Detail

Home - গল্প - গল্প: কৈশোরের স্বপ্নডুবি

গল্প: কৈশোরের স্বপ্নডুবি

কৈশোরের স্বপ্নডুবি- সফিকুল ইসলাম

বেলা তিনটা। রোদেলা দিন।বর্ষাকাল।পানিতে টইটুম্বুর খাল। হালকা স্রোত রয়েছে। খালের পরিস্কার পানির মধ্যে আমি।  একবার ডুবছি, আরেকবার ভাসছি। না, এটা কোন নিছক আনন্দ বা খেলা নয়। স্কুল থেকে ফেরার পথে গুদারা (খেয়া) পার হতে হয়। ফুল মিয়া দীর্ঘদিন ধরে গুদাড়া চালান। নাওয়ে (নৌকা)বসে কেউ দুষ্টুমি করলে চহির দিয়ে মাথায় টোকা দেন। তাই সবাই ভয়ে থাকি। কিন্তু আজ গুদারা পারের সময় নাও  ডুবে গেছে।নাও নিজে নিজে ডুবে গেছে তাওনা। কোন ঢেউ নেই। কয়েকজন সিনিয়র ভাই কয়েকজন সিনিয়র আপুকে ঠাট্রা-মস্করা করায় রত। ফুল মিয়ার হাঁক কেউ শুনেনি। নাও এদিক ওদিক হেলিয়েছে। ওদের খেলা। উচ্ছল নির্মল আনন্দ। আর আমার মরণের ফাঁদ। সাঁতার জানিনা আমি।পানিতে ডুবছি আর জাগছি। সাথে ছিলেন আমিরুল মামা। তার কাঁদে ভর করেই ভেসে থাকার চেষ্টা করছি। সবাই  সাতঁরে পারে উঠে গেছে। আমিরুল মামাও উঠে যেত। কিন্তু আমি ছাড়ছিনা। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখছি। নিজের উপর খুব জেদ হচ্ছে। আমার সাথে যারা ক্লাস থ্রিতে পড়ে সবাই সাতাঁর পারে। আমি পারিনা। চেষ্টাও করেছি অনেকবার। কিন্তু ভয় কাটিয়ে উঠতে পারিনি।সবাই বলে খুব সহজ। ভয়ের কারণেই কি কৌশল রপ্ত হয়না?

আমিরুল মামা আমাকে ফেলে চলে যেতে চায়।পানির নিচে আমি, পানি গিলেই যাচ্ছি। আমি আরো শক্ত করে ধরি তাকে। তার কাঁধে ভর করে, মাথাটা উপরে তুলে শ্বাস নিই।হাতের বইগুলি কই চলে গেছে বলতে পারিনা। ভয় লাগছে। বই ছাড়া বাড়িতে গেলে নানু কি বকা দিবে? কিন্তু আমার কি দোষ! আমিতো সাতাঁরই পারিনা। দুটি ছোট গ্রাম। একটিতে স্কুল নেই। অন্যটিতে আছে। একটি বড় হাক্কা (সাকো) পার হয়ে আরেকটি গুদারা পার হয়ে এক গ্রামের সব বাচ্চাকে অন্য গ্রামে যেতে হয়।কতবার ভেবেছি আমি বড় হয়ে এ গ্রামে একটি স্কুল দিব। দুটো ব্রিজ করে দেবো। মক্তবের ছেড়া চাটাইগুলি নতুন করে কিনে দেবো। ফুটবলের অভাবে খড়ের মধ্যে পলিথিন প্যাচিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে গোলাকার বল বানিয়ে খেলি। বড় হলে গ্রামের সব বাচ্চার জন্য বল কিনে দেবো। আরও কত কী ভেবেছি। আমিরুল মামা আবার আমায় ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিতে চাইছেন। আমি প্রাণপনে আঁকড়ে ধরে রেখেছি তাকে। একবার আমি ডুবি। আরেকবার আমিরুল মামা ডুবে। একবার আমি, আরেকবার মামা। দূর থেকে যে কেউ দেখলে বাচ্চাদের খেলা বলে ভুল ঠাহর করবেন।আমি চিৎকারও করছি, তবে পানির কারণে মনে  হয় চিৎকার দূরে যাচ্ছেনা। আচ্ছা আমি কি আর বাঁচবো! মার মুখটা মনে পড়লো। গত সপ্তাহে যখন মাকে ছেড়ে আসি তখন আমায় খুব যত্ন করে ডিম ভেজে খাইয়েছিলেন, এক গ্লাস দুধও সরসহ পরম যত্নে মুখে দিয়েছিলেন। বিদায়ের সময় বারবার মা আচলেঁ চোখ মুছছিলেন। দোয়া পড়ে সাড়া শরীরে হালকা থুথু ছিটিয়ে আমাকে বিদায় দিয়েছিলেন। বাবা যখন আমাকে এখানে নানা বাড়িতে রেখে যান, আমার দিকে তাকাতে পারেননি। হয়তো বাবার মন খারাপ করা মুখটা আমাকে দেখাতে চাননি।

আমিরুল মামার কনুইয়ের সজোরে ধাক্কায় আমার সম্বিত ফিরে আসে। আমি কিছুতেই তাঁকে ছাড়ছিনা। তার উপর ভর করে আবার মাথা তুলে কোনরকমে শ্বাস নিই। আবার পানির নিচে আমি, আমিরুল মামা উপরে। আমি উপরে মামা নিচে। মামা উপরে আমি নিচে। আাচ্ছা আমি কি বাড়ি ফিরবো? মসজিদের হুজুর কত সুন্দর করে আজান দেন, কথা বলেন। আমি কি ওরকম পারবো? পাশের গ্রামের চেয়ারম্যান একদিন এসছিল। কী সুন্দর দেখতে। সবাই তাকে খুব সম্মান করে। আমি কি ওরকম চেয়ারম্যান হতে পারবো? ও পাড়ার এক মামা টিভি কিনেছে। টিভিতে কত কিছু দেখায়! আমার কি বড় হয়ে একটি টিভি কেনা হবেনা? হিন্দু বাড়ির পুজা দেখতে গিয়েছিলাম । কী সুন্দর প্রতীমা! আমি আবার দেখতে পাবোনা? শাজান স্যার আর তাজু স্যারের মতো ভালো শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম।সব বাচ্চাকে আদর করে ডাক ছেড়ে আয়রে খোকন ঘরে আয় শেখাবো। তাও কি হওয়া হবেনা? আইসক্রীমওয়ালার কাঠের বাক্সের আওয়াজ শুনে কতবার দৌড়ে গেছি। মনে মনে ভেবেছি, বড় হয়ে সবগুলি আইসক্রীম কিনে গ্রামের সব বাচ্চাকে নিয়ে একসাথে খাবো। তাও কি হবেনা? আমিরুল মামা বাম হাত দিয়ে আমার টুটি ধরে এমন জোরে ধাক্কা দিলেন যে আমার হাত ছোটে গেল। আমি টুপ করে ডুবে গেলাম। ডুবে গেলেও মামার একটা পা ধরতে পারলাম। পাটা শক্ত করে টেনে ধরলাম।, যেভাবে মানুষ গাছে উঠে সেভাবে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মামার সারা শরীর বেয়ে তার শার্টের কলার ধরে ফেললাম।আমার শরীরে শক্তি খুব কম। মরে যাবো তাই হয়তো এত শক্তি আজ। কোনরকমে মাথাটা উচিয়ে আবার একটু শ্বাস নিলাম।পাশ দিয়ে একটি ইঞ্জিনের নৌকা যাচ্ছে। ইঞ্জিনের শব্দটা কানে বাজতেছে। রেডিওতে ইরাক যুদ্ধের বোমা ফেলার আওয়াজের মতো শব্দ। বুশ বোমা কিনতে পারে আমাদের একটা ব্রিজ দিতে পারেনা? ব্রিজ দামি নাকি বোমা দামি। বোমা দামি নাকি ব্রিজ দামি। কথাটা মাথায় ঘুরছে।নানাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কিসের দাম বেশি। ইঞ্জিনের নৌকার ঢেউটা আমাদেরকে আরো তলিয়ে দিয়ে গেল।বিপদের সময় সবাই তামাশা করে। ঢেউও আমাদের সাথে তাই করলো।

আমার আর মামার কসড়ত চলছে।আমি ডুবি মামা জাগে।মামা ডুবে আমি জাগি।আমার হাত-পা ছুড়ে এত চেষ্টায় কোন লাভ হচ্ছেনা।  আমি আবার পানির নিচে। পানি খেতে খেতে পেট ফুলে গেছে। মাথাটা ঝিমঝিমি করছে। আমাদের কীরণ স্যার বিনা দোষে অভ্যাসবশত: ছাত্রদের মাথা দেয়ালের সাথে সজোরে ধাক্কা দিয়ে আঘাত দেন।আমাকেও অনেকবার দিয়েছেন। তখনও এরকম ঝিমঝিম করে। চোখে অন্ধকার দেখি। এখন অবশ্য অন্ধকার লাগছেনা। পানির নিচে সব দেখতে পাচ্ছি।আমাকেতো আগে বাঁচতে হবে। আমার এতকথা মনে পড়ছে কেন? চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে। হঠাৎ করে কি আমার কল্পনার গতি বেড়ে গেল। মনে হয় আমি মরে গেছি। মরে গেলে কোথায় যায়, মরে গেলে কি হয়? আমি কি এখন জীবিত নাকি মৃত? না না আমি বেচেঁ আছি। আমার মনকে বুঝাতে হবে। আমাদের ক্লাশের আমানের কথা মনে পড়ছে। খুব সুন্দর গান গায়। “আমি কী দিয়া সিচিব নৌকার পানিরে/ তুই সে আমার মন/ মন তোরে পারলামনা বুঝাইতেরে/ হ্যা তুই সে আমার মন”। মুজিব পরদেশীর গান। পল্লীগীতি। আমার খুব ভালো লাগে।কথা বুঝিনা। সুরটাই ভালো লাগে। মুর্শিদী গানও ভালো লাগে।নানার কন্ঠে শুনি “মুসলেম হইতে বহুদিন/ নামাজ পড়ি কোমর বেকা/ রোজা রাখি অঙ্গ শুকা/ খাওয়াইলে হাজার ভূখা/ এতিম মিসকিন/ মুসলেম হইতে বহু দিন”। ও পাড়ার এক মামার নামতো মুসলেম। মুসলেম হতে আবার বহু দিন লাগবে কেন? গানের মানে মাথায় ঢুকেনা। কিন্তু সুরটা ঠিক মনকে টানে। আমি কি আর গান শুনতে পারবোনা? আমিরুল মামা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। একসাথে উপরে উঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেননা। না পেরে আমার উপর ভর দিয়ে তিনি মাথাটা তুলে শ্বাস নিলেন। আমারও দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমিও তাকে টেনে ধরে নিচে নামিয়ে মাথাটা ‍ উপরে তুলে কোনরকমে নিঃশ্বাস নিলাম। আমি পানির উপরে জাগি মামা নিচে ডুবে। মামা ডুবে আমি জাগি। আমি ডুবি মামা জাগে।হঠাৎ দেখলাম খালের পাড়ে তাহের মাস্টারকে দেখা যায়।ছাতা হাতে দাড়িয়ে। তিনি আমায় হয়তো দেখতে পেয়েছেন। তিনি আমায় চিনেন। তিনি আমার মামাকে পড়ান। তিনি কি আমায় তুলবেন? তিনি কি ঝাঁপ দিবেন? তিনি মনে হয় ঝাঁপ দিয়েছেন। ভুল দেখলামনাতো! কি জানি হয়তো খোয়াব। নানার মুখটা মনে পড়ছে। ছোট বোনটার হাসিটা মনে পড়ছে।পটের গানের কথা মনে পড়ছে।ডাঙ্গুলি খেলা মনে পড়ছে।সব স্মৃতি একসাথে চোখে ভাসছে।চারপাশে আধাঁর লাগছে।কালো আঁধার। আমি মনে হয় অতল গহবরে হারিয়ে যাচ্ছি। আমি মনে হয় ডুবে যাচ্ছি। আমার সব স্বপ্নগুলিও ডুবে যাচ্ছে। হবে হয়তো। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

 

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart