মিঠা জুতার বারি
মিঠাজুতার বারি
…………………..
প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা। একবার আমার নানা জমিজমা সংক্রান্ত কোর্টকাছারির কাজে কসবার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কুমিল্লায় যাচ্ছেন। অনেক দূরের পথ। আট মাইল হাঁটার পরে বাস পাওয়া যাবে। তো সেই বাস ধরার জন্য খুব ভোরে রওয়ানা দিলেন। জমির আইল দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন।দুতিন গ্রাম পরে পথিমধ্যে একটি জমিতে চাষ চলতেছিল। জমির মালিক মই দিয়ে মাটি সমান করছিলেন। তো নানা সময় বাঁচাতে সেই জমিটি কোণোকোণি পার হচ্ছিলেন। অর্ধেক জমি পার হবার পর জমির মালিক এসে বললেন,
“এ মিয়া, দাড়াঁন, যেভাবে হেঁটে এসেছেন ঠিক সেভাবে পায়ের ছাপে পা দিয়ে দিয়ে আবার পেছনে ফিরে যান, তারপর আইল দিয়ে ঘুরে ঘুরে যান।“
ঘটনার আকস্মিকতা আর কুমিল্লায় পৌঁছানোর তাড়া থাকার কারণে নানা কোন প্রতিবাদ করলেন না। কথামতো ব্যাক করে চলে গেলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় নানার সাথে এরকম আচরণ কেউ করতে পারে তিনি ভাবতে পারেন নি।কষ্ট পেয়ে রাগ সামলেছিলেন কিন্তু বিষয়টি মনে গেঁথে গিয়েছিল।
তারপর অনেক বছর চলে গেল। হঠাৎ একদিন নানা তার জমিজিরাত দেখতে এবং শ্রমিকরা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা দেখতে নিজের গ্রামের বিলে গেলেন। দেখাশোনার এক ফাকেঁ দেখলেন একলোক কয়েকটা গরুকে ঘাস খাওয়াতে এ বিলে এসেছেন। লোকটিকে দেখে নানা চিনতে পারলেন। এই সেই লোক যিনি….। নানা তার খোঁজখবর নিলেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। তার সাথে হালকা খাতির করার চেষ্টা করলেন। তার গরুগুলোকে নানার নিজের কলাইখেতে কলাইশাক খাওয়ানো ব্যবস্থা করলেন। আর তার সাথে আরও খুব ভালো ব্যবহার করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তাকে দাওয়াত দিয়ে প্রায় জোর করে তার সব গরু সমেত বাড়িতে নিয়ে আসলেন। মুরগীপোলাওসহ তাকে জামাই আদরে ভুড়িভোজ করালেন। তার গরুগুলোকেও যথাযথ আপ্যায়নের জন্য কাজের লোককে বলা হলো। ওই লোক যাওয়ার চেষ্টা করলেই তাকে আরও আপ্যায়ন দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। রাতে রাখলেন।ওইলোক কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, কেন তাকে এত আদর আপ্যায়ন করা হচ্ছে। বারবার জিজ্ঞেস করছেন
“আপনি কেন আমাকে এত আদর যত্ন করছেন, আপনি কী চান, আপনি আমার কে হন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
নানা তার এসব কথার কোন উত্তর দেননি। শুধু বলেছেন, যে আপনি অনেক দূর থেকে আমার গ্রামের পাশে আমার জমিজিরাতের এলাকায় এসছেন। আপনাকে দেখলাম। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। যা করছি, তা মানুষ হিসেবেই করছি। মনের আনন্দে করছি। কোন কারণ নেই। রক্ত সম্পর্ক বা আত্মীয়ই বড় কথা না। আত্মার আত্মীয়ই বড় কথা। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আমার এলাকায় এসে আপনি না খেয়ে চলে যাবেন তা হয় না। এটাই আমার বাড়ির রেওয়াজ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাক পরেরদিন অনেক ওজর আপত্তি করে ওই লোক চলে গেলেন।
তারও বছরখানেক বাদে ওইলোকের মাথায় বিষয়টা মনে পড়েছে। পরে নানাকে একদিন পথিমধ্যে পেয়ে বলেছিল
ভূঞাসাব, “আপনার মিঠা জুতার বারি আমি কোনদিন ভুলবোনা!” (বারি মানে আঘাত)
(আমার নানার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিলো। তিনি বিভিন্ন স্টাইলে লিখতে পারতেন। হাতের লেখা, সাইনবোর্ড লেখা, দলিল লেখা, পোস্টার লেখা, গ্রন্থ লেখার স্টাইলের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। তিনি সব ধরণে লিখতে পারতেন। নানার লেখা দেখতাম আর ভাবতাম, আমি যদি ওরকম লিখতে পারতাম! আজ অবধি পারিনি। নানার কলম ধরার স্টাইলটিও ছিল ব্যতিক্রম। লেখার সময় মুখের অবয়বও পাল্টে যেতো, ঠোঁটটা চৌকা হয়ে যেতো। চশমাটা পড়তেন। কী বুদ্ধিদীপ্ত ছিল তার চাহনি, হাসি, আর কথা। যখন কথা বলতো তখন লোকে হা করে শুনতো। এক কথা থেকে আরেক কথায় যখন যেত, এক বাক্য থেকে আরেক বাক্যে যাওয়ার ফাকেঁ লোকে অবাক হয়ে অপেক্ষা করতো এর পরে কী বলবেন, তা শুনতে।)