। গত বিশ বছরে মেয়েদের সালোয়ার কামিজে আর পুরুষদের প্যান্ট স্টাইলে অনেক বিবর্তন দেখেছি। মানুষ তার শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা, অর্থ, কৌশল ও রুচি পোষাকে দেখাতে চায়। সে পুরুষ হোক বা নারী হোক।
জাপান ও অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে রাস্তাঘাটে ও সীবিচে প্রথম প্রথম আড়ষ্ট লাগতো। অভ্যস্ত হতে সময় লেগেছে। যে পোশাক দেখলে মনের মধ্যে আরেরেরে করে উঠতো, সেগুলোই দীর্ঘদিন থাকার কারণে চোখে নরমাল ঠেকেছে। খুবই স্বাভাবিক লেগেছে। অথচ প্রথম প্রথম নিতে কষ্ট হতো। কালচারাল শক নিতে বা মানসিক প্রস্তুতিতে সময় লেগেছে। আসলে আমরা যে কালচারে খাই, চলি বা পরি, অন্য কালচারে গেলে তা গ্রহণে সাময়িক অসুবিধা হয়। তবে দীর্ঘ অভ্যাসে তা স্বাভাবিক মনে হয়। আমাদের গ্রহণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ে। ছকের বাইরে আমরা সহজে চিন্তা করি না। চিন্তা করলে ও মিশলে পরিবর্তন হয়ই।
২। পোশাকের প্রয়োজন ও বিবর্তন:
সৃষ্টির শুরুতে মানুষ কী ধরণের পোশাক পরতো বা আদৌ পরতো কি না তা জানা যায় না। ধর্মীয় মতে আদম হাওয়া প্রথম মানুষ হিসেবে কী পরতেন সেটাও নিশ্চিত না। হয়তো আবরণ ছিল কোনোভাবে যা আমাদের চিন্তার বাইরে। তবে সাধারণভাবে বলা যায় মানুষ শুরুতে খাওয়া নিয়েই লড়াই করতো। পরিধান নিয়ে ভাবার সময় পায় নি। বস্ত্র মানুষের দ্বিতীয় মৌলিক প্রয়োজন। শীত, ঠান্ডা, রোদ, তাপ থেকে বাঁচতে মানুষ শুরুতে হয়তো কিছু পরতো। যেমন গাছের পাতা বা ছাল বা পশুর চামড়া ব্যবহার করতো। পরে সভ্যতার ধাপে ধাপে পোশাকের পরিবর্তন ঘটে। বয়নশিল্প আসে অনেক পরে। আর শিল্পবিপ্লবের পরে তো পোশাকের ধরণ ও বৈচিত্র্যের কোনো ইয়ত্ত্বা নেই।
পৃথিবী নানান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। ভৌগলিক, প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষা- দীক্ষা, চিন্তা-চেতনা, সহনশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতার নানান স্তর পেরিয়ে মানুষ আজকের দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। গরম-শীতে পোশাক ভিন্ন হয়। আবার গরমেও ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার জামা ও ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার জামা এক নয়। শীতেও ৫ ডিগ্রির তাপমাত্রার জামা আর মাইনাস ১০ তাপমাত্রার জামা এক নয়। আফ্রিকার পোশাক-প্রয়োজনীয়তা আর ইউরোপের পোশাক-প্রয়োজনীয়তা এক হবে না। এমনকি একই দেশে দুই জায়গায় ভিন্ন হতে পারে। যেমন জাপানের ওকিনাওয়ার পোষাকি প্রয়োজন ও হোক্কাইডোর পোষাকি প্রয়োজন এক হবে না। মক্কার পোশাকের সাথে ভারতের পোশাকের বেমিল হবেই।
ধর্ম আমাদের পোষাকে পরিবর্তন দিয়েছে। প্রতিটি ধর্মের কিছু আলাদা পোষাকি ম্যানার আছে। সংস্কৃতিভেদেও পোশাক ভিন্ন হয়। এমনকি বান্দরবানের ১৪টি উপজাতির পোশাক একরকম নয়। যদিও একই জেলায় বাস করে। আবার রয়েছে রাজনৈতিক পোশাক। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরও নানানরকম পোশাক হয়। বাংলাদেশের ইসলাম পন্থী দলগুলোর মধ্যেও পোশাক, পাঞ্জাবী ও টুপির মধ্যে নানানরকম ভেদাভেদ দেখা যায়। সুতরাং কে কোন কাপড় কতটুকু কখন পড়বে তা বলা মুশকিল। কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন হতেই পারে। এক দেশের লোক বলবে তার দেশের পোশাক সেরা, এক ধর্মীয় লোক বলবে তার ধর্মের পোশাক সেরা, এক সংস্কৃতির লোক বলবে তার সংস্কৃতির পোশাক সেরা। এরকম দাবি করা কি অন্যায়? না অন্যায় নয়। তিনি দাবি করুক। প্রচারও করুক। তবে জোর করা যাবে না। চাপিয়ে দেওয়াও যাবে না। যার মনে ধরবে যেটা, সে গ্রহণ করবে সেটা।
ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে রেশম শিল্পের আগমন। কালক্রমে শাড়ি ও ধুতিই ছিল এ এলাকার মানুষের প্রধান পোশাক। ধুতি লুঙ্গি প্রচলন ছিল কিছুকাল আগেও। হিন্দু মুসলিম উভয়েই ধুতি লুঙ্গি পরতো। কাজী নজরুলও ধুতি পরতেন। মোঘল আমল থেকেই পাগড়ি বা কুর্তা পরার অভ্যাস দেখা যায়। রীবন্দ্রনাথ যে লম্বা কুর্তা বা পাঞ্জাবি পরতেন তার সাথে বর্তমানে পুরুষদের লং পাঞ্জাবি বা মেয়েদের লং কামিজ বা বোরখার মিল পাওয়া যায়। মুসলমানদের আগমনের ফলে বাংলায় পোষাকে একটা মুসলিম আবহ আসে। মুসলমানরা আসার আগে এ অঞ্চলে সেলাই করা কাপড় পরতো না। সেলাই করা কাপড় মুসলমানরাই প্রচলন করে। আবার ব্রিটিশরা আসার পরে ব্রিটিশদের পোষাকি আমেজ এ অঞ্চলে প্রভাব ফেলে।
সভ্যতা-অসভ্যতা, জলবায়ু-আবহাওয়া, নারী-পুরুষ, ফ্যাশন ও স্টাইল, ট্রাডিশন ও আধুনিকতা জাত-পাত ও শ্রেণী, ধর্মবিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ ধারণা ইত্যাদির ভিত্তিতে পোশাক ভিন্ন হয় ও পরিবর্তিত হয়। সুতরাং পোশাকের রাজনীতি ছিল, আছে, থাকবে। রাজনীতিতে পোশাক ছিল, পোষাকেও রাজনীতি আছে। ধর্মে পোশাক ছিল, পোষাকেও ধর্ম আছে!
৩। পোশাক বিতর্ক:
সংগতকারণেই পোশাক নিয়ে আইন আদালত, আতেল বুদ্ধিজীবি, প্রশাসন পুলিশ ও আমজনতা নানান মন্তব্য করছে। একেক জন একেকদিক ফোকাস করছে। তাই বিতর্ক বাড়ছে। কেউ সম্যক উপলব্ধিতে আনছে না। প্রকৃতি, সৃষ্টি রহস্য, রাজনীতি, ধর্ম, কালচার, বৈচিত্র্যতা, ফ্যাশন-স্টাইল-আধুনিকতা, ট্রাডিশন বা মূলে ফিরে যাওয়া, সার্বজনীনতা ইত্যাদি বিষয় ভাবলে মানুষ এত অস্থির হতো না, বা উল্টা পাল্টা কমেন্ট করতো না।
পোশাক ছোট হলেই বিপরীত লিংগ সিডিউস্ড হবে, পোশাক বড় হলে হবে না- এমন উপসংহার টানা যায় না। পোশাক পরে হোক, আর পোশাক ছাড়া হোক আর পোশাক অর্ধেক হোক, যেভাবেই নারী রাস্তায় বের হোক বা মোড়ে দাঁড়াক, পুরুষগুলোর চোখ ওদিকে যাবেই। নানানভাবে সন্তর্পনে দেখবেই। ভারতীয় উপমহাদেশের পুরুষরা চোখ থামিয়ে রাখতে পারে না। তাকাবেই, এবং সেই তাকানো মাত্রাজ্ঞানহীনতা ছাড়ায়, দৃষ্টিকটু লাগে। কোনো কোনো সময় তা ছোট মন্তব্য বা বেফাঁস উচ্চারণ পর্যন্ত হয়। পশ্চিমের দেশগুলোতে কি পুরুষরা তাকায় না? হয়তো তাকায় তবে সেই তাকানো লম্বা হয় না, দৃষ্টিকটু হয় না, শালীনতা হারায় না। আবার উল্টাভাবে, পুরুষরা যখন অর্ধনগ্নভাবে থাকে তখন কি নারীরা দেখে না, একটু অস্বস্তি ফিল করে না? করে। তবে শালীনতা হারায় না। মাত্রজ্ঞান হারায় না।
লোহা ও চুম্বক পাশাপাশি রাখলে আবেশিত হবেই। কে লোহা বা কে চুম্বক, নারী না পুরুষ এ নিয়ে তর্ক বাদ দিই। পুরুষ যদি নিজেকে চুম্বক ভাবে কিংবা লোহা ভাবে তাতে সমস্যা কমে না। আকর্ষণ ও আবেশন ঘটবেই। লোহা ও চুম্বক হলো বস্তু। মানুষতো আর বস্তু না। মানুষের মন, বিবেক, হৃদয়, বুদ্ধি, মাত্রাজ্ঞান, শিক্ষা, রুচি, স্থান-কাল-পাত্রবোধ, ধর্ম বা প্রজ্ঞা আছে। সুতরাং মানুষ আকর্ষণ ও আবেশন বোধ করলেও কখন কোথায় কীভাবে থামতে হবে তা জানতে হবে। হোক সে নারী কিংবা পুরুষ। বস্তু বা পশু থেকে আলাদা হতে হবে। না হলে সে আর মানুষই থাকে না।
মানুষের নানান বিষয়ে ইচ্ছা তৈরি হয়, কষ্ট বা অনুভূতি জাগে। মানুষ তা নিয়ন্ত্রণও করে। অন্যের হাতে বেশি টাকা দেখলে, অন্যের বেশি সম্পদ দেখলে, অন্যের বড় পদ দেখলে, অন্যের সুন্দর জামা দেখলেও আমরা একটু আক্ষেপ করি। সেটা কি সিডিউস হবে? না। আমরা দেখি আবার নিজেকে বুঝিয়েও নিই। যে সব পেতে হয় না, আর সব পেলে নষ্ট জীবন।
৪। কার ইচ্ছায় পোশাক পরিধান?
কে কী পরবে তা নিজেই ঠিক করবে? নাকি অন্যরা? পুরুষ কী পরবে তা নারী ঠিক করবে? নাকি করবে না। আর নারী কী পরবে তা পুরুষ ঠিক করবে? নাকি করবে না। সাধারণত আমরা লজ্জা নিবারণের জন্য বা আবহাওয়া বুঝে মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে পোশাক পরি। কিন্তু পোশাকের ধরণ স্টাইল ফ্যাশন ইত্যাদি ঠিক করি অন্যদের কথা ভেবে। আমি যে বিশ্বে বাস করি, যে সমাজে থাকি, যে বান্ধব-কলিগ-প্রতিবেশী-স্বজনদের সাথে দেখা হবে তাদের কথা ভেবে আমরা পোশাক ঠিক করি। তার মানে আমরা যখন বলি যে ‘‘আমি আমার ইচ্ছামতো যা খুশি পরবো‘‘ তখনও আসলে আমরা নিজের ইচ্ছামতো পরি না। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, মগজ মনন স্টাইল ও ফ্যাশন ঠিক করে। সেই মনন আবার প্রভাবিত হয় বিশ্ব কালচার লোকাল কালচার, ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক পরিবর্তন ইত্যাদি দিয়ে। সুতরাং স্বাধীন হতে গিয়েও আমরা স্বাধীন হতে পারি না। কেউ অধীন হয় পশ্চিমার, কেউ অধীন হয় ধর্মের, কেউ অধীন হয় পূর্বের, কেউ অধীন হয় অধর্মের, কেউ অধীন হয় কালচারের আর কেউ হয় বৈশ্বিক বা লোকাল। সুতরাং আমরা যখন নিজের ইচ্ছামতো জামা পরি তখনও পরিবেশ প্রতিবেশ সমাজ প্রভাবিত করে। স্বাধীন হয়েও আমরা স্বাধীন হতে পারি না।
৫। পোশাক-নুইসেন্স!
পোশাক ছোট পরলে পাবলিক নুইসেন্স হয় নাকি পোশাক বড় পরলে? নুইসেন্স হওয়াটা আপেক্ষিক। কে উপদ্রপ অনুভব করে, কোথায় করে, কেন করে ইত্যাদি প্র্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। একজন একদেশে গিয়ে ছোট পোশাকের মানুষদের দেখলে উপদ্রপ অনুভব করবে, অন্যজন অন্য দেশে, স্থানে, প্রতিষ্ঠানে, অনুষ্ঠানে, ঘরে গিয়ে বড় পোশাক দেখে উপদ্রপ অনুভব করবে। তাই বলা যায় নুইসেন্স হয় এটা সত্য। তবে কেন হয়, কে হয়, কোথায় হয়, কী কারণে হয় সেটা ভিন্নতর। আমার কাছে যা শাদা আরেকজনের কাছে তা শাদা নাও হতে পারে। আবার পোশাক ছোটর মধ্যেও নানান শালীন পোশাক আছে। আবার বোরখা নেকাব বা লং কুর্তা পরার মধ্যেও নানান অশালীন পোশাক আছে। শালীনতা নির্ভর করছে যিনি পরছেন তিনি কীভাবে পরছেন, কী উদ্দেশ্যে পরছেন তার উপর। আবার যিনি দেখছেন তিনি কীভাবে দেখছেন কী মনন নিয়ে দেখছেন তার উপর।
নারীরা ছোট পোশাক পরলে যদি পুরুষরা সিডিউস্ড হয়, তাহলে পুরুষরা যে লুঙ্গি কাছা দেয়, হাফ প্যান্ট পরে, শরীর খালি রেখে হাঁটে, রাস্তায় দাাঁড়িয়ে হিসু করে তার বেলায়? নারীর খোলাবদন যদি পুরুষের অস্বস্তির কারণ হয় পুরুষের খোলাবদনে নারীরা অস্বস্তি অনুভব করেন না? বিপরীত লিংগের পোশাক ছোট বড় বিষয় না। যে কোনো পোষাকেই যে কেউ সিডিউসড হতে পারে। যদি মন ও মগজ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে সিডিউস্ড হবে। বিপরীত লিংগের কাউকে দেখলে হালকা ক্ষণিকের আকর্ষণ তৈরি হতেও পারে নাও পারে। আকর্ষণ আর সিডিউস তো এক বিষয় না। সুতরাং যার পোশাক তার চাইতেও যিনি দেখে সিডিউসড হন তার রুচি, মনন, শিক্ষা, প্রজ্ঞা, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তথা মানুষ হিসেবে কতটা ব্যালেন্সড সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
৬। বোরখা ও নেকাব
বাংলাদেশে মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশের ৫০ বছর পেরিয়ে পোশাকের বহুবিদ বিবর্তন ঘটেছে। এখন নারীদের পোশাক দেখলে প্রায় সবখানে বোরখা পড়া বা নেকাব পরা নারী বেশি দেখা যাবে। আমি যখন স্কুল কলেজে পরতাম তখন পুরো ক্লাসে একদুইজন পরতো বোরখা। আর এখন প্রায় সবাই পড়ে। কেন দেশে ধর্ম বেড়েছে? নাকি মানুষ ধর্ম মেনে বোরখা পরে? হতে পারে অনেকেই হয়তো ধর্ম মেনে পরে। তবে অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে যে পাবলিক প্লেসে প্রেম করতে ও পরিচিতি লুকাতে বোরখার ব্যবহার বেড়েছে। আর আরেকটা কারণ হলো সামাজিক মন্তব্য। কেউ বোরখা বা নেকাব না পড়লে সমাজ বা প্রতিবেশী বা কলিগ বা সহপাঠিরা কমেন্ট করে। সেইসব কমেন্ট অনেক কিশোরী সহজে নিতে পারে না। তাই স্রোতে গা ভাসায়। অনেকে বলে যে বোরখা নেকাপ বেশি পড়লে বা ঢেকে রাখলে রেইপ বা টিজিং কম হবে। গত ত্রিশ বছরে বাংলাদেশে বোরখা বা নেকাব পড়া বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় রেইপ, টিজিং, বুলিং কমে নি। সুতরাং মানুষের মানসিক পরিবর্তন না হলে, সত্যিকার শিক্ষিত না হলে, প্রকৃত ধার্মিক না হলে, প্রকৃত সংস্কৃতবান না হলে এসব অঘটন কমবে না। কেবল পোশাক কোনো বড় সমস্যা না।
আবার উল্টা যুক্তিও আছে। যে পর্দা করলে অপরাধ কম ঘটে। যেমন একটি ঘটনার কথা বলি। একবার এক নারীকে টাইট হিজাব ছাড়া বোরকা পরিয়ে ইরানের শিরাজ শহরের ব্যস্ত রাস্তায় রাখা হলো। সেই সোমবারে ১০০০ গাড়ি পাস করার কালে ২১৪ জন ড্রাইভার তাকে এসে লিফট দিতে চাইল। এরপরের সোমবারে একই মহিলাকে একই জায়গায় আবার দাঁড় করানো হলো। এবার বোরকার সাথে চাদর, ভালো ভাবে ঢাকা শরীর। দেখা গেল ১০০০ গাড়ি পাস করে যাবার কালে ৩৯ জন ড্রাইভার এসে মহিলাকে লিফট দিতে চাইল।
কিন্তু একই ঘটনা ইউরোপে ঘটালে আরেকরকম ফল হবে। সুতরাং পোশাক একটা ফ্যাক্টর, অন্য ফেক্টরও আছে। যেটা অহরহ সামনে পরে সেটার দিকে মানুষ তাকায় না। ইউরোপের সবাই যেহেতু ছোট ড্রেস পরে তাই সেখানে এটা সবার চোখে সয়ে গেছে। বরং বড় কাপড় পরলেই তাদের চোখে পড়ে। যেমন ফ্রান্সে বোরখা ব্যান করা হয়েছে। আবার বাংলাদেশে প্রায় সবাই লং ড্রেস পরে বা পুরো শরীর ঢেকে রাখে। এখানে কেউ ছোট ড্রেস পরলেই সবাই তাকিয়ে থাকে। ব্যতিক্রমটা মানুষের চোখে পরে- এটাই স্বাভাবিক। একটি দেশের রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, রুচি, শিক্ষার ধরণ সব ঠিক রেখে কেবল পোশাক পাল্টে ফেলা যাবে না। ইউরোপেও না, বাংলাদেশেও না। অন্যান্য সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পোশাকও পরিবর্তন হয়। বিশ্বায়নও প্রভাব ফেলে।
৭। পোশাক ও ধর্ম
প্রতিটি ধর্মেই পোশাক নিয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। দেহ ঢাকার বিষয়টা নানানভাবে বলা হয়েছে। আবার অন্যের দিকে তাকানোর বিষয়েও সংযত হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তাছাড়া আমাদের শিক্ষা, মূল্যবোধ, সচেতনতা, আত্মউপলব্ধি ও সংযম আমাদেরকে পোশাক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। যে ধর্ম মানবে সে ধর্মমতে পোশাক পরবে, যে ধর্ম মানবে না সে তার নিজস্ব শিক্ষা ও রুচি অনুযায়ী পরবে। যে দেশ, সমাজ বা সংস্কৃতি মানবে সে সেই অনুযায়ী পোশাক পরিধান করবে। এ নিয়ে কোনো পক্ষই অন্য পক্ষকে কঠোর সমালোচনা করার সুযোগ নেই। আবার জোর করারও সুযোগ নেই।
অনেকে দাবি করে, ছোট পোশাক পরলেই অধার্মিক বা নাস্তিক বা কম ধার্মিক। আবার অনেকে মনে করে ধর্মীয় পোশাক পরলেই কেউ উগ্রবাদী। বিষয়টা এত সহজীকরণ করা ঠিক না। টুপি পাঞ্জাবি পরলে, দাড়ি রাখলে কেউ উগ্র হয় না, বোরখা পরলেই কেউ উগ্র হয় না বা ধার্মিক হয় না। আবার ছোট পোশাক পরলেই কেউ নাস্তিক বা কম ধার্মিক না। প্রয়োজন, ত্বক সেনসিটিভিটি, নিজস্ব রুচি ও শিক্ষা, বিশ্বাসের ধরণ, পারিবারিক ও সামাজিক আবহ, প্রতিবেশী ও স্বজনদের প্রভাব নানান কারণে মানুষ পোশাক বাছাই করে। আবার হতে পারে প্রত্যেকের নিজস্ব দর্শন রয়েছে। তবে যারা পোশাক দেখে মানুষকে নাস্তিক বা ধর্মীয় উগ্রতার লেবাস দিয়ে দেন-তাদের রাজনৈতিক ধান্ধা আছে। এটা সমীচীন নয়।
৮। পোশাক ও বিদেশী সংস্কৃতি!
অনেকে বলেন বিদেশী সংস্কৃতি অনুসরণ করবো না। এটা ভালো দিক। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে যে পোশাক আমাদের ছিল তা আর আমরা পরি না। মুসলিম শাসন, মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমল আমাদেরকে নানান প্রভাবক দিয়ে প্রভাবিত করেছে। সুতরাং আমরা যা পরি এখন তা বিদেশী সংস্কৃতি দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। ধর্মীয়গুলোও এসছে বিদেশ থেকে, অধর্মীয়গুলোও এসছে বিদেশ থেকে। যে বিশ্বে বা পৃথিবীতে বাস করি তার ছোঁয়া আমাদের গায়ে লাগবেই। তা ধর্ম হোক, আবহাওয়া হোক, কালচার হোক আর আধুনিকতা হোক। বৈশ্বিক প্রভাব থেকে আমরা বের হতে পারবো না। আমরা সবাই এখন মাস্ক পরি, এটা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সকলেই গ্রহণ করেছে। তাই ছোট পোশাক বিদেশ সংস্কৃতি থেকে আমদানী নাকি বড় পোশাক বিদেশী সংস্কৃতি- এসব কুতর্ক এড়িয়ে যাওয়া ভালো।
ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি যে পাবলিক প্লেসে বা ফরমাল অনুষ্ঠানে সবাই নানান ধরণের জামা পড়লেও একটা মিনিমাম সভ্যতা মেনে জামা কাপড় পরিধান করেই যায়। তবে দুচারজন যে উল্টাপাল্টা জামা পরে যায় না তা নয়। তবে এ নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করে না। দৃষ্টিকটুভাবে তাকিয়ে থাকে না। তবে যেটা হয় সেটা হলো, পোশাক দেখে আপনি বুঝতে পারবেন, কার রুচি ও ব্যাকগ্রাউন্ড কীরকম। ওইটুকুই যথেষ্ট। কাউকে জোর করে কোনো পোশাক পরার দাবি করা যাবে না। আবার কোনো পোশাক না পরার কথাও বলা যাবে না। ছোট পোশাক যেমন একজন মানুষ পরতে পারে, তেমনি বড় পোশাকও পরতে পারে। যে কোনো মানুষ তার ধর্মীয় পোশাক, নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক, পারিবারিক পোশাক, রাজকীয় পোশাক, ভিন্ন সংস্কৃতির পোশাক পরতে পারে। তা ছোট সাইজের হোক আর বড় সাইজের হোক সেটা সমস্যা না।
৯। এখন করণীয় কী?
প্রথমত: মানুষ তার নিজস্ব বিদ্যাবুদ্ধি, কমনসেন্স, মাত্রাজ্ঞান, ধর্মীয় বিশ্বাস, কালচারাল মূল্যবোধের ভিত্তি করে যা খুশি পরুক। এ নিয়ে কোনো উগ্র সমালোচনা করা যাবে না। আক্রমনতো নয়ই।
দ্বিতীয়ত: যেহেতু আমদের স্থানকালপাত্র ভেদে পোশাকের ভিন্নতা হয়, সেহেতু সব জায়গায় সব পোশাক পরে যাবো না। যে পোশাক পরে ঘুমাতে যাই সে পোষাকে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাই না। যে পোশাক পরে অফিস আদালতে যাই , সে পোশাক পরে বন্ধুর বাড়িতে যাই না। ফ্যাশন স্টাইল জ্ঞান যেমন থাকবে, এস্থেটিক সেন্স যেমন থাকবে, তেমনি কার সামনে কোথায় কখন যাচ্ছি সে জ্ঞানও থাকা লাগবে। যাতে করে গণমানুষ বিরক্তবোধ না করে।
তৃতীয়ত: বিপরীত লিংগের যে যা-ই পরুক না কেন তা নিয়ে অযথা মনোযোগ দিব না। যদি কোনো পোশাক সিডিউস, আকর্ষণ, আবেশন তৈরির মতোও হয়, সেটাও ক্ষণিকের মধ্যেই নিজের মাথা থেকে সরিয়ে নিজের জগতে নিজের কাজে থাকবো। যার পোশাক সেটা তার পোশাক, সেটা তার সুবিধা বা সমস্যা। তারটা নিয়ে আমাদের এত নাক গলানোর কিছু নেই।
চতুর্থত: যদি কেউ সমাজ, ধর্ম বা কালচারাল মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে কিছু পরিধান করে, তবে সেটা নিয়ে সরাসরি আক্রমন করা যাবে না, এমনকি কড়া সমালোচনা করা যাবে না, হেয় করে কিছু বলা যাবে না। তবে একাডেমিক আলাপ বা রাজনৈতিক আলাপ হিসেবে যথাযথ পরিবেশে পরিমিত ভাষায় তার সমালোচনা বা প্রস কন নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। সে-ই আলাপ যেন হয় সমাজ পরিবর্তনের, উন্নয়নের, সভ্যতার। কোনোভাবেই যেন আমাদেরকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে না যায়।
পঞ্চমত: কেউ যদি ধর্ম বা রাজনীতি বা কালচারাল মূল্যবোধ থেকে পোশাক বিষয়ে কোনো একাডেমিক আলোচনা, বা এক্টিভিজম করে বা দাবি দাওয়া করে, সেটা করার অধিকারও তার আছে। যতক্ষণ না তা দ্বারা অন্য কারও উপর আক্রমন হয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা জাতির প্রতি হেয়মূলক কিছু না হয় তবে সেরকম দাবি কেউ করতে পারে। ধার্মিকরা তার ধর্মের পোশাকের কথা বলতে পারে, একটি জাতি তার জাতীয় পোশাকের পক্ষে বলতে পারে। একটি সংস্কৃতির লোক তাদের সংস্কৃতির পোশাকের পক্ষে বলতে পারে। গণমানুষও তাদের দাবি গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। সেই অধিকার বা সুযোগ মানুষের আছে ও থাকবে।
আরামের পোশাক পরি, আরামে থাকি। শরীরের আরাম, চোখের আরাম আর মনের আরাম হয় এমন পোশাক পরবো। আর সবার সাথে এমন কথা বলবো যেন কেবল সবার মনে আরাম হয়, এমনভাবে তাকাবো যেন আরাম লাগে। আরাম আরাম আর আরাম।
ড. সফিকুুল ইসলাম, ৩০ আগস্ট ২০২২।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )