জেনেভা
।
ইতালির মিলান থেকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা যাবো বলে ট্রেনে চড়ে বসলাম। ট্রেন চলছে আর দুপাশে অবারিত সৌন্দর্য পেছনে দৌড়াচ্ছে। মাইলের পর মাইল যায়, নয়নজুড়ানো দৃশ্য সব একের পর এক দেখতে পাই। পাহাড়, সবুজ বৃক্ষরাজি, উঁচুনিচু জমিতে জুম চাষের মতো অবারিত ফসলের মাঠ দেখে আমি মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হই। মিলানের সীমানা পেরিয়ে জেনেভা সিটিতে যাওয়ার জন্য বিশাল লেকের পাশ ধরে এগুচ্ছিল ট্রেনটি। মনট্রেক্স, লোসান পেরোলাম। মনে হলো স্বর্গ পেরোচ্ছি। জেনেভা লেকের চারপাশ এত সুন্দর যে তা বর্ণনা করা কঠিন। লেকের জলরাশি, লেকের বাঁক, পাশে ঢালূ সবুজ ফসলি জমি আর পাহাড়ের সবুজের আভা, আর পর্বতগুলোর উপরে শাদা মেঘের ভেলা মিলিয়ে এ এক অন্যরক দৃশ্য। মনে হচ্ছে যেখানে যেরকম প্রকৃতি দরকার তার সব ঢেলে দেওয়া হয়েছে এখানে। দেখেই বুঝতে পারছিলাম কেন ভারতের অনেক সিনেমার স্পট সুইজারল্যান্ডে হয়।
দু’পাশ পাহাড়ে ঘেরা সামনে রেললাইন। বরফ পরে পাহাড়গুলো সাদা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন সাদা চাদরে ঢেকে রেখেছে। একপাশে সাদা পাহাড়। মাঝখানে রেললাইন, আরেক পাশে বিশাল লেক এবং লেকের চারপাশ সাদা পাহাড়ে ঘেরা। সাদা পাহাড়ের চূড়ায় সোনালী রোদের আলো পরে তা ঝিকমিক করছিল। সত্যিই এক অপূর্ব দৃশ্য। মনট্রেক্স ও লুজান এর আশপাশ কী সুন্দর তা রবি ঠাকুরের পক্ষেই কেবল বলা সম্ভব। হ্রদ আর পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহর লুসার্ন। মাউন্ট তিত্লিসের সৌন্দর্যও অতুলনীয়। এখানেও হিমবাহ-গুহা রয়েছে। শাহরুখ কাজলেরর ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গের একটি পোস্টার নাকি আজও রাখা রয়েছে এখানে। মনট্রেক্স শহরও অনবদ্য। মখমলের মতো সবুজ মাঠ, ছোট ছোট সুন্দর বাড়ি, মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে গরু ও ভেড়া। চারদিকে মাথা তুলে সুন্দরী আল্পস। অবর্ণনীয় রূপে ধরা দিলো সুইজারল্যান্ড আমার কাছে।
প্রতিটি স্থান প্রতিটি দৃশ্য দেখে অবাক না হয়ে উপায় ছিলনা। সৌন্দর্যের আবহে এত মগ্ন ছিলাম যে কখন জেনেভা স্টেশনে পৌঁছে গেছি তা টের পাইনি। মনে হলো চোখের পলকে সৌন্দর্য দেখা শেষ। যদিও ৫ ঘন্টার জার্নি ছিল তবু চোখের তৃপ্তি যেন নিমিষেই শেষ হলো।
জেনেভা স্টেশন অনেক বড়। কী করবো বুঝতে পারছিলামনা। সবার সঙ্গে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে থামলাম একটু। এত বড় স্টেশনে কোথায় কী তা ঠাহর করা মুশকিল। হাতে ভারী লাগেজ। এটা নিয়ে জেনেভা সিটি চক্কর দেওয়া যাবেনা। তাই সিকিউরিটি লকড বক্স সার্ভিস খুঁজতে লাগলাম। জিজ্ঞেস করে পেয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে লকারে লাগেজ রাখলাম। অটো পেমেন্ট সিস্টেম। লকারের দরজা খোলা। লাগেজ রেখে দিলাম লকারে। স্ক্রিনে লকার নম্বর সেট করে ৭ ঘন্টা সময় দিলাম। টাকা পে করলাম। টাকা পে করে লকারের দরজা লাগালাম লক হয়ে গেলো। একটা পাসওয়ার্ড পেলাম। পরে কাজে লাগবে।
বেরিয়ে পড়লাম স্টেশন থেকে। গেলাম ইনফরমেশন সেন্টারে। জিজ্ঞেস করলাম জেনেভা সিটি দেখতে চাই। আমাকে ম্যাপ ধরিয়ে দিল। কী কী দেখার আছে তা দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম জেনেভা লেকের উপর একটি ব্রিজে। লেকটি জেনেভা সিটিকে দুভাগে ভাগ করেছে। লেকের মাঝখানে অতি উচ্চ এক পানির ফোয়াড়া। দূরে পাহাড়ের উপরে মেঘেদের খেলা। লেকের উপর পানির ফোয়ারা দেখে আমি অভিভূত হলাম। এর পরে দেখতে দেখতে প্রাচীন সব ভবন ও স্থাপনা দেখতে থাকলাম। Vieille Ville সহ এরকম অনেক স্থাপত্যশৈলী দেখলাম। এরপরে গেলাম St Peter’s Cathedral নামক চার্চে। ১২০০ শতকে এটি নির্মিত হয়। এরপরে একটি চৌরাস্তাতে সবুজ ঘাসের মধ্যে ঘড়ি দেখি ।Jardin Anglais এর নাম। ১৮৮৫ সালে নির্মিত। এটি একটি আইকনিক স্পট সুন্দর পার্কের পাশে। এ ঘড়িটি ঘুরে, যা ঘড়ি নির্মাতাদের সম্মানে তৈরি। সুইস ঘড়ি যে ভালো আমরা সবাই জানি। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। সাথে কেউ নেই। আরেকটি গ্রুপ ছবি তুলছিল, তাঁরা যেচে ছবি তুলে দিল। আমি থ্যাংক ইউ বললাম। মিস্টি হাসি দিয়ে চলে গেলো মেয়েদের দলটি।
জেনেভার একদম কেন্দ্রে অতি প্রাচীন, মধ্যযুগীয় অথচ জমজমাট এক স্কোয়ার ছিল যে স্কোয়ারকে ঘিরে প্রাচীন স্থাপত্য, পাথরে বাঁধানো গলি পথ ছিল । মধ্যযুগীয় গলি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে, দুই পাশে পুরনো দিনের ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, স্থাপত্য, এন্টিক দোকানে সাজানো এক একটি পুরনো মাস্টারপিস, প্রচুর টুরিস্ট – এই সব দেখতে দেখতে যে এক প্রশস্ত স্কোয়ারে পৌঁছে গেলাম। তা জেনেভার এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র, কিংবা ঐতিহাসিক স্কোয়ার – যার নাম Place du Bourg-de-Four ।
লেক জেনেভা সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ও অন্যতম লেক। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ সুইজারল্যান্ডকে ঘিরে রেখেছে। লেকের পাড়ে অনেক বোট বাধা থাকে। Tourist রা ইচ্ছা করলে বোট ভাড়া করে লেকটা ঘুরে দেখতে পারে। লেকের এক পাশে বড় বড় পাথর যা আমাদেরকে আমাদের দেশের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় লেকে বড় বড় সাদা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছিল।চরপাশ পাহাড়ে ঘেরা। যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। আমি আরও অনেক ফটোসেসন করলাম।
রোন নদী ও জেনেভা লেক যেখানে মিলিত হয়েছে, সেই স্থানটিতে এই শহরের অবস্থান। জেনেভাকে গ্লোবাল সিটি বা বৈশ্বিক শহর বলে অভিহিত করা হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংগঠন, যেমন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কেন্দ্রীয় সদরদপ্তর এখানে অবস্থিত। এছাড়াও আন্তর্জাতিক সংগঠন রেড ক্রসের সদরদপ্তরও এখানেই অবস্থিত। হাতে সময় নেই, রাতে দেখবো বলে চলে গেলাম বাস স্টেশনে। যেখান থেকে শ্যামনিক্স যাব। চমনিক্স হচ্ছে ইটালি-ফ্যান্স ও সুইজারল্যান্ডের মিলনস্থল।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )