বুয়েটে, মেডিকেল, কৃষিতে পড়ে, বিবিএ এমবিএ করে সাধারণ বিসিএস এ আসা কি উচিত?
বুয়েটে–মেডিকেল-কৃষিতে পড়ে, বিবিএ এমবিএ করে সাধারণ বিসিএস এ আসা কি উচিত?
-ড. সফিকুল ইসলাম।
৩৮তম বিসিএস এ বুয়েট-মেডিকেলে পড়ুয়াদের অনেকেই বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ মিডিয়াতে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। বুয়েটে পড়ে প্রকৌশলী হবেন, মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হবেন, বিবিএ এমবিএ করে কর্পোরেট লিডার হবেন, কৃষিতে পড়ে কৃষিবিদ হবেন এটাই সর্বজন কাম্য। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাই হয়। কারণ এর দ্বারা তাঁদের অর্জিত জ্ঞানের বাস্তবমুখী ফলপ্রসূ ব্যবহার হয়। দেশের প্রকৌশল সেক্টর, চিকিৎসা খাত, কৃষি খাত, ব্যবসায় খাত লাভবান হয়, উন্নত হয়। তবে কেউ যদি ব্যাকগ্রাউন্ড ছেড়ে নতুন প্রফেশনাল জগতে পা বাড়াতে চায় তবে তাঁকে বাঁধা দেওয়া সমীচীন হবেনা।
কারণ সারাবিশ্বের সকল দেশে পাবলিক সার্ভিসের ক্যাডার-অফিসার পদে সকল স্নাতকরা আসেন। প্রতিটি দেশের নিয়োগ বিধি এমনভাবেই তৈরি। এখানে দেখা হয় তার সাধারণ সব বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট লেভেলের মেধা, শ্রম, চেষ্টা আছে কিনা। এ যোগ্যতায় নিয়োগ হয়। এখানে সকল স্নাতক অংশ নিতে পারেন। ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যবসায়, কারিগরী, মাদ্রাসাসহ সকল ঘরাণার সকল বিষয়ের ছাত্র আসবে। সকল দেশেই এ রেওয়াজ। ক্যরিয়ার চয়েস করার ক্ষমতা প্রত্যেক নাগরিকের ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত আছে। সুতরাং যে আসে সে যোগ্যতা নিয়ে আসে। এবং পরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সকল শিক্ষা লাভ করে।
অনেক ডাক্তারকে আইনজ্ঞ হতে দেখেছি, ইতিহাস পড়ে অর্থনীতিবিদ হতে দেখেছি, আর্টসে পড়ে নগর পরিকল্পনায় ভালো ভূমিকা রাখতে দেখেছি, সাইন্স এ পড়ে কবি হতে দেখেছি। তথা যে কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে রাষ্ট্রে ভূমিকা রাখতে পারে যদি কারো ইচ্ছা থাকে। ৪ বছর ডিগ্রি নেওয়াই শেষ কথা না, চাকুরির ৩০ বছরও তার পড়েই কাটে, নেয় কঠিন প্রশিক্ষণ, লাভ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা। নাগরিক হিসেবে যে কোনো সময় তার ক্যারিয়ার সে পরিবর্তন করবে – এটা তাঁর অধিকার।
শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে কাজ করবে, ব্যবসায় পড়ে কর্পোরেটে কাজ করবে এরকম একসময় আমিও ভাবতাম। সারা বিশ্ব দেখে ও ভিন্ন ভিন্ন কর্মক্ষেত্র দেখে আমার উপসংহার হলো সকল স্নাতকের অধিকার আছে বিসিএস দেওয়ার ও আসার। এ নিয়ে কোনো সমালোচনা চলেনা। সারাবিশ্বের রেওয়াজ, বাস্তব প্রেক্ষিত, রাষ্ট্রকাঠামো, ৩৬০ ডিগ্রী চিন্তা, হাজার উদাহরণ না জেনে কোনো সমালোচনা করা ঠিকনা।
বুয়েটে পড়ে বিসিএস না দিলেই কেউ প্রকৌশলী হবে এমন ভাবনা ভুল । বুয়েটে পড়ে প্রকৌশলী হতে পারে, আমলা হতে পারে, শিক্ষক হতে পারে, কবি হতে পারে, উদ্যোক্তা হতে পারে, কর্মী হতে পারে, রাজনীতিবিদ হতে পারে, নাগরিকের যা মনে চায় তাই হতে পারে। আর সব হতে পারলে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারও হতে পারবে। একজন নাগরিক মেধা দিয়ে সে বুয়েটে ঢুকেছে, মেধা দিয়ে সে বিসিএস এ টিকেছে। এ নিয়ে আমরা যারা বুয়েটে পড়িনি তারা ঈর্ষা করার কিছু নেই।
সুতরাং নাগরিক হিসেবে একজন যেকোনো পেশায় যেতে পারেন। যার মেধা আছে, যার ফাইট দেবার হিম্মত আছে, যার পরিশ্রম করার নেশা আছে সে গতকাল বুয়েটে পড়বে, আজকে বিসিএস ক্যাডার হবে, আগামীকাল মন্ত্রী হবে, পরশু কর্পোরেটের মাথা হবে। দুনিয়া এমন যে কেউ কাউরে জায়গা দেয়না, জায়গা করে নিতে হয়। সারাবিশ্ব পুঁজিবাদে রেখে, সমাজের সবখানে ‘নিজের থাকলে খাও , না থাকলে চোখ পাকাইয়া চাও‘‘ সিস্টেম বজায় রেখে শুধু বুয়েট মেডিকেলে ছাত্রদের সাধারণ বিসিএস না দিতে বলার মানে নেই। তাঁদেরকে আসতে দিন, অন্যরাও যুদ্ধ করুক। যুদ্ধের মাধ্যমে যোগ্যরা এগিয়ে যাক।
Let them do. Let us fight and get too. We should not be envious and backbiter.
সম্যক না জেনে পেছনে কথা না বলাই সমীচীন।
তবে এর ভিন্ন দিকও আছে।
অনেকে হয়তো বলবে যদি সাধারণ বিসিএসেই আসবে তবে বুয়েট মেডিকেলে পড়ার কী দরকার ছিল। অনেক সময় এরকম হয় যে অভিভাবকদের চাপে পড়ে ছাত্ররা একটা বিষয় নেয়, পড়ে ঐ বিষয়ে তার আগ্রহ থাকেনা। আবার এরকমও হয় অনার্স পড়তে পড়তে ম্যাচিওরিটি আসে, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা বাড়ে, কৃষি/প্রকৌশল/চিকিৎসায় পড়লেও রেজাল্ট ভালোনা, বা ট্যাকনিক্যাল কাজে আর আগ্রহও উদ্দীপনা পায়না। কাজের প্রতি প্যাশন থাকেনা। তখন তাঁদের পেশাজীবন পরিবর্তনই জরুরি। যেখানে মনপ্রাণ থাকেনা সেখানে মানুষ কাজ করে সফল হয়না। সেক্টরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকে আবার সাধারণ বিসিএস এর সুযোগসুবিধা নিয়ে কথা বলেন। সুযোগসুবিধা প্রায় সমান। বরং কারিগরী লাইনে গেলে কনসাল্টেন্সি করে বাড়তি বৈধ ইনকামের অবারিত সুযোগ রয়েছে। তবে আমজনতা দীর্ঘ লিগাসির কারণে সাধারণ বিসিএস এর কিছু পদকে বেশি সমীহ করে। এটা সামাজিক ব্যাধি। এ থেকে পরিত্রাণ দরকার। তাই বলবো যদি সাধারণ বিসিএস এর পেশাগত কাজ ও এর ধরণ কারো ভালো লাগে তবেই যান। যদি কাজ ভালো না লাগে, তবে তাদের যাওয়া উচিত হবেনা। শুধু কিছু নাম আর চাকচিক্য দেখে ওই পেশাতে গেলে পরে মানসিকভাবে আরাম পাবেনা, আর সেবাও বিঘ্নিত হবে। টেকনিক্যাল পদগুলোতে সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রের সামর্থ্য অনুসারে বাড়ানো উচিত। এ বিষয়ে আমার একজন অভিজ্ঞ সিনিয়র বলেছেন ‘‘চাকরিতে বিদ্যমান সম্মান, মান মর্যাদা, বৈধ সুযোগ সুবিধার কমতির কারণে যদি টেকনোক্রেটরা টেকনিক্যাল সার্ভিস পরিত্যাগ করে তবে সেটিও দেখা দরকার এবং সমাধান দরকার‘‘। আমি বলবো টেকনোক্রেট লাইনে পড়তে যাওয়ার আগেই ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা উচিত। ছাত্র ও অভিভাবক উভয়ের। পড়ার পরে পরিবর্তন করার চেয়ে আগে পরিবর্তন করা জরুরি। তাতে উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করা যায় এবং অর্জিত শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে দেশের জন্য লাগানো যায়।
সব মিলিয়ে আমার উপসংহার নিম্নরূপ:
প্রথমত: ব্যাকগ্রাউন্ড যাই হোক একজন নাগরিক যে কোনো পেশায় যেতে পারেন। এটা তার অধিকার।
দ্বিতীয়ত: ছাত্র যেমনি হোক, যে বিষয় পছন্দ সে বিষয়ে পড়া উচিত। আর যে বিষয়েই পড়া হোক, যে পেশা ভালো লাগে সে পেশায় যাওয়া উচিত। যে পেশা পছন্দ না, সে পেশায় যাওয়া উচিতনা। তাতে দেশের ক্ষতি, প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়, নাগরিকরা সেবা পাননা।
তৃতীয়ত: অনেককে দেখেছি প্রশাসন ক্যাডারে জয়েন করে এর চৌদ্ধগুষ্ঠি উদ্ধার করতে। এত কাজ কেন? ছুটি নেই কেন? ব্যক্তি জীবন নেই কেন? এত প্রেশার কেন? গ্রামে পোস্টিং কেন? ইত্যাকার অভিযোগ। এগুলো যার ভালো লাগে তিনিই এ পেশায় আসা উচিত। প্রতিটি পেশার কিছু সুবিধা আছে কিছু হেজার্ড আছে। সব বিবেচনা করে পেশায় যাওয়া উচিত। শুধু হাইলাইট বা কিছু চাকচিক্য দেখে যাওয়া উচিতনা। তাতে তারও কষ্ট, সেবার মানও নষ্ট। যার বিদেশ ভালো লাগেনা, তার পররাষ্ট্র ক্যাডারে যাওয়া সমীচীন না। যার গ্রাম ভালো লাগেনা, কাজের প্রেশার ভালো লাগেনা তার প্রশাসন ক্যাডারে যাওয়া উচিতনা। তেমনি ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, শিক্ষা ইত্যাদি খাতে রয়েছে নানানমুখী সুবিধা, রয়েছে নানানমুখী চ্যালেঞ্জ। মোট কথা যে কাজটি একজনের ভালো লাগে যে কাজটির মাধ্যমে সেবা দিতে একজনের ভালো লাগে তার সে পেশাতেই যাওয়া উচিত।
চতুর্থত: মেধা বা সাবজেক্ট কোনো ইস্যু না। দেশপ্রেম না থাকলে কাউকে দিয়ে দেশের লাভ হয়না। মানবপ্রেম না থাকলে কাউকে দিয়ে মানুষের লাভ হয়না।সৃষ্টিপ্রেম না থাকলে কাউকে দিয়ে সৃষ্টির লাভ হয়না। কাজপ্রেম না থাকলে কাউকে দিয়ে কাজের কাজ কিছু হয়না। দায়িত্ববোধ না থাকলে কাউকে দিয়ে দায়িত্ব পালন হয়না।
পছন্দের বিষয়ে পড়ি। পছন্দের পেশা বেছে নিই, এবং পেশাতে গিয়ে পেশাকে ভালোবেসে দিনরাত কাজ করি। দেশ বিনির্মানে ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করি।
.
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )