জব্বার আল নাঈম এর লেখা ‘নিষিদ্ধশয্যা
বড় বা মাঝারি উপন্যাস একটানে পড়ে ওঠার সময় পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যারা ব্যস্ত তাদের জন্য তা কঠিন। তবে ২০০ পৃষ্ঠার বই মজা লাগলে একবসায়ও পড়া যায় যদি বইয়ের গল্প ও ভাষা আপনাকে ধরে রাখতে পারে। আজ এমন একটি বই পড়লাম। যেন মুভি দেখছিলাম চোখের সামনে। সাধারণত সিনেমা যেরকম হয়, সেরকমই সব কাহিনী, ও কাহিনীর বাঁক। এই বইটিকে যে কোনো স্ক্রিপ্ট রাইটার লিখে সিনেমায় রূপ দিলে সিনেমা হিট হবে বলে আশা করি।
তাহলে কি বইটি সিনেমাটিক? না তা নয়। লেখকের কথা বলার ঢং, শব্দচয়ন, ভাষার কারুকার্য, গল্প বলার স্টাইল আর লেখার ধরণে এটি উপন্যাসে রূপান্তরিত হয়েছে। কথাশিল্পী হিসেবে লেখক তার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
কথাশিল্পী জব্বার আল নাঈম এর লেখা ‘নিষিদ্ধশয্যা‘ বইটির কথা বলছি। নাম শুনেই অনেকে নিষিদ্ধ কিছুর গন্ধ পেতে পারে। আসলে বইটিতে নিষিদ্ধ কিছু নেই, যা আছে তা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এর অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো (informal institutions) কীভাবে মানুষ, সম্পর্ক, পাড়া ও মহল্লাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর রাজনীতি, ধর্ম, ক্ষমতা ও ব্যাক্তিজীবন কীভাবে এদের হাতের পুতুল হয় –তাই তিনি তুলে ধরেছেন সুনিপূনভাবে।
মানুষ কোন ধরণের পরিবারে জন্ম নিবে তা মানুষ নিজে ঠিক করে না। কিন্তু মানুষ যে পরিবার বা পরিবেশে জন্ম নেয় ও বড় হয়, সেই পরিবার ও পরিবেশ তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। সেই পরিবেশ বা প্রতিবেশ থেকে বের হওয়া আসলেই প্রায় অসম্ভব। স্বপ্না নামের মেয়েটি সেইরকম জীবন ও পরিবেশ থেকে বের হতে চেষ্টা করে। সেই চেষ্টায় যে সংগ্রাম তাই তুলে ধরেছেন লেখক এমনভাবে যেন পাঠকও তার নিজ জীবনের বা আশেপাশের নানান সংগ্রাম দেখতে পায়।
প্রতিটি মানুষের জীবনেই একটা নিষিদ্ধ জগত থাকে, সেটা কেউ সামনে প্রকাশ করতে চায় না। সে ভদ্র ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নিজের ইতিবাচক পরিচয় চায়। নিজের করা বাকিসব অকাজ কুকাজ লুকিয়ে রাখতে চায়। তবু স্বপ্না নামের মেয়েটির জীবনসংগ্রাম বলার ফাঁকে ফাঁকে লেখক এখানে অনেক ভদ্রসমাজের অভিজাত ও ক্ষমতাবানদের মুখোশ উম্মোচন করেছেন শাণিত ভাষায়।
ইহজগতেতো মানুষের শ্রেণীচরিত্র আছেই, আছে শ্রেণীবৈষম্য। দুনিয়ার সকল জমিই এর মধ্যে। এমনকি কবরস্থান বা কবরে যাওয়ার পরেও মানুষ শ্রেণীচরিত্র বা শ্রেণীবৈষম্য বহাল রাখতে চান। জাত-পাতের নামে কবরস্থানকেও কারো কারো জন্য নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয় এই সমাজে। সমাজের যারা এসব করেন তারা নিজেরাও ভিতরে ভিতরে অনুরূপ পাপের পাপিষ্ঠ। আসলেই এ ধরা এক বিচিত্র জগত!
যেকোনো ছোট ঘটনা বা বস্তু বা পরিবেশকে লেখক খুব ভালো করে পরিস্ফুটিত করতে পারেন অনায়াসে। সেলিম ঠাকুর যখন খুব মেজাজ খারাপ মুহুর্তে তখন স্বপ্নাও ফোন ধরছেনা, ড্রাইভার ফোন ধরছে না, সিগারেটের লাইটার জ্বলছে না, কারো কাছে চেয়ে ম্যাচও পাচ্ছে না, শরীর যাচ্ছে ঘেমে, মেজাজ চরমে। এমন মুহুর্তের পুঙ্খানুপূঙ্খ ডিটেইলড বাস্তবতা তুলে ধরা যেন কেবল কথাশিল্পী জব্বার আল নাঈমের পক্ষেই সম্ভব!
ঘটনার বর্ণনায়, কাহিনীর বুননে, গল্পের ভিতর অনুগল্প শুরু বা শেষ করার মাস্টারিতে লেখক দক্ষতা দেখিয়েছেন। এবং এসব গল্পের মাঝে থরে থরে সাজানো রয়েছে অনেক সিদ্ধান্তমূলক দার্শনিক বাণী। রয়েছে যাত্রার বিবেকের মতো সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক এবং নৈতিকতা নিয়ে অনেক নীতিবাক্যও।
সবমিলিয়ে বইটি আমি উপভোগ করেছি। যে কোনো পাঠক পড়ে আনন্দ পাবেন, সুখপাঠ্য এ বইটি পড়ে।
অর্জন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত উপন্যাস ‘নিষিদ্ধশয্যা‘ এর জন্য রইলো শুভকামনা। শুভ কামনা চাঁদপুরের মতলবের সন্তান জব্বার আল নাঈমের জন্যও। তাঁর আগের দুটি কবিতার বইও (‘তাড়া খাওয়া মাছের জীবন‘ ও ‘এসেছি মিথ্যা বলতে‘) আমার ভালো লেগেছিল।
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )