গ্রামের তিনটি চিত্র
১।
চাইনিজ এক প্রবাদ আছে যার অর্থ দাঁড়ায় “কাউকে কোন কিছু না দিয়ে সেটা কীভাবে পেতে হয় সেটা শিখিয়ে দিন; তাহলে সে নিজেই ওটা সংগ্রহ করতে পারবে”। মনে করেন কাউকে আপনি একবেলা মাছ খাওয়ালেন। বেচারা খেল, হজম করলো, হাগু করলো শেষ। কিন্তু যদি তাকে কোথায় কীভাবে মাছ ধরতে হয় শিখিয়ে দেন এবং সে ভালোভাবে চেষ্টা করে রপ্ত করে তবে সে আর না খেয়ে থাকবেনা। প্রয়োজন হলেই নিজেই মাছ ধরবে, খাবে এবং সময়ে সময়ে খাওয়াবে। কিন্তু ইদানিং খেয়াল করলাম লোকজন শিখতে চায়না, জানতে চায়না, শুধু নগদ চায়। নগদ না দিলে এমন ভাব দেখাবে যে ব্যাটা টাকা দিবার পারেনা খালি মুখে বড় বড় আলাপ। মনে করেন যুবকদেরকে বললেন কীভাবে পরিশ্রম করে ধীরে ধীরে অর্জনের পথ খুঁজতে হয়। এরা এ কান দিয়ে শুনবে আর ওকান দিয়ে বের করে দেবে এবং আপনার দিকে এমনভাবে তাকাবে যে, আপনি তার চোখে মুখে লেখা দেখবেন “একটা চাকরি দিবার পারেননা, একটা ব্যবসা ধরাইয়া দিতে পারেননা এত কথা বলেন ক্যান?” সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ যে মানুষকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে তা এদের চিন্তাতেই নেই। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। প্রাণপন চেষ্টা থাকলে সফলতা আসবেই। ওসব নীতিকথায় কান দিবার সময় এদের নেই। শুধু নগদ চায়, পরামর্শ চায়না। বাকীর লোভে নগদ পাওনা কে ছেড়েছে এ ভুবনে?
শর্টকাট বড়লোক হতে চায়। লটারিতে, পীরবাবার দোয়ায় বা অন্য কোন ধান্ধায়। ভূয়া বিকাশ একাউন্ট থেকে টাকা চেয়েছে; টাকা দিয়ে দিয়েছে্।ভূয়া ফোন কোম্পানীর পুরস্কার জিতেছেন বলে টাকা চেয়েছে, টাকা দিয়ে দিয়েছে। ধান্ধাবাজ লোক চাকুরি দিবে বলে টাকা চেয়েছে; টাকা দিয়ে দিয়েছে। বাটপার লোক বিদেশে নিয়ে যাবে বলে টাকা চেয়েছে, টাকা দিয়ে দিয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই ধরা খাওয়ার পরে হাহুতাশ করে। পরিচিত বন্ধু আত্মীয়ের মধ্যে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, ক্ষমতাবান কেউ থাকলে তার কাছে ওসব টাকা ফেরত পাইয়ে দেবার জন্য ফোন করে বা দেখা করে। এ ফোন করা বা দেখা করাটা যখন টাকাটা দেন তখন একবার করলে কিন্তু সমস্যা হয়না। কিছু লোক করে বোকামীর কারণে, কিছু সরলতার কারণে আর কিছু করে লোভে পড়ে। পরিচিত জানাশোনা একজন বোঝের মানুষকে আগে থেকে জিজ্ঞেস করলে কী সমস্যা সেটাই বুঝতে পারলামনা। গাধা পানি খায় তবে পানি ঘোলা করে পরে খায়। চোর গেলে বুদ্ধি নিতে আসে। ধরা খেয়ে তবে আসে পরামর্শের জন্য। রোগী মরিবার পরে ডাক্তারের কোন কাজ নেই এটা ওদের কে বোঝাবে?
………………………
২।
প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এমনকি শহরের মহল্লাতেও পাবেন কিছু লোক যারা কিছুই করেনা। সারাদিন বাবুর মতো ঘুরে, চা খায়, বিড়ি খায়, পান খায়। সুন্দর করে কথা বলে। কৃষি কাজ করেনা, চাকুরি নেই, ব্যবসা নেই। তবু তার জামার স্ত্রি ঠিক থাকে, চেহারা তেলও কমনা। আমার মাথায় আসেনা এদের ইনকাম কীভাবে বা কোথা থেকে আসে। দৃশ্যমান কিছু করে তাও দেখিনা। রাতে চুরি করে এমন কথাও শোনা যায়না। তবু এর দিব্যি ভালো আছে, আরামে আছে। ইদানীং এ সংখ্যাটা বাড়তেছে। সেটাই আশংকার বিষয়। কৃষক জেলে সারাদিন খেটে পেটের ভাত যোগাড় করতে পারেনা, শুকিয়ে কাঠ। আর এরা কিছুই করেনা এদের শরীরে চিকনাই, চেহারা ত্যালত্যালা, কথায় মিষ্টতা, হাসিতে পানের রস ঝরে।এরা ফ্যামিলিকেও সময় দেয়না। ছেলেপুলেও খুব একটা মানুষ হয়না। বাপ যেমন বাদাইম্যা টাইপের সন্তানও তাই। দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। এদের নিয়ে একটা সত্যিকার গবেষণা দরকার। সেই গবেষণার ফল ও সুপারিশের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে এদেরকে দৃশ্যমান বৈধ কাজে নিয়োগ করা না গেলে জাতির ভবিষ্যত অন্ধকার।
…………………….
৩।
গ্রামের মাতবরদের একটি দিক আমার খুব ভালো লাগে। তারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে। যেই আসুক সবার কাছ থেকে। ঘন্টার পর ঘন্টা দিনের পর দিন তার সাধারণ মানুষের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। এ আসলে খুব কঠিন কাজ। আপনি দুএকদিন শোনে দেখতে পারেন। আপনার বিরক্তি লাগবে। অসহনীয় হবে। সেই বিরক্তিকর অসহনীয় কাজটি মাতবররা খুব উতসাহ নিয়ে করেন। কেউ এসে ফেরত যায়না। হাজার মানুষের হাজার সমস্যা দিনের পর দিন শোনা সত্যিই কঠিন কাজ। এবং তারা বিভিন্ন সমাধানও দিয়ে থাকেন। হয়তো কোনকোন ক্ষেত্রে মাতবরদের প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ লোকসানের বিষয় জড়িত আছে। তাই তারা শোনে।সেটা আমি জানি। সেটা অন্যত্র বলবো। তবু আমি বলবো মানুষের হাজারো রকমের সমস্যা দিনের পর দিন শোনা খুব সহজ কাজনা।এ কাজটি যারা করেন তাদেঁর কৃতিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।
মাতব্বরদের সাক্ষীর অভাব হয়না। গ্রামসুদ্ধ লোক প্রস্তুত থাকে। কৌশলে সভায় যাদের ডাকা হয় তাদেঁর আগের রাত্রেই বলে দেয়া হয় কারা কী সাক্ষ্য দিবে। সর্প হয়ে ছোবল মারে উজা হয়ে ঝাড়ে যে তার নাম হলো মাতব্বর।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )