Detail

Home - সমসাময়িক - কৃষিবান্ধব সরকারের আন্তরিক বাজেট: দুধের সর যেন বিড়ালে না খায়

কৃষিবান্ধব সরকারের আন্তরিক বাজেট: দুধের সর যেন বিড়ালে না খায়

মহামারি করোনা ভাইরাসের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি খেয়াল রাখার পাশাপাশি খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সরকার কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের কৃষি খাতকে এবারের বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া প্রণোদনাও চালু থাকবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষককে সুবিধা দিতে নতুন অর্থ বছরে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ ধরলে এ প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য জিডিপির ২.৮৯ শতাংশ হিসেবে ১৬৪৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় শতকরা ২৫.৮৩ ভাগ বেশি। আর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ৩১৯৩ কোটি টাকা। যা বিগত বাজেটের তুলনায় ২৬.১৬ শতাংশ বেশি। বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, “এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কৃষি হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত।”তিনি আরও বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই যেন খাদ্য সঙ্কট না হয়। সেজন্য এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না।” সব মিলিয়ে সরকারের ভিশন ও মিশন এবং প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার বহি:প্রকাশ সুস্পষ্ট। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে, রয়েছে বরাদ্দ প্রদানের বাস্তবমুখী উদাহরণ। সেভাবেই জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রয়েছে ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা ও পলিসি।  এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের জন্য এত আয়োজন তাদের কাছে এ সুবিধা পৌঁছবে কিনা? বাস্তবে কী কী বাধা কাজ করে মাঠে ঘাটে।

কিছু চিত্র দেখি-

প্রথমত সবাই নিজেরে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সবাই নিজের আখের গোছাতে থাকে, সবাই নিজের হিস্যা বোঝে নেয়। শুধ কৃষক নিজেরটুকু আদায় করতে পারেনা। কৃষকরা যাতে ন্যায্য মূল্য পায় সেজন্য সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। যেমন প্রণোদনা দিচ্ছে, সারের দামে ভর্তুকি দিচ্ছে, সেচে ভর্তুকি দিচ্ছে, কৃষি ঋণ দিচ্ছে, এমনকি কৃষি-যন্ত্র ক্রয়েও শুল্ক মওকুফ করছে।। দশ টাকা দামে কৃষকের ব্যাংক একাউন্ট করেছে, যাতে কৃষক সহজে ঋণ পায়। কিন্তু অনেক সময় প্রান্তিক কৃষকদের সিংহভাগ এ ঋণের সুযোগ পাননা। গ্রামের চতুর শ্রেণি নানা কারসাজির মাধ্যমে তা ভোগ করে। মাঝে মাঝে কৃষি ঋণ সম্পূর্ণ মওকুফ করে সরকার, ভর্তুকি দিয়ে সরকার ধান কিনে। এরকম আরও অনেক উদ্যোগ ও চেষ্টা সরকারের রয়েছে। কিন্তু সারের ভর্তুকি সুবিধা থেকে কৃষকের আশেপাশে বাস করা সার ব্যবসার সাথে জড়িতরা ফায়দা নেয়; সেচের ভর্তুকিতে কৃষকের পাড়াতো ভাই সেচ ব্যবসায়ীরা সুবিধা পায়; কৃষি ঋণে কৃষকের তালাতো ভাইদের পেট মোটা হয়; ধান কেনার ভর্তুকিও এরকম পরিচিত ভাইদের কারণেই হারিয়ে যায়, কৃষি যন্ত্র ক্রয়ের শুল্ক মওকুফও পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের বেশি মার্জিনের কারণে কৃষককে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। সরকারের এতসব আন্তরিক প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করে কিছু লোক। তারা কারা কেন, কী কী কারণে কীভাবে এসব করে- এ নিয়ে গবেষণা দরকার এবং করণীয় বের করা দরকার।

দ্বিতীয়ত বাংলাদেশে অন্যান্য পন্য যে হারে দাম বেড়েছে সে হারে  কৃষিপন্যের দাম বাড়েনি। শহরে বাড়লেও কৃষক পর্যায়ে সে দর পায় না। অস্ট্রেলিয়ায় চালের দাম ৮০০০ টাকা মণ। জাপানে চালের দাম তারও অনেক বেশি। ঢাকায় চালের দাম ২০০০ টাকা মণ। চাল আবার রপ্তানিও হয়। তবে যেসব দেশে রপ্তানি করলে বেশি দাম মিলবে সেসব দেশে রপ্তানি হয় কিনা। রপ্তানি যদি হবে বেশি মূল্যে তবে কৃষক মূল্য পাবে না কেন? ধানের দাম গ্রামে ৫০০ টাকা মন! খুচরা ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক, রাইসমিলওয়ালা, পথে পথে ফড়িয়া ব্যাপারীরা মাত্রাতিরিক্ত লাভ করে। ট্রাকওয়ালা বেশি ভাড়া নেয়,  পথে পথে চাঁদা দিতে হয়, গুদামমালিক ভাড়া বেশি নেয়। তাদের এত লোভ কেন, তারা কেন কীভাবে কী কী করে- এ নিয়ে অনুসন্ধান দরকার।

তৃতীয়ত কৃষকের ধানের দাম বাড়িয়ে দেওয়া সরকারের একক কাজ নয়। প্রধান দায়িত্ব সরকারের নিশ্চয়ই। সরকারের করণীয় সরকার করবে। সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রেণি পেশার মানুষকেও ভাবতে হবে। কৃষককে নিজেও ভাবতে হবে। কৃষকের  আশেপাশের নেতাকেও ভাবতে হবে, রাস্তায় চাঁদা না নেওয়ার কথা। কৃষকের পাড়াতো ভাই পরিবহন নেতাকে ভাবতে হবে, একটু কম লাভ করার কথা। কৃষকের খালাতো ভাই রাইসমিল মালিককে ভাবতে হবে, একটু কম মুনাফা করার কথা। কৃষকের প্রতিবেশী ভাই খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীকে ভাবতে হবে, একটু কম কমিশন নেওয়ার কথা। রপ্তানীকারককে ভাবতে হবে, মার্জিন কম নেওয়ার কথা। কৃষকের দূরের আত্মীয় ভোক্তাদেরকেও ভাবতে হবে, সব দাম দিয়ে কিনতে পারলে চালও দাম দিয়ে কিনবে। সরকারের মাঠ পর্যায়ের সংস্থাগুলো খেয়াল রাখতে হবে যেন সকল অংশীজন সঠিক আচরণ করে।

চতুর্থত

পঞ্চমত ধর্ম, তত্ত্ব, মতবাদ নিয়ে রাজনীতি হয়, শাদা-কালো নিয়ে রাজনীতি হয়, অঞ্চল নিয়ে রাজনীতি হয়, খনিজ সম্পদ ও বনজ সম্পদ নিয়ে রাজনীতি হয়, কিন্তু দেশের সিংহভাগ ভোটার কৃষকদের স্বার্থ নিয়ে কৃষকরা সঙ্ঘবদ্ধ নয়, প্রান্তিক কৃষকদের সমিতি নেই, দু-একটা থাকলেও শক্ত নয়। কৃষকরা নিজেরা শক্ত না হলে বিত্তবানরা তাঁদের সম্পদের তথা ধান-চালের প্রকৃত দাম দেবে না- এটাই বাস্তবতা। শক্তের ভক্ত নরমের যম- এ প্রবাদের মতোই বাস্তবতা। পেশা বা কাজভিত্তিক এ শ্রেণি বিভাজনের খেলায় প্রভাবশালী খেলোয়াররা নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। এ কারণেই কৃষকদের হিস্যা পথে পথে ঘাটে ঘাটে ইঁদুরেরা খেয়ে ফেলে। কৃষকের জমির ফসল খায় জমির ইঁদুর, আর ভর্তুকি, ঋণ, প্রণোদনার ভাগ প্রায়ই খায় অন্য ইঁদুরেরা। এভাবেই কৃষকের উন্নয়নে কৃষকদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে করা সরকারের পরিকল্পনা যথাযথ ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী ও সজাগ হতে হবে। উদ্যোগগুলো কার্যকর করার বিষয়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যাতে করে সরকারের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হয সঠিকভাবে, যাতে বরাদ্দগুলো যথাযথভাবে পৌঁছে প্রকৃত কৃষকের হাতে । কোনো মধ্যস্বত্বভোগী যেন এসবের ভাগ না পায়। দুধের সরের মতো উপর থেকে সরটা না যেন কেউ না খেয়ে ফেলে । করণীয় হতে পারে- এক. সরাবরাহ চেইনগুলো সুষ্ঠু ও সুন্দর করার মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে, মেকানিজম বের করতে হবে। দুই. কৃষকদের মূলধন সংকট দূর করার জন্য কৃষি ঋণ যেন প্রান্তিক কৃষকের হাতেই পৌঁছে সেজন্য ডিজিটাল ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে এবং প্রকৃত কৃষক বাছাইয়ে কমপ্রেহেনসিভ ও ইনক্লুসিভ মেকানিজম এবং ডিজিটালাইজড ফরমেট বের করতে হবে। তিন. সেচে, সারে ও কৃষি যন্ত্র আমদানিতে ভর্তুকির সুফল যেন প্রান্তিক কৃষকরা পায় সেজন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর করতে কার্যকর পন্থা নিতে হবে।

করোনাকাল আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে কৃষি, কৃষক ও ফসলের গুরুত্ব কত বেশি। সুতরাং এ খাতকে পুঁজিবাদের আগ্রাসী থাবা থেকে রক্ষা করতে হবে। কৃষিবান্ধব সরকারের সকল পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার সফল ও ফলপ্রসূ বাস্তবায়নে সকল অংশীজনকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।

-ড. সফিকুল ইসলাম (অস্ট্রেলিয়ার থেকে ‘পাবলিক ফান্ড ডিস্ট্রিবিউশন ও রাজনৈতিক অর্থনীতি‘ নিয়ে পিএইচডি করেছেন)

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

প্রথম আলো সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত

https://www.prothomalo.com/opinion/%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%AC-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%9F-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%A7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%B0-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A7%9F#:~:text=%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%20%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0%20%E0%A6%AE%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%20%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9B%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%20%E0%A6%AA%E0%A6%A1%E0%A6%BC%E0%A6%BE,%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC%20%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9A%20%E0%A6%85%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%20%E0%A6%B9%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A5%A4

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart