ঢাবির মার্কেটিং এলামনাই মিলনমেলা: স্মৃতি ও বিস্মৃতির খেলা
এলামনাই এসোসিয়েশনের সিলভার জুবিলি প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। আয়োজন দেখে টাস্কি খেয়েছি। কোটি টাকা খরচ করে প্রোগ্রাম। আমরা নামমাত্র খুচরো চাঁদা দিয়েছি বটে। মোট খরচের কাছে তা তিলকনা মাত্র। ছোটবেলার চড়ুইভাতি নয়, কলেজ লাইফে করা পিকনিকও নয় যে নিজেরা বাজার করব, রান্না করব বা গিফট কিনব। একেবারে মহাযজ্ঞ। কর্পোরেট জগতের খেলা, মার্কেটিং এর খেল, পুঁজিবাদের ছোঁয়ায় অনুষ্ঠান একেবারে জাঁকজমকপূর্ণ। ইভেন্ট মেনেজম্যান্ট আর বিজ্ঞাপনে প্রোগ্রাম চলে গেছে হাওয়ার হাতে। হাওয়ায় হাওয়ায় সব হয়ে যায়। কমিটির সবাই ভালোবাসাপূর্ণ পরিকল্পনা দিয়েছে। কমিটির সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা এত বড় প্রোগ্রাম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করায়। আমরা কেবল গেলাম আর উপভোগ করলাম। বিনা খাটুনিতে এত খাওয়া এত গিফট এত আনন্দ মুফতে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। সৌভাগ্য আমাদের। কারণ অমাদের রয়েছে সবার প্রিয় ড. মিজান স্যার যার নেতৃত্বে রয়েছে সক্রিয় দক্ষ কমিটি। বাংলার ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বিষয়ক উপস্থাপনা ও সাংস্কৃতিক আবহে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটিকে আরও ঋদ্ধ ও প্রাণবন্ত করেছে মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর উপস্থিতি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই উত্তোলিত হয়েছে আমাদের জাতীয় পতাকা আর আমরা প্রাণভরে গেয়েছি জাতীয় সংগীত।
.
ক্যাম্পাস ছেড়েছি ১৫ বছর আগে। কিন্তু সব স্মৃতি রয়ে গেছে ঠিক আগের মতো। তরুণ স্যারদের কঠিন রুপ আর ক্লাসমেটদের উপচে ভরা যৌবন। আরও কত স্মৃতি। বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া মাত্র আমরা হৈহুল্লুর করে ঝাঁপিয়ে পড়ি কথা বলতে, জড়িয়ে ধরতে। দুনিয়ার সব পুরাতন হয়, কেবল বন্ধুরাই পুরাতন হয় না। চিরজাগরুক, চিরযৌবনা। এলামনাইয়ের মিলনমেলায় গিয়ে আমরা সেরকম মন নিয়েই তাকাই একে অপরের দিকে। স্যারেরা এখন বৃদ্ধ ন্যুব্জ। বন্ধুদের কেউ ভুড়িওয়ালা, কেউ মাথায় টাক, কেউ দাড়ি লম্বা বা পাকা , কারো কারো বয়সের ছাপ মুখে ও শরীরে স্পস্ট। বান্ধবীরা কেউ জরাজীর্ণ, কেউ ডায়াবেটিসে শুকিয়ে কাঁঠ, কেউ ফুলেফেঁপে মাশাল্লাহ, কারো চুলে পাক ধরেছে কারোবা মুখে বয়সের ভাজ, কেউবা অতিমাত্রায় পর্দানশীন, কেউ অতিমাত্রায় মেকাপলেডি সেজেছে, আরও আছে নানান ঢঙ আর পেখম।
.
এসবতো বাস্তবদৃশ্য। কিন্তু কথা আচরণে চিৎকার চেঁচামেচি আর উল্লাস ও টিপ্পনী কাটা শুনলে ও দেখলে বোঝা যায় সবার বয়স এখনো ২৫ এর ঘরে । যেন সবাই সেই আগের বয়সে। শব্দের খেলা, বাক্যের মেলা, চোখে মুখের অভিব্যক্তি, রস কষ সিংগা বুলবুল, মালেক মস্তক… যার যত কলা আছে তা সকলেই প্রকাশ করেছে সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। উচ্ছাস আর উৎফুল্লতা দেখে মনে হয়েছে সবাই হারিয়ে গেছে পঁচিশের আমাজনে। যেসব মানুষ বাসায় স্পাউজের সাথে সারাদিনের একটিবার হাসে না সেসব মানুষও হেসে আজ কুটিকুটি। হাসির বানে ভেসে গেছে পুরো জিমনেসিয়াম মাঠ। যেন হাসির বন্যার ফুয়ারা পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
.
তো আমরা কী করলাম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত? খাওয়া দাওয়া, গিফট গ্রহণ, আর আড্ডাতো আছেই। সাথে আমরা বড় বড় স্যারদের সাথে দেখা করার চেষ্টা করলাম। বড় স্যার বলতে যাদের বড় পদ আছে, ক্ষমতা আছে, বহাল তবিয়তে আছে, জনপ্রিয়তা আছে সেসকল স্যারদের সাথে সেলফি তোলার চেষ্টা করলাম। পরিচিত হলাম, বিগলিত হলাম, আদব লেহাস সব দেখিয়ে নানান ঢঙে পরিচয়ের কুশেশ করলাম আবার ফাঁকতালে ছবি তুলে নিলাম। যেসকল স্যারগণ বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অবসরে গেছেন বা যাওয়ার পথে, বড় কোনো পদে নেই, ও যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই তাঁদের কাছে গেলাম না, খোঁজ খবরও করলাম না। দূর থেকে দেখলেও হেঁটে গিয়ে যেচে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার প্রয়াস নিলাম না। আমরা এখন ব্যস্ত। ক্যারিয়ার নিয়ে, পদপদবী নিয়ে, ব্যাবসার সুযোগ নিয়ে। সুতরাং কার কাছে যাবো না যাবো এ বিষয়ে আমাদের খুব বাছাবাছি। কোথায় কখন কীভাবে কতটুকু সময় ব্যয় করবো এ নিয়ে আধুনিক যুগের মোটিভেশনাল স্পিচ সব মুখস্ত। সুতরাং স্যার বা বড় ভাই। কাউরেই আমরা গুণি না, যদি না আমাদের মগজে ক্লিক করে যে ‘ওই স্যার বা বড় ভাই আমাদের কাজে লাগবে‘‘। কী পুঁজিবাদী মনন ও মগজ আমাদের!
.
বন্ধুরা এসেছে বান্ধবীরা এসেছে। আমাদের বয়স অনেক পেরিয়ে গেলেও এখনো আমরা উদার হতে পারিনি। কেউ কেউ মন খুলে কথা বলতে পরি নি, হাত খুলে জড়িয়ে ধরতে পারি নি। কোথায় যেন দূরত্বের একটা আলগা ভাব আমাদেরকে আড়ষ্ট করে রেখেছে। কেউ কেউ আগের মতোই ছোটো ছোটো গ্রুপে থাকতে চায় এখনো। সবাই মিলে আড্ডা দিবে এত উদারতা নেই তাদের এখনো। ক্যাম্পাস লাইফে যেমন দুতিন জনের একটা কোরাম মেনটেন করতো তারা , সেরকম এলামনাই প্রোগ্রামেও তারা কয়েকজন মিলে হাওয়া হয়ে যায়। কদাচিৎ কোনো গ্রপে দেখা হলে হাই হ্যালো করে দুটো ছবি নিয়ে আৎকা কেটে পড়ে । যেন তাদের একান্ত সময় নষ্ট হচ্ছে। এ বাচ্চাগুলো কবে যে বড় হবে!
.
আমরা সবাই নানান কিসিমের হলেও কিছু বিষয়ে আমরা সবাই প্রায় একইরকম। বন্ধুদের কার বড় চাকুরি, কার পদবি কত উপরে, কে কতটা প্রমোশন পেয়েছে, কার কর্পোরেট রেট কত উপরে, কার বড় ব্যবসায়, কে দেশে বিদেশে সব কিনে ফেলেছে, কার স্পাউজ কত সুন্দর আর হ্যান্ডসাম, কার স্পাউজ ধনে গুণে বড় লোক, কার বাচ্চারা কত বড় জায়গায় পড়াশোনা করে, কে কত দেশ বিদেশে ঘুরেছে সেসব আমাদের মনের ভিতরে ঘাঁপটি মেরে থাকে। যখন দেখা হয় তখন এসব ভেবে আমরা আমাদের কথার মাত্রা ও ধরণ ঠিক করি, ও শব্দভান্ডার খুলি। মুখের দাঁত কতটুকু মেলবো, কতটা হাত প্রসারিত করবো, কতটুকু সময় দিব, কতটুকু আন্তরিক হবো, এসব মাপঝোখ সব মিলিয়ে নিই আমরা মনে মনে। তারপর আমরা টেইলারের মতো, নাপিতের মতো, বিউটিশিয়ানের মতো হিসেব কষে আচরণ করি। ঠিক আমরা ইচ্ছে করে করি তা নয়, আমাদের মনোজগত আমাদের দিয়ে করিয়ে নেয়। যেসব বন্ধু বা বান্ধবীদের ক্যারিয়ার বা ব্যবসা ততটা ভালো নয়, তারা আমরা কিছুটা ম্রিয়মান হয়ে পড়ি, নিজেকে সরিয়ে রাখি, বেশি কথা বলি না। খালি যারা যারা বেশি বেশি সফল তাঁদের জামাকপাড় দেখি, তাদের গাড়ির নাম পড়ি, তাদের রূপে রঙ্গে কথার জোশে আমরা ঠিক নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি না, খেই হারিয়ে ফেলি। হু হাঁ করে যাই বটে। কিন্তু আমাদের কোথায় যেন একটা পর্দা থাকে। আমরা ঠিক নিজেকে মেলে ধরতে পারি না। যেমনটা ক্যাম্পাস লাইফের প্রথম বর্ষে পেরেছিলাম। লাথি মার ভাঙরে তালা আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা কিংবা দুনিয়ার সবকিছুরে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার যে হিম্মত তা আমাদের এখন ফিঁকে হয়ে এসেছে। এখন যুগের পর যুগ পার করে আমরা বুঝি সমাজ সংসারে ব্যবধান, পার্থক্য, বেমিল, উঁচু নিচু থাকবে, আছে। আর শ্রেণীর খেলাই আসল খেলা।
.
আমাদের কেউ কেউ যেন কেবল ছবি তুলতেই এসেছি। ডানে ছবি বামে ছবি, বসে ছবি দাঁড়িয়ে ছবি, সিংগল ছবি, ডুয়েল ছবি, গ্রুপ ছবি, কাত হয়ে ছবি, চিৎ হয়ে ছবি। মানে ছবি তোলা ছাড়া যেন আর কোনো কাজ নেই। স্মৃতির জন্য কিছু ছবি তোলা ঠিক আছে। কিন্তু এতদিন পরে দেখা হয়েছে যেখানে, সেখানে কথা আর আড্ডাই হওয়ার কথা মূল বিষয়। কিন্তু তা নয়, করেছি কেবল ছবি আর সেলফি তোলার দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতা। এতদিন পরে প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের সাথে দেখা হলো, একটু নস্টালজিয়ায় হারিয়ে যাওয়া, একটু আশনাই করা, একটু পুরোণো স্মৃতি ঝালাই করা, একটু খুনসুটি করা, একটু টিটকারি ফিটকারি মারা- এসব না হলে আর বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে কী লাভ। অনেক বন্ধুরা এটা করেছেন। তারাই আসলে দিনটাকে কাজে লাগিয়েছেন। যারা কেবল খেতে এসছে আর ছবি তুলতে এসছে, ক্যারিয়ারের ভাব মারাতে এসেছে, আর জামা ও মেকাপ দেখাতে এসেছে ওরা আসলে দিনটা অপচয় করতে এসেছে। এদের জীবনটাই আসলে অপচয়। ওরা জানে না জীবনের মানে কোথায়? জীবন কোথায় কীসে খুঁজে পাওয়া যায়। ‘‘জীবনের মধ্যে মুহুর্ত খুঁজোনো, মুহুর্তের মধ্যে জীবন খুঁজো‘‘- উপদেশের মর্ম এরা বুঝে না। এদের জন্য আফসোস!
.
শেষকালে গানের তালে তালে নেচে গেয়ে সবাই হারিয়ে গিয়েছিল। ৪০-৫০ বয়সের বয়স্করা হয়ে গিয়েছিল ১৫-৩০ বছর বয়সের তরুণ। উদ্যম নাচ আর মুর্হমুর্হ চিৎকারে আকাশ কাঁপিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যৌবন এখনো এদের হাতের মুঠোয়, জীবন এদের হৃদয়ে খেলা করে প্রতিনিয়ত। শুধু ম্যাচের কাঠির মতো জ্বলে উঠে না সময় ও সুযোগের অভাবে। এই এলামনাই প্রোগ্রাম সেই ম্যাচের কাঠির বারুদের ঘঁষার মতো কাজটি করেছে। সবাইকে আনন্দের হিল্লোলে জাগিয়ে তুলেছে, করেছে বাঁধভাংগা জোয়ারের অদম্য মাঝি। জীবনকে আজ উত্তাল তরঙ্গর মতো উপভোগ করেছে। ‘‘আবার যদি আসবি সখা প্রাণের মাঝে আয়‘‘ বলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
.
ঢাবি ও মার্কেটিং বিভাগের সবার জন্য শুভকামনা। আবারও ধন্যবাদ আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেককে।
…………
ড. সফিকুল ইসলাম
৪র্থ ব্যাচ,
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )