গ্রামের পরিবর্তন
গত ত্রিশ বছর যদি মাথায় রাখি তবে দেখবো কোন কোন ইউনিয়নে খুব একটা রাস্তাঘাট ছিলনা। যা ছিল তাও কাঁচা । দিব্যি যাচ্ছিল তাদেঁর দিন। এবার দেখলাম প্রতিগ্রামের সব রাস্তাঘাট পাকা। এত রাস্তা হয়েছে যে তা মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল স্থানীয় সরকারের নেই। আর সরকারও এত রাস্তা প্রতি বছর মেরামত করতে পারবেনা। ফলাফল যা হলো মাঝে মাঝে রাস্তার অবস্থা এমন হয় যে রিকশাও যাবেনা; হেঁটে পার হওয়াও দায়। ছোট ছোট ব্রিজ করে পানির চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নদী, হাওর বিলের সাথে সংযোগ এখন নেই বললেই চলে। নৌকা চলাচল প্রায় বন্ধ। লোকজন অন্য কোথাও দেখেছে যে বাড়ি বাড়ি গাড়ি যায়। সুতরাং আমাদেরও বাড়ি বাড়ি গাড়ি যাওয়া লাগবে।তাই গ্রামীন নেতারা ইউনিয়ন নেতাকে, ইউনিয়ন নেতারা উপজেলার নেতাকে, উপজেলার নেতা কেন্দ্রীয় নেতাকে ধরে বাড়ি বাড়ি রাস্তা, বাড়ি বাড়ি ব্রিজ করে ফেলেছে। ইট পাথরের রাস্তা আর ব্রিজ হলেই উন্নয়ন হবে। আর কোন উন্নয়ন লাগবেনা। পরিবেশ প্রতিবেশ কোন বিবেচনা নেই। পঞ্চাশ একশ বছর পরে কী হবে সে ভাবনাও নেই। ফসলের ধরণ কী হবে, গ্রামভিত্তিক ফসল বা কারখানা কী হতে পারে, ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়নের কী রূপকল্প হবে এ নিয়ে কারো ভাবনা নেই। ভোটের রাজনীতি, নাগরিকের নগদ আরাম, ঠিকাদারের নগদ লাভ ইত্যাদির কাছে ভবিষ্যত হার মানে হারেহারে। রাস্তাঘাট লাগবে, উন্নয়ন লাগবে। তবে তা ভেবে চিন্তে। কোথায় কোন খাতে কত বিনিয়োগ তা দেখতে হবে। কোম্পানীর মাল দরিয়ামে ঢাল হলে তো মহা সমস্যা। মা বলতো “পেটের সাথে বুঝে ডাল খেতে হবে, নইলে ডাইরিয়া আসন্ন”।উন্নয়ন ডায়রিয়ায় ভূগতেছে অনেকে।
সরকার যে উন্নয়ন করছে বা বরাদ্দ দিচ্ছে তা দৃশ্যমান। এখানে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু আমরা যারা বরাদ্দ নিই, যারা কাজ করি, যারা এলাকায় থাকি তাদের উচিত এলাকার বা গ্রামের ভবিষ্যত চিন্তা করে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে এসব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু টিআর কাবিখা এডিবি ছোট ছোট প্রকল্প দিয়ে ইটপাথরের গ্রাম-উন্নয়ন করলে আর পরিচিতের মুখ বন্ধ করলে হবেনা।উন্নয়ন যে আরো বড় বিষয় তা বোধগম্য হওয়া লাগবে আমাদের সকলের।
লোকজন আগে নানারকম ফসল করতো বিশেষ করে রবিশস্য। মশুরি, কলাই, মটর, গম, বিন্নি, সরিষা, মাসকলাই, মরিচ, রশুন, পিয়াজ, ইত্যাদি। যে জমিতে যা প্রযোজ্য। এখন সবাই ধান করে। তিনফসলি জমিরে একফসলি বানিয়ে ফেলেছে। স্কীমের অধীনে শুধু ইরি ধান। কৃষকের সাথে কথা বলে দেখেছি। ইরি ধানে কোন লাভ নেই। যারা সব কাজ নিজে নিজে করে তারা শুধু শ্রমের দামটুকুই পায়। যারা শ্রমিক খাটিয়ে সব করে তাদের ধান উৎপাদনে কোন লাভ নেই। কৃষি বিভাগ নিশ্চয় কাজ করছে। তবু কোথাও একটা গ্যাপ আছে। বিচ্ছিন্ন কৃষকরা প্রকৃত চাষাবাদ পদ্ধতি জানেননা।তারাও উপজেলায় আসেননা, কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজার বা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবর্তন আনবে সেরকম ফলপ্রসূ চেষ্টাও চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে প্রতিগ্রামেই দেখি কৃষিবিভাগের প্রদর্শনী সাইনবোর্ড রয়েছে; সেটা দেখে যে অন্য কৃষকরা শিখবে সেরকম প্রচেষ্টা মেম্বার-ব্লক সুপারভাইজার-মাতব্বর-ইমাম ঘিরে নেই। ব্যাপক কৃষির প্রচলন খুব একটা দেখা যায়না। অথচ প্রতিটি জমির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে বর্তমান কৃষকরা অনেক ফসল ফলাতে পারতো। আশ্চর্যের বিষয় হলো একটি ইউনিয়ন ছিল একটু পাহাড়ী ধরণের একটু উঁচু। সেখানে শুধু সব্জি আর ফল উৎপাদিত হতো। এখন সেখানে শুধু ইরি ধানের স্কিম। উন্নয়নের কোন শটকাট রাস্তা নেই তবু কীসের নেশায় কীসের টানে ইরিতে মন মজেছে বিধাতা জানেন।
গ্রামে আগে তিন ধরণের ঘর দেখেছি। ছনের ঘর, টিনের ঘর, মাটির ঘর। পাকা ঘর বলতে পুরাতন জামিদার বাড়ি, কিছু ভূমির মালিক আর ব্যবসায়ীর বাড়ি ছাড়া খুব একটা দেখা যেতোনা। এবার কিছু গ্রামের প্রতিটি ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। দেখলাম যে সবাই পাকাবাড়ির দিকে ঝুঁকছে। উদ্ভট ধরণের পাকা বাড়ি। দেয়াল পাকা, জানালা ছোট ছোট, তথা বাড়িতে বিল্ডিং হলেই হলো। বিয়েশাদীতে নাকি কাজে লাগে। মেয়ের বাবার পাকা বাড়ি আছে বা ছেলের পাকা বাড়ি আছে শুনতে ভালো লাগে, বড় মুখে বলা যায়।
গ্রামের পাকা বাড়ি নিয়ে বেশ কয়েকটি কেস আমার কাছে খুবই কষ্টদায়ক ও অপরিণামদর্শী লেগেছে। যেমন এক, জমিজমা সব বিক্রি করে দিয়ে বড় করে পাকা ঘর তুলেছে, এখন আর কোন নিয়মিত ইনকাম নেই। ঋণ করে সুদী করে কোনরকমে সংসার চলছে।
দুই, বিদেশে থাকে; হাতে লাখ দশেক টাকা হয়েছে। তাই নামিদামি হওয়ার জন্য বড় করে পাকা ঘর তুলতে হবে। তাই আরো দশ লাখ টাকা ঋণ করে মোট বিশ লাখ টাকা খরচ করে বিশাল পাকা ঘর বানিয়েছে। পরে কোন কারণে বিদেশ থেকে ফেরত পাঠিয়েছে। দশ লাখ টাকার ঋণ এখন সুদে আসলে বাড়ছে।
তিন, পাশের বাড়িতে বড় দালান আছে; আমার না থাকলে হবে? তাই জমি বিক্রি করে বিশাল করে পাকা বাড়ি বানিয়েছে। চারপাশে বাউন্ডারি দিয়েছে। কিন্তু ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পেছনে কোন ব্যয় করেননা।
এই বিপুল পৃথিবীতে একটিমাত্র ছোটো স্নেহের কারবারে জীবনের সমস্ত মূলধন সমর্পণ করা ঠিকনা। তবু মানুষ কীভাবে নিশ্চিন্ত থাকে! হয়তো ভাবে ঘরখানি হয়ে গেলে তার পরে সামান্য উপস্বত্বে পরম সন্তোষে জীবন কাটিয়ে দিবে কিংবা সহসা একদিন প্রভাতে সমস্ত ঘরবাড়ি বিক্রয় করে কাঙাল হয়ে পথে গিয়া দাঁড়াবে।
এরকম আরো অনেক ধরণের কেইস। কোথায় যেন পড়েছিলাম, “আয় করতে পারে সবাই, ব্যয় করতে পারেনা কেউ”। তথা কোথায় কখন কীভাবে কত ব্যয় করতে হবে এ জ্ঞান অনেকেরই নেই। সবার হাতে টাকা থাকা সম্পদ না, কারো কারো হাতে টাকা হওয়া মানে ধ্বংস হওয়া।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাড়িঘর দেখে উদ্ভট লেগেছে পাকা বাড়ির ডিজাইনগুলো।মানুষ যেখানে থাকে সেখানকার ঘরবাড়ি-লোকজন সবই তাদের আপন আদর্শে গড়া হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না আমাদের দেশে এর ব্যত্যয় দেখা গেছে। হঠাৎ দেখে আপনি বুঝবেনইনা যে এটা কোন বাড়ি, নাকি মসজিদ, নাকি মাজার, নাকি রাজনৈতিক অফিস, নাকি ইটালিয়ান রেস্তুঁরা, নাকি থ্রি স্টার হোটেল। যেমন
১. এক পুলিশের ছোট কর্মকর্তার বাড়ি। বাড়ির চারপাশের দেয়াল মক্কামদিনার ছবি, কোরাণ হাদীসের বাণী দিয়ে ভরা। হঠাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি কোন বাড়ি।
২. আরেক বাড়ির ডিজাইন, ছাদের কার্ণিশ, রং ইত্যাদি দেখলে মনে হবে আপনি চট্রগ্রাম বা সিলেটের কোন মাজারে এসছেন। বাড়ির ভিতরে ঢুকলে বুঝবেন যে আসলে এটি একটি পারিবারিক ঘর।
৩. কিছু কিছু প্রবাসীর বাড়ি দেখলে মনে হয়ে কোন মসজিদে ঢুকতেছি। ডিজাইন, আদল, রং, লেখা, ছবি ইত্যাদি মিলে পুরোপুরি মসজিদ।
৪. হোন্ডা দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যখন ক্লান্ত তখন বিশাল নৌকাওয়ালা গেইট, হেলান দেওয়া সিড়ি, চারপাশের ছবি দেখে ভাবলাম রাজনৈতিক অফিস বুঝি। হোন্ডা থামিয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেখি, না, এটি রাজনৈতিক অফিস নয়। বাড়িটি কোন বড় নেতার? তাওনা। একইরকম দেখলাম আরেক বাড়িতে ধানেরশীষওয়ালা গেইট, বারান্দা, বাড়ির চারপাশের ওয়াল যে কেউ মনে করবে পার্টি অফিস। আসলে তা নয়। একটি পারিবারিক বাড়ি।
৫. কোন কোন ধনী প্রবাসী বাড়িকে সাজাতে গিয়ে এত বেশি কালার আর ডিজাইন করেছে যে আপনার মনে হবে থ্রি স্টার হোটেল কাম রেস্তুঁরা। কিছুতেই বাড়ি মনে হবেনা।
এসথেটিক সেন্স বা নান্দনিক বোধ সবার থাকবেনা ঠিক আছে। আরে বাবা টাকা যখন হয়েছে তখন একজন আর্কিটেকচার, একজন ইনটারিয়র ডিজাইনারের পরামর্শ নাও। না হয় রুচিবোধ আছে এমন কারো পরামর্শ নাও। “আমি দেশ বিদেশ ঘুরেছি, আমি ডিজাইন কম বুঝি?!” টাইপ অহংকার হলেতো মহা সমস্যা!
কেরালায় দেখেছিলাম, প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ডিজাইন কী সুন্দর, নিজস্ব কালচার আর রুচির ছাপ স্পষ্ট। তবে বাংলাদেশে এ দৈন্যদশা কেন? এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি ভালো উক্তি আছে “দশের চোখের উপরে যে দিনরাত্রি বাস করিতে চাহে,পরের চোখের উপরেই যাহার বাড়ি ঘর,তাহার আর নিজের ঘর বাড়ি নাই । সেই জন্যই সে রঙচঙ দিয়া পরের চোখ কিনিতে চায়,সেখান হইতে ভ্রষ্ট হইলেই সে ব্যক্তি একেবারে নিরাশ্রয় হইয়া পড়ে ।“
শুধু বাড়িইনা, আমাদের জামাকাপড়, নাটক সিনেমা, খাওয়া-দাওয়া সব কেমন পাল্টে যাচ্ছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, বৌদ্ধ আধিপত্য, হিন্দু আধিপত্য, মুসলিম শাসন, ব্রিটিশ শাসন আর এখন ইন্টারনেট আর বিশ্বায়ন একে একে আসে আমাদের সব চিচিংফাঁক হয়ে যায়।
আজ সব হল সারা, বিদায় লয়েছে তারা,. নূতন বেঁধেছে ঘরবাড়ি
-ড. সফিকুল ইসলাম।
(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )